25/10/2025
মৃতদেহের ওপর বিকৃত যৌনাচার বাড়ছে, বাংলাদেশে এর শাস্তির বিধান কী?
মৃতদেহ ধর্ষণ বা অন্যান্য যৌনাচারের প্রবণতাকে বলা হয় নেক্রোফিলিয়া।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের মর্গে রাখা এক তরুণীর মৃতদেহে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ বলছে, অভিযোগ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে মরদেহ আনা-নেওয়ার দায়িত্বে থাকা লাশবাহক।
তবে এমন ঘটনা বাংলাদেশে এবারই প্রথম নয়। এর আগে, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে এমনই আরেকটি ঘটনায় গ্রেফতার হন মর্গের পাহারাদার মো. সেলিম। ২০২০ সালে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঁচটি মরদেহে একই পুরুষের বীর্যের উপস্থিতি পেয়ে তদন্তে নামে সিআইডি। গ্রেফতার হন মর্গের ডোমের সহযোগী মুন্না ভক্ত। গত সাত বছরে সামনে আসা তিনটি ঘটনাতেই ভুক্তভোগী ছিল নারীর মরদেহ।
মৃত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি, মৃতদেহ ধর্ষণ বা অন্যান্য যৌনাচারের প্রবণতাকে বলা হয় নেক্রোফিলিয়া। এ ধরনের আচরণের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শাস্তির বিধান থাকলেও, বাংলাদেশে এমন কোনো আইন নেই। ফলে মরদেহের নিরাপত্তা কেউ নষ্ট করলে তাকে সরাসরি অভিযুক্ত করার সুযোগ নেই।
আইনজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণের সব বৈশিষ্ট্য এ ধরনের ঘটনায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কেবল আইনের মারপ্যাঁচের কারণে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনা কঠিন হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে, আইন সংশোধন বা সংযোজন করা যেতে পারে বলেই মত তাদের।
নেক্রোফিলিয়া কী?
নেক্রোফিলিয়া এক ধরনের মানসিক অবস্থা যেখানে ব্যক্তি কোনো মৃতদেহের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে বা যৌন অনুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করে। ব্রিটানিকায় এই শব্দের অর্থ বোঝাতে বলা হয়েছে, মৃতদেহকেন্দ্রিক যৌন অনুভূতি বা কর্মকাণ্ড। এ বিষয়টিকে এক ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ বা মানসিক অসুস্থতা হিসেবে দেখা হয়।
অ্যামেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) বলছে, মৃতদেহের প্রতি যৌন আগ্রহ বা যৌন সংস্পর্শের এই প্রবণতা প্রধানত পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে, তারা নিজেরাই শিকারকে হত্যা করে। তবে প্রায়শই তারা মর্গ বা কবরের মাধ্যমে মৃতদেহের কাছে প্রবেশাধিকার পায়।
নেক্রোফিলিয়া যাদের রয়েছে তাদের ‘নেক্রোফিলিস’ বলা হয়। তারা মরদেহকে আবেগীয় ও যৌনভাবে ঝুঁকিহীন মনে করেন। সাধারণত সম্ভাব্য জীবিত সঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগের ভয় থেকে তাদের মধ্যে মরদেহের সাথে যৌন সম্পর্কের ইচ্ছা তৈরি হয়। বাধার শিকার কিংবা প্রত্যাখ্যাত হবার সম্ভাবনা থাকবে না, এমন যৌন সঙ্গী পাওয়ার বাসনা থেকেও তারা মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করে।
গবেষণা বলছে, এই ধরনের আচরণ যাদের মধ্যে রয়েছে, তারা মর্গ বা মরদেহ সামলাতে হয়, এমন কোনো কর্মসংস্থান খুঁজে নেয় যেন তারা সহজেই মরদেহের কাছে যেতে পারে এবং এর সুযোগ নিতে পারে।
যেসব পুরুষরা এই বিকৃত যৌনাচারের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে (৯২ শতাংশ) তাদের বয়স ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ছিল।
প্রাচীনকালের সমাজেও এই ধরনের অস্বাভাবিক আচরণের উপস্থিতি ছিল। ইতিহাসবিদ হেরাডোটাস তার দ্য হিস্টোরিস বইতে লিখেছেন, মরদেহের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মতো ঘটনা এড়াতে প্রাচীন মিশরে অভিজাত ও সুন্দরী নারীদের মরদেহ তিন থেকে চারদিন ফেলে রাখা হতো। ক্ষেত্রবিশেষে মৃতদেহ পাহারা দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হতো।
মৃতদেহের নিরাপত্তায় বাংলাদেশে কী ব্যবস্থা আছে?
