11/06/2025
"তোমার চোখে লেখা গল্প"
রোদেলা বিকেল। ঢাকা শহরের এক ব্যস্ত ক্যাফে। জানালার পাশে বসে আছে আরিফ, হাতের কাপে শেষ চুমুক দিচ্ছে। তার চোখে এক ধরনের উদাসীনতা, যেন কিছু একটা হারিয়েছে বহুদিন আগে।
"হ্যালো, এক্সকিউজ মি... এখানে কি বসা যাবে?"
আশ্চর্যভাবে চমকে উঠে আরিফ। কণ্ঠটা যেন অনেক পরিচিত, অনেক পুরনো। মাথা ঘুরিয়ে দেখলো—সে, মায়া!
ছোটবেলার প্রেম। সেই স্কুল জীবন, প্রথম চিঠি, প্রথম হাত ধরা। তারপর দূরত্ব, সময়ের ব্যবধান, পরিবারের সিদ্ধান্ত—সব কিছু টেনে নিয়ে গিয়েছিল দু’জনকে আলাদা পথে।
"তুই? মায়া?" বিস্ময়ে ভরা কণ্ঠে বলে উঠল আরিফ।
"হ্যাঁ, আমি। বিশ্বাস করতে পারছি না তো?" মায়ার মুখে এক চিলতে হাসি।
দুইজনই বসে পড়ে। কিছু সময় চুপচাপ। চারপাশের কোলাহল যেন থেমে গেছে। শুধু দু’জনের মাঝেই শব্দহীন কথোপকথন চলতে থাকে।
আরিফ কফির কাপে চোখ রাখে। মায়া বলে, "এত বছর পর তোর সাথে দেখা... কিছুটা স্বপ্নের মতো লাগছে।"
"আমিও বিশ্বাস করতে পারছি না," আরিফ বলে। "শেষবার তো তোকে দেখেছিলাম ইউনিভার্সিটির ওরিয়েন্টেশনের দিন। তারপর তুই চলে গেলি চট্টগ্রামে, আর আমি রয়ে গেলাম ঢাকায়।"
"হ্যাঁ, জীবনের প্ল্যান অনেক সময় আমাদের ইচ্ছের বিপরীত পথে চলে যায়।"
"তুই কি এখন ঢাকায় থাকিস?" আরিফ প্রশ্ন করে।
"হ্যাঁ, চাকরির কারণে। একটা এনজিওতে কাজ করি। সমাজকল্যাণ প্রকল্পে।"
আরিফ মুচকি হাসে। "সবসময় জানতাম, তুই কিছু একটা ভালো করবি। তোকে যারা চিনে, তারা জানে তুই কতটা নিবেদিত।"
"তুই?" মায়ার চোখে কৌতূহল।
"একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করি। নিজের একটা ছোট টিম আছে। জীবন কেটে যাচ্ছে… তবে মনে হয় কিছু একটা অপূর্ণ থেকে গেছে।"
"কী অপূর্ণ?" মায়া জিজ্ঞেস করে, চোখে এক ধরনের কোমল স্পর্শ।
আরিফ চোখ সরিয়ে নেয়, যেন বলতে চায়, "তুই…"
মায়াও বুঝে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "আমিও অনেকবার ভেবেছি… যদি সময়টাকে ফিরিয়ে নেওয়া যেত…"
"কিন্তু সময় কখনো ফিরে আসে না।" আরিফের গলায় ভারী একটা আক্ষেপ।
"হয়তো না, কিন্তু মানুষ তো ফিরে আসে… দেখা হয়, যেমন আজ হলো।"
দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য চুপ থাকে।
"তোর কি কেউ আছে?" মায়া প্রশ্ন করে, একটু দ্বিধায়।
"ছিল… তবে ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্ক টিকে না। আর তোর?"
মায়া মাথা নাড়ে। "একবার বিয়ের কথা উঠেছিল… কিন্তু মন সায় দেয়নি। মনে হয়েছিল, কিছু একটা কোথাও রয়ে গেছে।"
আরিফের চোখে জল চিকচিক করে উঠে। "তাহলে তো দু’জনেই একই ট্রেনে উঠেছি, শুধু গন্তব্যটা আলাদা হয়ে গিয়েছিল।"
"তাহলে কি আবার শুরু করা যায়?" মায়া হঠাৎ করে বলে ফেলে।
আরিফ তাকিয়ে থাকে। এত বছর পরে এই প্রশ্ন… কিন্তু উত্তরটা সে জানে।
"চেষ্টা করলে হয়তো পারি… কিন্তু সময়টা এখন অনেক পরিণত। আমরা এখন বুঝি, সম্পর্ক মানে শুধু আবেগ নয়—দায়িত্ব, বোঝাপড়া, সঙ্গ দেওয়া…"
মায়া বলে, "আমি এসব জানি, এবং আমি জানি, যদি কেউ পারে আমার সঙ্গে এগিয়ে যেতে, সেটা তুই।"
আরিফ হাত বাড়িয়ে দেয়, মায়ার হাত নিজের হাতে নেয়। "তাহলে শুরু হোক—নতুন করে, পুরোনো ভালোবাসা দিয়ে…"
বিকেলের রোদ সোনালি হয়ে জানালার কাঁচে পড়ে। বাইরে ট্রাফিক, ভিড়, ব্যস্ততা—কিন্তু দুইটা হৃদয়ের ভেতর চলছে নতুন গল্পের সূচনা।