18/08/2025
'ডিভোর্স' কথাটা শুনলেই সামাজিক প্রাণী হিসেবে আমরা অনেকেই চোখ কপালে তুলতে অভ্যস্ত! যারা ডিভোর্সি তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকানোতেই আমাদের অনেকের স্বাচ্ছন্দ্য!
অথচ....
দু'জন ভাল মানুষ ও কিছু সপ্তাহ/মাস/বছর একসাথে থাকতে যেয়ে বুঝে ফেলতে পারেন তারা একজন অন্যজনের জন্যে 'উপকারী' নন।
ভালোবেসে বিয়ে করা দুটো মানুষ ও বহু বছর বাদে বদলে গিয়ে বুঝতে পারেন - সুরটা কোথাও কেটে গেছে!
আবার কেউ বা বিয়ের পর ভয়ংকর অত্যাচারে দেয়ালে পিঠ ঠেকলে বোঝেন আর না, এবার নিজের জন্যে বাঁচতে হবে!
তাই সবার ক্ষেত্রেই ডিভোর্স একটা ইম্পালসিভ 'ডিসিশন' বা ধৈর্যের অভাব বা মানায় নিতে না পারার ব্যর্থতা - আমাদের এমন বোকা বোকা ভাবনাগুলো সঠিক নয়।
বরং,হতে পারে বহু জীবনের জন্যে এটাই মুক্তির 'একমাত্র' পথ - যা বাইরে থেকে আমাদের বুঝতে পারার বা ধরতে পারার কোন কারন নেই।
তাই ডিভোর্স কে নয়, বরং আসলেই আমাদের কে যা ক্রিমিনালাইজড করতে হবে - বিস্তর আলোচনা দরকার সেগুলো নিয়ে।
⏩ডিভোর্সের পর নোংরা কাদা ছোড়াছুড়িতে মেতে ওঠা
⏩হাজার মিথ্যে দিয়ে প্রাক্তনের চরিত্র হননের চেষ্টা ⏩তাকে/তার পরিবারকে নাস্তানাবুদ করবার জন্যে টাকা/ক্ষমতা/জিঘাংসার নোংরা প্রদর্শন
- প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হওয়া উচিত এগুলো নিয়ে।
কারন, কোনভাবেই এগুলো সুস্থ মস্তিষ্কের দায়িত্বশীল মানুষের কাজ নয়।
তারচেয়ে বড় কথা, আমাদের ধর্মের শিক্ষা নয়।
আমাদের ইসলাম ধর্মে, ডিভোর্স একটা 'পরীক্ষা'।
যে পরীক্ষায় পাশ এবং ফেইল আছে।
ডিভোর্সের পুরো প্রসেসে একজন নিজের সবরে/শোকরে/তাওয়াক্কুলে নিজেকে জান্নাতের হকদার ও বানায় ফেলতে পারেন।আবার জুলুমে/মিথ্যাচারে/অহমিকার আস্ফালনে আল্লাহর ক্ষমার অযোগ্য ও হয়ে উঠতে পারেন।
আমরা বাহ্যিকভাবে মনে করি স্বামী ও স্ত্রী একটা বিয়ে নামক সামাজিক কন্ট্রাক্টে ছিল, ডিভোর্সের মাধ্যমে সেটা ভেংগে বের হল।
আমরা ভুলে যাই, স্বামী এবং স্ত্রীর এই কন্ট্রাক্টটার একটা স্পিরিচুয়াল সিগনিফিক্যান্স আছে।
যার ঠিক মাঝে যিনি শুরু থেকে শেষ অবধি থাকেন তিনি মহান আল্লাহ - যিনি ঘুমান না, যিনি সব দেখেন।সব শোনেন। সব জানেন।
তাই 'তালাক্ব' শব্দটার আশেপাশে বারবার 'জুলুম' এবং 'হক' শব্দটা আমাদের ইসলাম ধর্মে এতো গুরুত্ব পায়।
As if-
'Are you sure, you are not the abuser?'
'Are you sure, you did your job right?'
উপরের এই কটা কথা বোঝাটা সবার জন্যেই ভীষণ জরুরী।
অন্যদিকে, তৃতীয় পক্ষ হিসেবে - আপনি বা আমি ছেলের পক্ষ নিব নাকি মেয়ের পক্ষ নিব এটা বড় কথা নয়!
পক্ষ টা মজলুমের পক্ষে না হলে, আমরা দুনিয়া এবং আখিরাত দু'জায়গাতেই যে ক্ষতিগ্রস্ত হব - এই ভয়ংকর সত্যটা জানাটাও যথেষ্ট।
তাতে বোকার মত জুলুমকারীকে সাহায্য না করে চুপচাপ বসে থাকলে ও মজলুমের উপকার।
এই লেখাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে যদি ডিভোর্সের ক্ষেত্রে 'সন্তান' এর বিষয়টি ও আলোচনাতে না আসে।
কারন, সত্যিকার অর্থে উপরের জুলুম গুলো কয়েক মাস বা ২-৫ বছরে হয়তো চাপা পড়ে যায়।
কিন্তু সন্তান নিয়ে ডিভোর্সের পর যে জুলুম গুলো হয় সেগুলোর ইম্প্যাক্ট হয়ে উঠতে পারে জীবনব্যাপী।
আইনি জটিলতা, অভিমান বা প্রতিশোধ কোনোভাবেই সন্তানের উপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয় - ক'জন ডিভোর্সের পর এভাবে ভাবেন?
সন্তান কোনভাবেই দুজন মানুষ বা দুটো পক্ষের punching bag বা emotional vomiting এর জায়গা হতে পারেনা - ক'জন মানেন?