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ঘটনাটি ঘটে গত রবিবার। আত্মহত্যা করা এক তরুণীর লাশ মর্গে রাখার পর তার ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে চিকিৎসক ধর্ষণের আলামত পান এবং পুলিশকে জানান। তদন্তের পর লাশবাহক আবু সাঈদকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। পরে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন সাঈদ।
তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৯৭, ৩৭৭ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় মামলা করার কথা গণমাধ্যমকে নিয়েছেন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শিবিরুল ইসলাম।
অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে ‘মৃতদেহের অসম্মানের ফলে ধর্মীয় অবমাননা, প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক এবং ধর্ষণের’ অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রথম দুই ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছিল ২০১৯ সালে আটককৃত মুন্না ভক্তের বিরুদ্ধেও। কিন্তু দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা, অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মবিরুদ্ধ যৌন সম্পর্কের সংজ্ঞায় জীবিত নারীপুরুষকে বোঝানোর যুক্তি উত্থাপন করেন তার আইনজীবী। ফলে এই ধরনের যেকোনো ঘটনায় আইনের এমন মারপ্যাঁচ দেখিয়ে অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে বলেই মনে করছেন অনেকে।
এছাড়া বাংলাদেশে যেকোনো মরদেহের ময়নাতদন্ত হয় সরকারি হাসপাতালে। আর বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটা তিনটি ঘটনাই ঘটেছে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে, যার দায়িত্বে থাকেন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক।
এর আগে, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যালের ঘটনার পর যোগাযোগ করা হলে তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ফরিদ হোসেন জানিয়েছিলেন যে, সেসময় মর্গে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নিরাপত্তা বাড়াতে হাসপাতালগুলোতে চিঠি দেওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। যদিও তার দুই বছর আগে ঢাকাতেও একই ঘটনা ঘটলেও কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
মৃতদেহের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য নতুন করে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না সে বিষয়ে জানতে বর্তমান পরিচালক ডা. মো. আবু জাফরের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ধর্ষণের মামলা কেন নয়?
বাংলাদেশে নেক্রোফিলিয়ার যে তিনটি ঘটনার কথা এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এর সবকটিতেই বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ২৯৭ এবং ৩৭৭ ধারার প্রয়োগ করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষ, নারী বা পশুর সাথে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন মিলন করে, তবে তাকে আজীবন কারাদণ্ড, অথবা সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে।
আর দণ্ডবিধির ২৯৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো উপাসনালয় বা সমাধিস্থলে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রবেশ করে মৃতদেহের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ করে, শোকপ্রকাশকারীদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে বা এমন কাজ করে যা কোনো ব্যক্তির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে তাহলে সে অপরাধ করেছে বলে গণ্য হবে। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মঞ্জিল মোরশেদ জানান, ‘কাস্টম ছাড়া মৃতদেহের নিরাপত্তার জন্য কোনো আইন নেই এখনো। কিন্তু দুইটা ঘটনা ঘটার পর এই ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা উচিত।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানার মতে, এই আইনে মর্গ বা হাসপাতালের মতো জায়গাগুলো অন্তর্ভুক্ত নেই। ফলে এই জায়গাগুলোয় হওয়া অপরাধ থেকে বেঁচে যাওয়ার সুযোগ আছে। একইসাথে ‘সম্মতি ছাড়া যেকোনো সেক্সুয়াল কাজই ধর্ষণের কাতারেই পড়ার কথা’ বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ জীবিত থাকা অবস্থায় সম্মতি দিতে পারে, তার ওপরে জোর বল প্রয়োগ করা হতে পারে। কিন্তু যখন একটা মৃতদেহের ওপরে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সেখানেতো তার সম্মতির কোনো ইস্যু নেই। ধর্ষণের প্রতিটি বিষয় পূরণ করা হলেও এটা কেন রেপ হবে না?’
অন্তত তিনটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর নতুন করে এই বিষয়ে চিন্তা করা ও ‘মৃতদেহের কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে’ আইন সংশোধন করা প্রয়োজন বলেই মনে করছেন আইনজীবীরা।