01/10/2023
জানার আছেঃ
ডেঙ্গু ভাইরাস
Dengue virus (DENV)
এটি একটি এক সূত্রক আরএনএ ভাইরাস। এই ভাইরাসের প্রাথমিক ধারক এডিস মশা, দ্বিতীয় ধারক মানুষ এবং অন্যান্য কিছু প্রাইমেটিদের। এই ভাইরাসের আক্রমণে সৃষ্ট রোগকে সাধারণভাবে 'ডেঙ্গু জ্বর' নামে অভিহিত করা হয়।
★ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রকৃতি
মূলত একই ধরনের জিনোম ভিতরে রয়েছে ডেঙ্গু এবং আরও অন্যান্য ভাইরাস। এদের ভিতরে রয়েছে- ইয়েলো ফিভার ভাইরাস, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, সেন্ট লুইস এনকেফেলাইটিস ভাইরাস, জাপানি এনকেফেলাইটিস ভাইরাস, টিক-বর্ন এনকেফেলাইটিস ভাইরাস,ক্যাজেনুর ফরেস্ট ডিজিজ ভাইরাস এবং ওমস্ক হেমোরেজিক ফিভার ভাইরাস। এদের বেশির ভাগই আর্থ্রোপড বা পতঙ্গ (মশা বা টিক) দ্বারা বাহিত হয়ে সংক্রামক রোগ তৈরি করে। এই কারণে এদেরকে বলা হয় আর্থ্রোপোড-বর্ন-ভাইরাস (arthropod-borne viruses)।
ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনোমের রয়েছে প্রায় ১১০০০ নিউক্লিওটাইড বেস। এর জিনকোড-এ আছে তিনটি ভিন্ন প্রকারের প্রোটিন অণু। এদেরকে চিহ্নিত করা হয় C, prM এবং E। এই প্রোটিন অণুগুলো ভাইরাসের প্রতিরূপ বানাতে সাহায্য করে।
ফ্ল্যাভিভাইরাস গণের অন্তর্ভুক্ত ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি উপ-বিভাগ রয়েছে। এদেরকে বলা হয় সেরোটাইপ। এদের নামকরণ করা হয়েছে DENV-1, DENV-2, DENV-3 এবং DENV-4 । মূলত এই চারটি সেরোটাইপ মিলে ডেঙ্গু জ্বরের সৃষ্টি হয়। যখন কোনো মানুষ এই সেরোটাইপগুলো দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন এর কোনো একটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধে শরীরের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হলেও, অন্যান্য সেরোটোপের ক্ষেত্রে তা স্বল্পমেয়াদী হয়ে থাকে। ফলে আগে যাদের একবার ডেঙ্গু হয়ে গেছে, তাদের পুনরায় এই ভাইরাস আক্রমণ করলে, তা ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেয়।
★ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক
ডেঙ্গুভাইরাসের বাহক হলো- এডিস গণের মশা এই ভাইরাসের বাহক। উল্লেখ্য, এই মশা ইয়েলো ফিভার ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসেরও বাহক। এই গণের যে সকল প্রজাতি এই ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেগুলো হলো- A. albopictus, A. polynesiensis এবং A. scutellaris ।
এডিস গণের স্ত্রী মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির রক্তপান করলে, ভাইরাস ওই মশার শরীরে প্রবেশ করে। এরপর প্রায় ৮-১০ দিন পর ভাইরাসটি মশার দেহের অন্যান্য কোষে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে মশার লালাগ্রন্থি থেকে এর লালায় চলে আসে। তবে এই ভাইরাস মশার উপর কোন ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে না। এই ভাইরাস বহনকারী মশা সুস্থ মানুষকে আক্রমণ করে, মশার লালার সূত্রে সুস্থ দেহে ছড়িয়ে পড়ে।
