26/10/2025
উনি ইরিউসিক এসিড থাকায় সরিষার তেলকে ক্ষতিকর বলে, কিন্তু তাহলে মানুষ কোন তেল খাবে জিজ্ঞেস করলে আর উনার সদুত্তর পাওয়া যায় না!
ইরিউসিক এসিড কোনো বি/ষ নয়। এটি একটি প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জ মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড। এটি প্রধানত পাওয়া যায় সরিষা, রেপসিড, ওয়ালফ্লাওয়ার ইত্যাদি বীজের তেলে। মানুষের স্বাভাবিক খাদ্যাভাসে এর কোনো প্রমাণিত ক্ষতি নেই।
তাই কেউ এভাবে শুধু ইঁদুরের ওপর করা গবেষণার ভিত্তিতে সরিষার তেলকে ক্ষতিকর বলে প্রচার করাটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চক্রান্ত হতে পারে!
'ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস' এর একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে- খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ সালে সিন্ধু সভ্যতার যুগেই উপমহাদেশে সরিষার তেল ব্যবহার করা হতো। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলা ও পাঞ্জাবে সরিষার তেল ছিল অন্যতম প্রধান রান্নার তেল। অর্থাৎ, বাঙালি হাজার বছর ধরে কঞ্জিউম করে আসছে দেশি সরিষার তেল! এখন সরিষার তেলের যেসব ক্ষতির কথা প্রচার করা হয় তখন কি এসব ক্ষতি ছিল?
এমনিতেই সরিষার তেলের দাম লিটারে ৪০/৫০ টাকা বেশি হবার কারণে মানুষ কিনতে চায়না। তার উপর এসব প্রপাগাণ্ডা ছড়ালে মানুষ কিনবেই না। এদিকে দেশের কোটি কোটি মানুষ তো আর তেল ছাড়া রান্না করবে না।
মানুষে কইবো– "ধুর বাল! সরিষার তেলরে নিরাপদ মনে করসিলাম এইটাও দেখি ক্ষতিকর, আবার দামও বেশি। সবকিছুই ক্ষতিকর। এখন তেল তো খাইতেই হইবো, তাইলে কম দামে সয়াবিনই খামু।"
মানুষ তো আর ফুড-ফার্মা কমপ্লেক্স এর ইনভেস্টমেন্ট সাইকেল বুঝে না! মানুষ বুঝে একটু ৫০/১০০ টাকা খরচ বাঁচে কোথায়!
আর এভাবেই ফাঁদে পড়ে জনগণ।
এদেশে শুধু গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের বাজারই বছরে ২০,০০০ কোটি টাকার!
কঞ্জিউমার ক্যাপিটালিজম মানুষকে প্রথমে সস্তা খাবারে অসুস্থ করে, তারপর অসুস্থতা থেকে প্রফিট জেনারেট করে!
লোকাল জায়ান্ট প্রাণ, স্কয়ার, আকিজ গ্রুপগুলো ফুড, ফার্মা ও হাসপাতালে সমান্তরালভাবে বিনিয়োগ করে। অর্থাৎ একই কর্পোরেট গ্রুপ একইসাথে ফুড, ফার্মা, হাসপাতালে বিনিয়োগ করছে!
বাংলাদেশ বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ভোজ্য তেল আমদানি করে! যার অধিকাংশই পাম ও সয়াবিন তেল। আম্রিকা এদেশে আরো বেশি সয়াবিন আমদানি বাড়ানোর জন্য অপচেষ্টা করতেছে। অথচ দেশে এখনো কৃষকদের দেশি তৈলবীজ উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত করা হচ্ছে না। তিল, সরিষা, চিনাবাদামের চাষ কমে যাচ্ছে। ফলে ভোজ্যতেল আমদানি বাড়ছেই। দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বেরিয়ে যাচ্ছে আর আমরা পাচ্ছি অস্বাস্থ্যকর রিফাইন্ড তেল!
আবার, দেশ যখন পাম বা সয়াবিন তেল আমদানি করে তখন আমরা শুধু তেল পাই, খৈল পাই না!
