07/02/2022
ক্যান্সার জনিত ব্যথা এর প্রকৃতি ও চিকিৎসা পদ্ধতি: পর্ব-১
ক্যান্সার কি?
আমরা সকলেই জানি আমাদের এই শরীর একটিমাত্র কোষ থেকে বিভাজনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। এই শরীরে রয়েছে অসংখ্য কোষ এর সমন্বয়। যদি কোন কারনে শরীরের কোন একটি কোষের অস্বাভাবিক বিভাজন ক্ষমতা সম্পন্ন হয় তখন এটাকে ক্যান্সার বলা হয়।
ক্যান্সারের কারণে কেন ব্যথা হয়?
শরীরে কোথাও যদি ক্যান্সার হয় তাহলে অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে এর আকৃতি অস্বাভাবিক ধরনের বড় হতে থাকে। এই বড় ক্যান্সার অংশটি তার আশেপাশের বিভিন্ন অংশে চাপ প্রয়োগ করে ব্যথার তৈরি করে। ক্যান্সার থেকে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল পদার্থ রিলিজ হয় যেগুলো ব্যথার অনুভূতি তৈরি করে। ক্যান্সার অঙ্গটি যখন শরীরের কোন স্নায়ুতে চাপ প্রয়োগ করে তখন স্নায়ুজনিত ব্যথা উৎপন্ন হয়। আবার ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের কেমো থেরাপি বা রেডিওথেরাপি ব্যবহার করি যার পরবর্তী ফলাফল হচ্ছে বিভিন্ন অংশের রক্ত চলাচল কমে যায়, বিভিন্ন জায়গার স্নায়ুতে চাপ তৈরি হয়, শরীরের বিভিন্ন অংশের কোষ এলোমেলো ভাবে লেগে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়ে ব্যথা উৎপন্ন হয়। ক্যান্সার ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় যখন ক্যান্সার আমাদের হাড়ে ছড়িয়ে পড়ে তখন তীব্র ব্যথার অনুভূতি তৈরি হয়।
ক্যান্সার জনিত ব্যথার কি কোন চিকিৎসা নেই?
এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব পৃথিবীতে সকল ব্যথার চিকিৎসা আছে। তবে ক্যান্সারজনিত ব্যথা একটি জটিল প্রক্রিয়া। যে কারণে এর ব্যথার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও একটু জটিল। কোন কোন ক্ষেত্রে ক্যান্সার যখন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তখন বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় একই সাথে ব্যথা উৎপন্ন হওয়ার কারণে সেটি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হলেও তার তীব্রতা কে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কোন কোন ক্ষেত্রে ক্যান্সার হওয়ার কারণে আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। আমাদের চারপাশে যারা আছেন তারা এই সকল বিষয়গুলো বুঝতে পারেন না এবং ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ বা সম্পর্ক অনেক সময় কমিয়ে দেন। যার কারণে ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচণ্ড রকম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। যেখান থেকে মানসিক কারণে ব্যথার উৎপন্ন হয়। সকল ব্যথার চিকিৎসা করা গেলেও এই ব্যথার চিকিৎসা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
ক্যান্সার জনিত ব্যথার চিকিৎসা পদ্ধতি?
যেহেতু ক্যান্সারজনিত ব্যথা একটি জটিল প্রক্রিয়া সেহেতু সুনির্দিষ্ট কোনো একটি পদ্ধতির মাধ্যমে এই ব্যথার চিকিৎসা সম্ভব নয়। একাধিক পদ্ধতির মাধ্যমে এই ব্যথার চিকিৎসা করা হয়।
প্রথমত ক্যান্সার আক্রান্ত অঙ্গ সরাসরি এক ধরনের কেমিক্যাল রিলিজের মাধ্যমে ব্যথার উৎপন্ন করে। এজন্য ক্যান্সারের শুরুতেই যেই অঙ্গটি ক্যান্সারে আক্রান্ত সেই অঙ্গটিকে অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করাই ক্যান্সার জনিত ব্যথার প্রাথমিক চিকিৎসা।
শরীরের কোথায় কোন অঙ্গে কোন ধরনের ক্যান্সার হয়েছে এ বিষয়টির উপরে ব্যথার চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে। আবার ক্যান্সার আমাদের শরীরে কি পরিমান বিস্তার লাভ করেছে এর উপরেও ক্যান্সার চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে। ক্যান্সার যদি অতি বিস্তৃত হয় তাহলে ক্যান্সার অঙ্গটি অপসারণের পরেও এর অন্যান্য জায়গায় বিস্তার রোধে কেমোথেরাপি রেডিও থেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সার জনিত ব্যথার তীব্রতা কমানো সম্ভব।
আমাদের শরীরে ব্যথা বিস্তারের জন্য সবচেয়ে প্রধান অঙ্গ টি হচ্ছে স্নায়ু। মূলত স্নায়ুর মাধ্যমিক ব্যথার অনুভূতি তৈরি এবং বিস্তার হয়। ক্যান্সার জনিত ব্যথার একটা মূল কারণ স্নায়ুর সংযোগ। ক্যান্সারাক্রান্ত অঙ্গটি যে স্নায়ুর মাধ্যমে ব্যথা বিস্তার করছে সেই স্নায়ুকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নষ্ট করে দেয়ার মাধ্যমে ও ব্যথার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে মডার্ন ইন্টারভেনশনাল পেইন মেডিসিন বেশকিছু ইন্টারভেনশনাল পদ্ধতি সারাবিশ্বে প্রয়োগ করার মাধ্যমে ক্যান্সার জনিত ব্যথার চিকিৎসা করে আসছে। এই ধরনের প্রক্রিয়া গুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত।
