01/10/2025
"আমার আজকের লেখাটি খাদিজাকে নিয়ে, আর বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত শত খাদিজাদের নিয়ে। খাদিজার বাড়ী সাতক্ষীরা, স্বামী ভ্যানচালক। আজ থেকে ৭ দিন আগে মঙ্গলবার রাতে সে আমাদের ইউনিট এ যখন ভর্তি হয়েছিলো তখন তার ইতিহাস ছিলো এমন-
১) একদিন আগে সাতক্ষীরাতে তার অপারেশন হয়েছিলো পেটে জমজ বাচ্চা এবং প্রেসার অনেক বেশী এই কারনে।
২) প্রচুর রক্তক্ষরণ। সাতক্ষীরাতেই তাকে ৬ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছিলো।
৩) অপারেশনের পর থেকে ইউরিন ব্যাগ এ এক ফোঁটা ও ইউরিন আসেনি।
আমাদের ইন্টার্ন মেয়েরা এই মরণাপন্ন রোগীকে বাঁচানোর জন্য যারপরনাই যুদ্ধ শুরু করলো। রোগীর স্বামীকে রক্ত, ওষুধ আনতে বললে সে কিছু ওষুধ আনার পর আর পারলো না। রোগীর অবস্হা বোঝার জন্য ক্লিনিকাল পরীক্ষার পাশাপাশি কিছু ল্যাবরেটরী পরীক্ষা করতে স্যাম্পল পাঠানো হলো। রোগীর বিছানার পাশে টেস্ট টিউবের রক্ত জমাট বাঁধার পরীক্ষা করে দেখা গেলো ২০ মিনিট পরও রক্ত জমাট বাঁধছে না যেখানে ৪-১০ মিনিটের মধ্যেই রক্ত জমাট বাঁধার কথা।আমাদের এসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার রোগীর পেটে একটা সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে দেখলো পেটের ভিতর থেকে রক্ত আসছে, তার মানে পেটের ভিতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
সকালবেলায় রাউন্ডে আমরা সাধারণত ক্রিটিক্যাল রোগীদের আগে দেখি। আমরা যখন রাউন্ডে রোগীর কাছে গেলাম তখন দেখি রোগী অজ্ঞান, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, চামড়ার সেলাই দিয়েও অনবরত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমি রোগীর পেটে হাত দিয়ে দুটো আলাদা চাকার মতো ফীল করলাম। আমরা বুঝে গেলাম বা ধারনা করে নিলাম রোগীর প্রেসার বেশী, রক্তক্ষরণ ইত্যাদি সব জটিলতার জন্য
অলরেডি তার রক্ত না জমাটবদ্ধজনিত সমস্যা (DIC) হয়ে গেছে এবং হতে পারে পেটের ভিতর কোন একটা ছেঁড়া রক্তনালী থেকে রক্তপাত হচ্ছে। আমরা রোগীর স্বামীকে আরো রক্ত, প্লাজমা জোগাড় করতে বললাম এবং অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলাম।
রোগীর স্বামী আমার ইউনিট প্রধান কে বললো 'ম্যাডাম যদি রোগী বাঁচার সম্ভাবনা থাকে তাহলে দৌড়াদৌড়ি করবো বা রক্ত ওষুধ জোগাড় করবো, না হলে কিছু জোগাড় করতে পারবো না।'
আমার তখন মনে হলো দীর্ঘদিন সংসার করা আর স্বামী-সংসার-সন্তানদের লালন-পালন করা খাদিজার ভাগ্য তার গোয়ালের গরুর মতোই ..... মালিক যখন বুঝলো বাঁচার সম্ভাবনা কম তখন তাকে জবাই করে ফেলে। কী নিষ্ঠুর মেয়েদের নিয়তি!