ঘানি ও এক্সপেলার নির্ভর স্থানীয় উৎপাদনে সবরকম তৈলবীজ থেকে গড়ে ৩০% তেল হয় ধরে নিলে বাকি ৭০% যা পড়ে থাকে তা খৈল। এই খৈল অত্যন্ত হাই প্রোটিন এবং বিভিন্ন ভিটামিন সমৃদ্ধ, যা এতকাল পশুখাদ্য হিসাবে ব্যবহার হয়ে এসেছে।
প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন মেট্রিক টন ভোজ্যতেল আমদানি হচ্ছে! এই পরিমান তেল দেশে উৎপাদিত হলে আমরা মিলিয়ন মিলিয়ন মেট্রিক টন খৈলও পেতাম, আমাদের গবাদি পশু, পোল্ট্রি, ডেইরি আরো সস্তায় প্রোটিন সমৃদ্ধ ফিড পেত, আমরাও কম দামে ডিম, মাছ, মাংস, দুধ ইত্যাদি প্রোটিন পেতাম!
দিনশেষে জনগণ তেল কঞ্জিউম করবেই। কাজেই দেশি সরিষার তেল যে বিদেশি রিফাইন্ড তেলের চেয়ে উত্তম এটা সবাইকে বুঝাতে হবে। (আর কেউ যদি উল্টা ভুংচুং বুঝায় তাহলে অবশ্যই ডালমে কুচ কালা হে!)
সরিষার তেলের কঞ্জাম্পশন বাড়লে দেশের স্থানীয় অর্থনীতি স্বনির্ভর হতে শুরু করবে, কৃষক লাভবান হবে, শতশত অয়েল মিলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, ফরেন কারেন্সির রিজার্ভ বাড়বে, দেশের মানুষ অসুস্থ কম হবে।
সয়বিন, সানফ্লাওয়ার, সাফফ্লাওয়ার, কর্ন, কটনসিড, রাইসব্র্যান ইত্যাদি তেলে ওমেগা-৩ এর চেয়ে ওমেগা-৬ এর পরিমান অনেক অনেক বেশী থাকে। ওমেগা-৬ ৪০-৭০% পর্যন্ত থাকে। রিফাইন করলে আবার ওমেগা-৬ আরো বেড়ে যায় + ওমেগা-৩ অল্প যা ছিল তা নষ্ট হয়ে যায়! এসব তেলের মধ্যে ফ্যাটি এসিডগুলোর ভারসাম্য থাকে না।
এসব তেল খেলে দেহে বিরামহীন ইনফ্লামেশন হতে থাকে!
যেসব কারণে মানুষের গড় আয়ু কমে যায়, নানা রকম ক্রনিক রোগ দেখা দেয় তার মধ্যে ইনফ্লামেশন অন্যতম! ইনফ্লামেশন বেশী হয়ে গেলে কোষ পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না, তাতে শরীরের শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। ইনফ্লামেশন দূর করার চেষ্টা করতে গিয়ে আমাদের দেহ কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি ব্যয় করে ফেলে। ফলে দেহের অনেক জরুরী কাজে পুষ্টিগুলোর ঘাটতি দেখা দেয়, এদের মধ্যে ভিটামিন ডি, সি অন্যতম।
একবার সয়বিন বা উচ্চ ওমেগা ৬ যুক্ত খাবার খেলে সেটা কয়েক ঘন্টার মধ্যে দেহকোষের অংশ হয়ে যায়। কিন্তু এটা দেহ থেকে দূর হতে পুরো ২ বছর সময় লাগে! অর্থাৎ একবেলা খেয়ে পুরো ২ বছরের জন্য ইনফ্লামেশন সঙ্গী করে নিলাম! আর বছরের পর বছর, ১০/২০ বছর ধরে খেলে কি অবস্থা হবে? শরীরে বেশ বড় একটা অংশের কোষঝিল্লি ক্রমাগত ইনফ্লামেশনের উৎস হয়ে ফ্যাট বার্ণে বাঁধা দিবে, পুষ্টি ঘাটতি ঘটাবে। যার ফলাফল নিশ্চিতভাবে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, স্থুলতা, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, কিডনি নষ্ট, গাট সমস্যা, ঘন ঘন ইনফেকশন, অস্টিওপোরেসিস, আলঝাইমার, ডিমেনশিয়া, এ্যালার্জি, সোরিয়াসিস, একজিমা, এ্যাজমা সহ এমন কোন রোগ নেই হবে না!
বিদেশি তেলের এতো এতো সমস্যার মধ্যে দেশি সরিষার তেলের দুই-একটা তথাকথিত ও অপ্রমানিত সমস্যা আসলে কিছুই না!
আর যদি কারো সরিষার তেলে সমস্যা মনেই হয়, তাহলে তার উচিত ঘি, পশু চর্বি, তিল, তিসি, এ্যাভোকাডো, নারকেল, অলিভ ইত্যাদি তেল ব্যবহার করা।
ক্যাপ্টেন গ্রিন