ক' জন মনে রাখেন - This is not why we bring them into this cruel world in the first place!
ডিভোর্স এর মাধ্যমে দুজন মানুষের নিজেদের সম্পর্কের সমাপ্তি হয় তো ঠিকই কিন্তু মা/বাবা হিসেবে সন্তানের সাথে বন্ধন তো কোনদিন ভাঙে না!
এই সাধারণ কথাটা আমরা কেন যেন মনে রাখতে পারিনা!
উল্টো সন্তানই হয়ে ওঠে একটা প্রতিহিংসা প্রকাশের বিষয়।
যাতে আদতে সবচেয়ে ক্ষতি হয় এই সন্তানের ই!
লেখার বাকি অংশে তাই এই ইস্যুটাকেই আনতে চাই।
যে নির্মমতাগুলো আমরা দেখি/শুনি আজকাল:
⏩কোথাও দেখা যায় সন্তানকে মায়ের কাছ থেকে বছরের পর বছর দূরে রাখা হয়
⏩আবার কোথাও বাবাকে সন্তানের বড় হওয়া, তার শৈশবের স্মৃতি সবকিছু থেকে বঞ্চিত করা হয়
⏩সন্তানের সামনে একে অপরের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মা কত খারাপ/বাবা কত খারাপ।
এসব কেবল ভুল নয়, এগুলো প্রতিটি ই ভয়ংকর জুলুম।
একজন মায়ের কাছ থেকে যখন সন্তানের গায়ের গন্ধ নেয়ার ন্যূনতম অধিকারটুকু ও কেড়ে নেয়া হয়, একই শহরে থেকে বছরের পর বছর বুভুক্ষের মত মা প্রতীক্ষায় থাকে সন্তানের দেখা পাবার, সন্তানের পছন্দের একটা ভাল খাবার রাঁধলে যা আর গলা দিয়ে নামে না - সেই মা টার কথা একবার ভাবুন!
তেমনি, একজন বাবা যখন সন্তানের মুখে "আব্বু” ডাকটা শুনতে পাননা, বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন না, পাশে থাকতে পারেন না - তার যে কষ্ট সেটা কেবল যিনি এর ভেতর দিয়ে যান তিনি ই জানেন!
সন্তানের কথাটাও ভাবুন!
নিজের বাবা/মা কে 'খারাপ মানুষ' হিসেবে চেনার মত মানসিক যন্ত্রণা আর কোন কিচ্ছুতে নেই! একটা ছোট্ট মানুষ তার মত করে তার বাবা কে বোঝে, মা কে চেনে - সেই জগতটা তৈরি হবার আগেই ভেংগে যাওয়া নিজের অস্তিত্বের শেকড় ধরে টান খাবার মত!
অন্যের লেন্স দিয়ে নিজের বাবা/মা কে চিনতে বাধ্য করা হয় হাজার শিশুকে! অন্যের সিদ্ধান্তে ঠিক হয় সে মা কে বা বাবা কে দেখতে পারবে কিনা, ছুঁতে পারবে কিনা!
যেই কাজটাকে আমরা 'অন্যায়' বলে মনেই করিনা!
আমরা যারা এসবে অংশ নেই আমাদের এই ভয় থাকা উচিত যে, আল্লাহ মাজলুম হিসেবে এদের চোখের পানির সাক্ষী! এবং তাদের এবং আল্লাহর মাঝের পর্দা টা উঠে গেছে।
বাবা/ মা ব্যক্তিজীবনে যত ভুলই করে থাকুক না কেন, সন্তানের উপর তাদের হক তাতে বদলে যায় না।
তাকে সেই হক থেকে বঞ্চিত করা নিশ্চিত অপরাধ।সন্তানের প্রাথমিক জিম্মাদারি যার কাছে আসুক না কেন, এই জুলুম করা থেকে বিরত থাকতেই হবে।
ডিভোর্স এর সাক্ষী হওয়া যেকোন সন্তানের জন্যে ভয়াবহ কষ্টের।কিন্তু নিজের বাবা মা কে রোজ বিষাক্ত সম্পর্কে জোর করে আটকে থাকতে দেখাটাও একই কষ্টের।
এর বিপরীতে অজস্র রিসার্চ সাক্ষী, বাবা মায়ের শান্তিপূর্ণ বিচ্ছেদ এবং কো প্যারেন্টিং এ বাবা মা কে একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দেখা, যত্নশীল দেখা - সন্তানদের মনস্তত্বে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এই ট্রমাটা কাটাতে যেটা ভীষণভাবে সাহায্য করে।
আমরা যত চেষ্টাই করি, সমাজে ডিভোর্স আটকাতে পারা সম্ভব নয় - ডিভোর্স বাড়ছে, সামনে আরো হয়তো বাড়বে।
ডিভোর্স পরবর্তি জুলুমের বিরুদ্ধে আমাদের পারিবারিক সচেতনতা বাড়ানো উচিত।সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়ানো উচিত।
একজন মা/বাবা/সন্তান মাসের পর মাস এসব জুলুম সহ্য করবে আমরা কেউ তার প্রতিবাদ করব না - এটাকে ভাল মানুষি বলে না! অন্যায় কে প্রশ্রয় দেয়া বলে।
আমরা যখনই শুনব কোন পরিবার ডিভোর্সের ফেইজ পার করছে, আমরা আমাদের নিজেদের জাজমেন্ট,বায়াস আর প্রিজুডিস যেন সামলে নিতে শিখি।পারলে সাহায্য করি।না পারলে অবিরাম দোয়া করি, যেন আল্লাহ সহজ করেন।
কিন্তু কোনভাবেই যেন জুলুমের অংশ না হই।