আমরা ডাক্তার হয়ে তো আর সেটা হতে দিতে পারি না। রোগীর শেষ নিশ্বাসটুকু নেয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাই।হাল ছাড়ি না।
আমার ইউনিট প্রধান আমাকে দায়িত্ব দিলেন এ রোগীর অপারেশন করার।
আমি সহকারী রেজিষ্ট্রারকে অপারেশনের জন্য সবকিছু রেডি করতে বলে এবং সিনিয়র এনেস্থেটিস্টের কন্সালটেশন নিতে বলে আমরা অন্য রোগী দেখতে লাগলাম। একটু পর এসিস্টেন্ট রেজিস্ট্র্রার এসে আমাকে জানালো 'ম্যাডাম, রোগীর পেট হঠাৎ করে অনেক বেশী ফুলে যাচ্ছে, রোগীর শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে, রোগীর মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে আর ল্যাবরেটরি থেকে ফোন করে জানালো রোগীর ব্লাড সুগার মাত্র ২।'
আমরা তখন ধরেই নিয়েছিলাম যে রোগীকে হয়তো আমরা আর বাঁচাতে পারবো না । এখনই সব শেষ।
তাড়াতাড়ি আমরা রোগীর কাছে ছুটে গেলাম । আমি তখন সিস্টারদের কাছ থেকে মোটা ব্লাডসেট নিডল এনে রোগীর পেটে ঢুকিয়ে দিলাম, সাথে নল ও স্যালাইন ব্যাগ লাগিয়ে দিলাম আর ওদের বললাম তাড়াতাড়ি ২৫% গ্লুকোজ যেখান থেকে হোক জোগাড় করে পুশ করতে । রোগীর পেটের ভিতর থেকে অনবরত নল দিয়ে রক্ত এসে ব্যাগ ভরে যেতে লাগলো, পেট কমার সাথে সাথে এবং ২৫% গ্লুকোজ পাওয়ার পর থেকে রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাসও স্বাভাবিক হতে শুরু করলো, রোগী চোখ মেলে তাকালো। ইতিমধ্যেই রোগীকে আমরা ওটি তে নিয়ে গেলাম এবং এনেস্থেসিয়ার সিনিয়র কনসাল্টেন্ট সহ বাকিরাও রোগীর ম্যানেজমেন্ট এ যুক্ত হয়ে গেলো। আমার ইউনিট প্রধান শত ব্যস্ততার মাঝেও বারবার ফোন করে রোগীর খোঁজ নিচ্ছেন।
রোগী চোখ খোলার পর যখন কথা বলার চেষ্টা করছিলো আর আর মুখ থেকে অক্সিজেনের মাস্কটা বার বার সরিয়ে ফেলতে চাচ্ছিলো, আমি তখন খাদিজা কে জিজ্ঞেস করলাম 'খাদিজা তোমার কয়টা বাচ্চা?'
খাদিজা: 'আমার মোট পাঁচটে বাচ্চা, তিনটে বাড়ীত থুয়ে আইসেছি ,আরো দুটো হয়েছে সিজারে।আমার হাতে খুব ব্যথা, আমার হাতটা একটু কোথাও রাখপার দেন।'
আমি তখন খাদিজার হাতটা ধরে আমার হাতের উপর রাখলাম আর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। একটা ভেজা গজ দিয়ে ওর ঠোঁট মুখ মুছে দিলাম। মরণাপন্ন খাদিজার হঠাৎ বেঁচে ওঠা আমার ভেতরে ও প্রাণ সঞ্চার করলো।
এনেস্থেটিস্ট রোগীর গলার রক্তনালীতে সি ভি লাইন করলো এবং ইন্টিউবেট করার পর আমি আমার অভিজ্ঞ কলিগদের নিয়ে অপারেশন শুরু করলাম। পেট খুলেই দেখি চামড়ার নীচে, রেকটাস শীথের নীচে মাংসের মধ্যে বিশাল এক রক্তের চাকা। আমরা এটা কে 'সাবরেকটাল হেমাটোমা' বলি। সব ওপেন করার পর দেখি পেট ভর্তি রক্ত। সব ক্লিয়ার করে আমরা ব্লিডিংয়ের উৎস খুঁজতে লাগলাম। ইউরোলজিস্টকেও ইনভল্ভ করলাম কোন ইউরেটার বাঁধা পড়ার কারনে ইউরিন আসছে না কিনা সেটা নিরূপনের জন্য। শুধু মাসল এ একটা মোটা ছেঁড়া রক্তনালী ছাড়া আর কোথাও কোন ব্লিডিং পয়েন্ট পাওয়া গেলো না। সেটা বেঁধে দিয়ে , পেটের মধ্যে, রেকটাস শীথের নীচে, চামড়ার নীচে মোট তিনটা ড্রেইনটিউব রেখে আমরা অপারেশন শেষ করলাম। আমার এসিস্টেন্ট রেজিস্ট্রারের তখন সারারাত নাইট ডিউটি করে এই দীর্ঘ অপারেশনে দাঁড়িয়ে এসিস্ট করার পর ঘুমে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্হা।