05/12/2025
আয়রন ঘাটতি, হাড় মজবুত রাখতে কি করবেন।
বাংলাদেশে নারীদের আয়রন–ঘাটতি ও অ্যানিমিয়ার প্রকোপ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। সহজলভ্য দেশজ খাবারের মধ্যেই আছে শক্তিশালী সমাধান—আখ থেকে তৈরি পুষ্টিসমৃদ্ধ ঝোলা গুড় বা ব্ল্যাকস্ট্র্যাপ মোলাসেস, যা দ্রুত ঘাটতি পূরণে সহায়ক।
জানেন কি আখের ঝোলা গুড় হলো প্রকৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী মিনারেল সাপ্লিমেন্ট
আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে আয়রন–ঘাটতিজনিত রোগীর সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। বিশেষ করে আয়রনের ঘাটতি প্রধানত আয়রন ডিফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া (আইডিএ) হিসেবে দেখা যায়, যা নারীদের একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৪-২৫ অনুমান অনুসারে, বাংলাদেশের ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীদের প্রায় ৪২ শতাংশ অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত—তাঁদের মধ্যে ৬০-৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে কারণ আয়রনের ঘাটতি। অর্থাৎ দেশের প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ নারী এ সমস্যায় ভুগছেন।
অথচ আমাদের দেশেই সহজলভ্য কিছু খাবার রয়েছে, যা আয়রন পূরণে দারুণ কার্যকর। কিন্তু আমরা সেগুলোর প্রতি প্রায়ই উদাসীন। এমন একটি দেশজ উপাদান আছে, যা উন্নত বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে—ব্ল্যাকস্ট্র্যাপ মোলাসেস, বাংলায় যাকে ঝোলা গুড় বলা যায়। আখ তিনবার জ্বাল দিয়ে সিরাপের মতো করা হয় এই মোলাসেস; এটি শুধু পুষ্টিকর নয়, বরং হজমেও সহায়ক।
আয়রন–ঘাটতির সমস্যা হয়
আয়রনের অভাবে শরীরে হিমোগ্লোবিন কমে যায়, ফলে অক্সিজেন পরিবহন ব্যাহত হয়। নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক স্রাব, গর্ভধারণ এবং খাদ্যাভ্যাসের ঝুঁকি আরও বাড়ায়।
বাংলাদেশি পরিসংখ্যান
• গ্রামীণ এলাকার ৩৮ শতাংশ গর্ভবতী নারী অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত,
• ৪৮ শতাংশ নারীর আয়রন–ঘাটতি আছে,
• বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্যে ৩৫-৪০ শতাংশ অ্যানিমিয়া (২০২৫ স্টাডি),
• বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (২০১৯) অনুযায়ী গর্ভবতী নারীদের অ্যানিমিয়া ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
লক্ষণসমূহ
• চরম ক্লান্তি, দুর্বলতা
• মাথা ঘোরা, অজ্ঞান হওয়ার অনুভূতি
• ত্বক ফ্যাকাশে হওয়া
• বারবার ঠান্ডা লাগা
• চুল পড়া, ভঙ্গুর নখ
• জিহ্বায় জ্বালা
• বরফ/মাটি খাওয়ার অস্বাভাবিক আকর্ষণ (Pica)
নারীরা বছরে মাসিকের কারণে ৩০-৪০ মিলিগ্রাম আয়রন হারায়, যা সাধারণ খাবার থেকে পূরণ করা কঠিন। ফলে ব্ল্যাকস্ট্র্যাপ মোলাসেস হতে পারে একটি কার্যকর পথ্য।
আয়রনের ঘাটতি পূরণে কতটা কার্যকর?
চিনির উৎপাদনের বাইপ্রোডাক্ট হলেও এটি অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ। এতে আয়রন ছাড়াও সালফার, কপার, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও প্রাকৃতিক শর্করা রয়েছে, যা আয়রন শোষণে সাহায্য করে।
আয়রন পরিমাণ
• প্রতি ১ টেবিল চামচ (২০ গ্রাম) মোলাসেসে থাকে ৩.৫-৫ মিলিগ্রাম আয়রন
নারীদের দৈনিক চাহিদার ২০-৩৫ শতাংশ
শোষণক্ষমতা
প্ল্যান্টভিত্তিক আয়রন হলেও শোষণ হার উঁচু (৮৫%)। ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি শিশু ও নারীদের আয়রন–ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট কার্যকর—কখনো কখনো সাপ্লিমেন্টের সমতুল্য।
উপকারিতা
অ্যানিমিয়া ও রক্ত উৎপাদনে সহায়তা
৪-৬ সপ্তাহ নিয়মিত সেবনে হিমোগ্লোবিন ১-২ g/dl পর্যন্ত বাড়তে দেখা গেছে।
মাসিক সমস্যা ও ব্যথা কমায়।
আয়রন ও ম্যাগনেশিয়াম পিরিয়ডের ক্র্যাম্প, ক্লান্তি এবং ভারী স্রাব কমায়।
হাড় মজবুত করে
ক্যালসিয়াম-ম্যাগনেশিয়ামের সঙ্গে নিলে হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সহায়ক।
চুল পড়া কমায়, অকাল পাকা প্রতিরোধ করে।
কপার ও আয়রন চুলে প্রাকৃতিক রং ও স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
ম্যাগনেশিয়াম একটি প্রাকৃতিক ল্যাক্সেটিভ—সকালে গরম পানিতে মিশিয়ে খেলে উপকার মেলে।
ঘুম ভালো করে, মানসিক চাপ কমায়
ম্যাগনেশিয়াম ও ভিটামিন বি৬ স্নায়ু শান্ত করে ঘুম বাড়াতে সহায়তা করে।
ডায়াবেটিসে উপকারী
গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম (৫৫); ক্রোমিয়াম ইনসুলিন সেন্সিটিভিটি উন্নত করতে পারে।
গ্যাস-অম্লতা ও আলসার কমায়
পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম অ্যাসিডিটি নিয়ন্ত্রণে রাখে।
জয়েন্ট ব্যথায় উপকার
হাড়-জয়েন্ট শক্তিশালী করে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
ত্বক ভালো রাখে
অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ব্রণ, একজিমা কমাতে সহায়ক।
কীভাবে খাবেন?
দৈনিক ১-২ চা–চামচ
• গরম পানি বা দুধে মিশিয়ে
• ভিটামিন সি (লেবু বা কমলা) যোগ করলে আয়রন শোষণ বাড়ে
সতর্কতা
• অতিরিক্ত খেলে ডায়রিয়া বা পেট খারাপ হতে পারে।
• ডায়াবেটিস বা গর্ভবতী হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
• এটি চিকিৎসার বিকল্প নয়—চিকিৎসার অংশ হিসেবে গ্রহণ করুন।
উপসংহার
ব্ল্যাকস্ট্র্যাপ মোলাসেস একটি সাশ্রয়ী, প্রাকৃতিক ও সহজলভ্য আয়রনের উৎস। নিয়মিত সঠিকভাবে গ্রহণ করলে নারীদের অ্যানিমিয়া, ক্লান্তি, মাসিক সমস্যা থেকে হাড়-চুল-ত্বকের স্বাস্থ্য পর্যন্ত বিস্তৃত উপকার দিতে পারে। তবে শুরু করার আগে রক্ত পরীক্ষা করা ও প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।