ক্যান্সারের কারণে কোন কোন সময় আমাদের শরীরের কোন স্নায়ু সংযুক্ত না হলেও স্নায়ুর চলাচলের পথে বাধা তৈরীর মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদী ব্যথার অনুভূতি তৈরি করতে পারে। এই অবস্থাকে বলা হয় এন্ত্রাপমেন্ট সিনড্রোম। এধরনের ক্ষেত্রেও নার্ভ ব্লক এর মাধ্যমে ক্যান্সার জনিত ব্যথার চিকিৎসা করা হয়।
ক্যান্সার এর কারণে ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তি মানসিকভাবে প্রচন্ড বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এর ফলে সে মানসিক কারণে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। এই প্রকৃতির ব্যথা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ধরনের ঔষধ এর পাশাপাশি সাইকলজিক্যাল কাউন্সেলিং প্রয়োজন হয়।
ক্যান্সার জনিত ব্যথার চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে যখন ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থা বোঝার উপায় হচ্ছে ক্যান্সার যখন আমাদের হাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থায় ব্যথার নিয়ন্ত্রণ স্বাভাবিক ঔষধের মাধ্যমে সম্ভব হয় না। তখন নির্দিষ্ট কিছু ঔষধের মাধ্যমে এ সকল ব্যথার চিকিৎসা করা হয়। যে ওষুধগুলো নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে এবং যে সকল ব্যথা বিশেষজ্ঞগন এগুলো সচরাচর পরামর্শ দিয়ে থাকেন সেই ধরনের চিকিৎসকের কাছ থেকেই নির্দেশনা নিয়ে খেতে হয়। সঠিক মাত্রার ঔষধ ব্যবহার না করলে ক্যান্সার জনিত ব্যথার এই ধাপে ব্যথার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যথা নিয়ন্ত্রণে করণীয়?
১। ক্যান্সার একটি বাস্তবতা এবং কঠিন বাস্তবতা। প্রথমত এই কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে নিজে ভেঙে না পড়ে বরং এর চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা।
২। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ক্যান্সার জনিত ব্যথার চিকিৎসার মূল ধাপ। তাই এই বিষয়ে কোনো দেরি না করে সঠিক চিকিৎসক এর মাধ্যমে ক্যান্সার আক্রান্ত সঠিকভাবে চিহ্নিত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করাই শ্রেয়।
৩।অনেকেই প্রাথমিকভাবে ক্যান্সার নির্ণয় হওয়ার পরেও ভালোভাবে নির্ণয় হওয়ার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন বা যান। এ কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে ক্যান্সার এর মূল চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়। ফলশ্রুতিতে ক্যান্সার শরীরে দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
৪। বিভিন্ন অঙ্গের ক্যান্সারের প্রকৃতি অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
৫। ক্যান্সার চিকিৎসায় কোন কোন ক্ষেত্রে অনেক ব্যয়বহুল। সে ক্ষেত্রে নিজের সাধ্য এবং সীমাবদ্ধতার অবস্থা চিন্তা করে এর চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনেক উন্নত জায়গায় চিকিৎসা নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়ে মূল চিকিৎসা শুরু করতে দেরি করা কখনই সমীচীন হবে না।
৬। ক্যান্সার জনিত ব্যথার মূল ধাপ নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত রাখা। কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে চিকিৎসার পদ্ধতি গুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করার মাধ্যমে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ভালো থাকা সম্ভব।
ক্যান্সার জনিত ব্যথা নিয়ে লেখা অব্যাহত থাকবে। আজকের লেখা এখানেই শেষ করবো। পরিশেষে বলব ক্যান্সার জনিত ব্যথার যদিও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা সম্ভব নয় তারপরও এটিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এনে সুস্থভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব।.................চলবে।
ডাঃ মোঃ আহাদ হোসেন
এমবিবিএস, বিসিএস, এমডি (বিএসএমএমইউ) এফআইপিএম (ইন্ডিয়া)
চীফ কনসালটেন্ট ও ব্যথা বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশ সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন, কাঁটাবন, ঢাকা।
+8801958060777