এদিকে এই রোগীকে ICU তে নিতে হবে কিন্তু ICU bed একটা ও খালি নেই। আমাদের ইউনিট হেড অনেক রিকোয়েস্ট করে একটা বেড ম্যানেজ করতে পেরেছেন তা ও পাওয়া যাবে অনেক পরে। অগত্যা রোগীকে Post operative Ward এ রাখতে হলো , কারন বাইরে কোন ICU তে ভর্তি করানোর সামর্থ ওর স্বামীর ছিলোনা। সন্ধ্যার পর তাকে ICU তে শিফট করা হলো। এদিকে অনেক চেষ্টার পরও রোগীর ইউরিন আসলো না, Creatinine দিনের পর দিন বাড়তেই লাগলো। রোগীর আর জ্ঞান ফিরলো না। তিনবার ডায়ালাইসিস করা হলো, তারপরও আর উন্নতি না হওয়ায় ওর স্বামী তাকে ওই অবস্থাতেই ICU থেকে নিয়ে যেতে চাইছে কারন সে তখন গরু, জমি বিক্রি করে নি:স্ব।
শেষ পর্যন্ত খাদিজা গতরাতে তার ৫ টা বাচ্চাকে এতিম করে আর আমাদের সবার সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলো। একজন স্বামী, যে শেষমেষ সব হারিয়ে হাত তুলে নিলো… আর একটি পরিবার, যার ভবিষ্যৎ আঁধারে ঢেকে গেলো।
খাদিজার মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়— এটি প্রতিরোধযোগ্য ছিলো।
আমার এই লেখাটি দেশের গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা আর সব খাদিজাদের কাছে পৌঁছাবে কিনা জানি না। আমি চাইবো লেখাটি শেয়ার করে অন্তত যারা খাদিজাদের মতো মায়েদের আশেপাশে থাকেন তাদের নিচের বার্তাটুকু জানিয়ে দিন:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর নির্দেশ অনুযায়ী, প্রতিটি গর্ভবতী মায়ের অন্তত ৪ বার এন্টেনাটাল চেকআপ করা জরুরি:
✅ ১৬ সপ্তাহের মধ্যে ১ম বার
✅ ২৪-২৮ সপ্তাহে ২য় বার
✅ ৩২ সপ্তাহে ৩য় বার
✅ ৩৬ সপ্তাহে ৪র্থ বার
এছাড়াও, পোস্ট ন্যাটাল চেকআপ—অর্থাৎ সন্তান জন্মের পর নিয়মিত পরীক্ষা—অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক মা বলেন, “কোন সমস্যা অনুভব করিনি তাই চেকআপে আসিনি।” কিন্তু বাস্তবে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তশূন্যতা—এসব সমস্যা নীরবে জীবননাশী জটিলতা ডেকে আনে। নিয়মিত চেকআপে এসব প্রতিরোধ করা সম্ভব।
👉 প্রশ্ন রয়ে যায়—খাদিজার মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?
দেশ?
সমাজ?
চিকিৎসা ব্যবস্থা?
খাদিজার পরিবার?
না খাদিজা নিজেই?
একবার ভেবে দেখুন তো— সদ্য ভূমিষ্ঠ দুটি শিশু সহ পাঁচটি সন্তানের ভবিষ্যৎ এখন কার হাতে? 💔 "
ডাঃ. রুশদানা রহমান তমা
সহকারী অধ্যাপক
গাইনী অ্যান্ড অবস্ ডিপার্টমেন্ট
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
(লেখাটি সংগৃহীত ও ঈষৎ পরিমার্জিত)
#খাদিজারগল্প #মাতৃমৃত্যু #গর্ভকালীনসচেতনতা