মশা ছাড়াও ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির রক্ত দান, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সিরিঞ্জ জাতীয় উপকরণের মাধ্যমে ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারে। ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো নারী সন্তান প্রসব করলে, নবজাতকের দেহে ডেঙ্গু ভাইরাস পাওয়া যায়।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রকৃতি: চিকিৎসকদের মতে দুই ধরনের ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। এই ধরন দুটি হলো-
ডেঙ্গু ক্যাসিকাল: এই জ্বরে উচ্চ শারীরিক তাপমাত্রা এবং সেই সাথে মাংসপেশী ব্যাথা, শরীরের গিঁটে ব্যাথা, চোখের পেছনে ও মাথায় ব্যাথা, শারীরিক অবসাদ, বমি ইত্যাদি দেখা যায়। এছাড়া শরীরের কিছু অংশে, বিশেষত চামড়ার নিচে রক্ত জমাট বাঁধা- এ লক্ষণগুলো দেখা যায়। ক্যাসিকাল জ্বরে সাধারণত ৫-৭ দিন থাকে। তারপর ধীরে ধীরে রোগীর অবস্থার উন্নতি হতে থাকে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক: এই জ্বরে রোগীর অবস্থা খুব শোচনীয় হয়। কারণ এক্ষেত্রে ক্যাসিকাল জ্বরের লক্ষণগুলোর সাথে সাথে আরও বাড়তি কিছু উপসর্গ দেখা যায়। যেমন- নাক, কান, দাঁতের মাড়ি, খাদ্যনালি দিয়ে, মলমূত্রের সাথে, এমনকি হাত বা পায়ের চামড়া ফেটেও রক্ত বের হতে পারে। শরীরের রক্তচাপ অনেক কমে যায়। তখন এ অবস্থাকে বলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। মূলত রক্তে অনুচক্রিকার সংখ্যা কমে যাওয়াতেই এই রক্ত ক্ষরণ হয়।
ডেঙ্গুর চিকিৎসা
ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত ভ্যাক্সিন বা টিকা আবিস্কৃত হয় নি। তবে এর টিকা আবিষ্কারের জন্য ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে সিঙ্গাপুরে ওষুধশিল্প প্রতিষ্ঠান নোভার্টিস, সিঙ্গাপুরে ইনস্টিটিউট ফর ট্রপিক্যাল ডিজিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো- ডেঙ্গু বহনকারী এডিস মশার দংশন থেকে নিজেকে রক্ষা করা। এই কারণে, ডেঙ্গু জ্বর প্রবণ এলাকাগুলোতে এডিস গণের মশা নির্মূল করা। বিশেষ করে এডিস মশাদের আবাসস্থলগুলো নষ্ট করা উচিত। যেগুলো নষ্ট করা সম্ভব নয়, সেগুলোতে যেন ৫ দিনের বেশি সময় পানি জমে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এই মশা দিনের বেলায় কামড়ায়, তাই দিনে ঘুমালে, অন্তত বর্ষাকালে, মশারি টানিয়ে ঘুমানো উচিত।
প্রাথমিক যখন চারদিকে ডেঙ্গু জ্বরের সংবাদ পাওয়া যাবে, তখন শতর্কতা অবলম্বন করা। প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত রোগী পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও ফলের রস পান এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পারেন। এক্ষেত্রে এ্যাসপিরিন, স্টেরয়েড বা এন্টিবায়োটিক জাতীয় খাওয়া উচিত নয়। রোগী বেশি দুর্বল হয়ে পড়লে স্যালাইন দেওয়া যেতে পারে।
★প্রতিরোধ
ডেঙ্গুজ্বরের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই বলে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের দিকেই আমাদের নজর দিতে হবে। এডিস মশাদের আবাসস্থলগুলো নষ্ট করা উচিত। যেগুলো নষ্ট করা সম্ভব নয়, সেগুলোতে যেন ৫ দিনের বেশি সময় পানি জমে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ মশা দিনের বেলায় কামড়ায়, তাই দিনে ঘুমালে, অন্তত বর্ষাকালে, মশারি টানিয়ে ঘুমানো উচিত।