02/09/2024
বান
লেখায়: @শিশির সেন
কেমন একটা ভেজা আর সোঁদা গন্ধ পেয়ে আকবর আলীর ঘুম ভেঙে গেল। গন্ধটা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ঘুম ভাঙতেই আকবর আলী তড়িঘড়ি করে খাড়া বিছানা থেকে নামতে গেলেন। মাটিতে পা ফেলতেই তাঁর পা গোড়ালি পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেল। ছলাৎ করে উঠলো ঠান্ডা জলের শব্দ৷ আকবর আলী বুঝতে পারলেন পানি বাড়তে বাড়তে এক রাতেই ঘরের মেঝে সমান পানি উঠে গেছে।
চাটির বেড়ার ফাঁক দিয়ে আকবর আলী দেখতে পেলেন ভোরের আলো স্পষ্ট হচ্ছে। ফজরের নামাজের সময় পার হয়ে গেছে হয়তো। মসজিদে পানি উঠায় মুয়াজ্জিন নিশ্চয়ই আজান দিতে পারেনি।
প্রায় সম্পূর্ণ অন্ধকার ঘরে বেড়ার ফাঁক দিয়ে সামান্য আলো এসে এক জায়গায় জড়ো হচ্ছে। সেই জমায়েত আলো গিয়ে পড়ছে দেয়ালে টাঙানো আকবর আলীর স্ত্রীর ছবির কাঁচের ফ্রেমটায়। আট বছর আগে এমন এক শ্রাবণের দিনে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল।
আকবর আলী আবছা অন্ধকারে বালিশের পাশে বিড়ির প্যাকেটটা খোঁজার জন্য হাতড়াতে লাগলেন। অল্প সময়ের মধ্যে লাইটার আর বিড়ির প্যাকেটটা পেয়েও গেলেন৷ অন্ধকারে হাত দিয়ে অনুমান করলেন মাত্র তিনটা বিড়ি আছে৷ একটা বিড়ি ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে একগাল ধোঁয়া ছাড়লেন।
"আব্বা, আব্বা।" হোসাইন এর চওড়া গলা। "আব্বা ঘরের মইধ্যে পানি ঢুকছে৷"
আকবর আলী তাঁর বড় ছেলের গলার আওয়াজ শুনতে পেলেন। কিন্তু উত্তরে কিছুই বললেন না। বিড়ি টানতে টানতে নীরবে তাঁর স্ত্রীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
আব্বার কোন সাড়া না পেয়ে হোসাইন আরো উচ্চ স্বরে ছোট ভাইকে ডাকতে লাগল, "হালিম। তাত্তাড়ি উইঠা আয়। ঘরের মধ্যে পানি ঢুইকা পড়ছে। ওই হালিমের বাচ্চা৷"
হোসাইন এর বিরামহীন উচ্চস্বর, "আব্বা উঠেন। পানি বাইরতে আছে।"
বড় ভাইয়ের ডাক শুনে হালিম চমকে উঠেছে৷ গোরুর ঘরে তার বিছানা। সোলার এর বাতি জ্বালিয়ে দেখতে পেল ঘরের মেঝেতে পানি। গোরুগুলো ডাকতেই আছে অবিরাম৷ সাথে ছাগলছানাগুলোর ছোটাছুটি। হালিম দ্রুত বিছানা থেকে নামে বাইরে আসল।
অন্ধকার দুরি ভূত হয়ে ভোরের আলোর তীব্রতা বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। বাড়ির আঙিনায় কোমর সমান পানি। আকবর আলীর কোন সাড়া না পেয়ে হোসাইন তার বাবার ঘরের দিকে গেল পানি ঠেলে। আলগা দরজা সামান্য ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।
আকবর আলী তখন হাতের বিড়িটা প্রায় শেষ করেছেন। হোসাইন কে আসতে দেখে লম্বা একটা টান দিয়ে বিড়ির বাকি অংশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, "হোছাইন, পানি বাইড়তে থাকবো। কঠিন বান আসতাছে৷ যেহারে পানি বাড়তাছে, অবস্থা খুব খারাপ হইবো।"
"হ আব্বা৷ এক রাইতেই পানি বাইড়া ঘরে ঢুইকা পড়ছে।" হোসাইন এর ভয়ার্ত গলা।
ঘরের মধ্যেও অন্ধকার কেটে গেছে অনেকটা। ফর্সা হতে শুরু করছে ঘরের ভিতরটা৷ আকবর আলী সময় নিয়ে আরেকটা বিড়ি ধরালেন। তারপর একগাল ধোঁয়া ছেড়ে হোসাইন কে উদ্দেশ্য করে বললেন, "হোছাইন, তুই তাত্তাড়ি ঘাটে যা৷ নৌকা টা নিয়া আয়৷" কিছুক্ষণ থেমে বিড়ির আরেকটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, "আর হালিম উঠেনাই? ওরে ক গোরুগুলারে ছাইড়া দিতে৷ ছাগলগুলারে নৌকায় নেওয়া যাইবো।"
"হ আব্বা।" হোসাইন ঘর থেকে বের হতে যাবে এমন সময়ে আকবর আলী আবার থামিয়ে দিয়ে বললেন, "বৌমারে কইস সবসময় আইরিনরে চোক্ষে চোক্ষে রাইখতে৷ যা পানি বাড়তাছে!" এমন সময় মনে মনে কি একটা দৃশ্য ভেবে আকবর আলীর শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠল।
হোসাইন আর না থেমে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে গেল। বের হতেই দেখে বারান্দায় হালিম আঙিনার দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
"হালিম, গোরুগুলারে ছাইড়া দে যা। আমি ঘাটে যাইয়া নৌকাটা নিয়া আহি। ছাগলগুলারে নৌকায় তুলতে হইবো। আর দরকারি কি আছে সব পলিথিনে বাঁইধা রাইখা দে। তোর বইখাতাগুলা ভালো কইরা বাঁন্ধিস।"
হালিম নিরস কণ্ঠে বলল, "আচ্ছা ভাইজান।"
হোসাইন এক মুহূর্ত থেমে আবার বলল, "আর তোর ভাবি আর আইরিনরে দেইখা রাখিস।"
কথা শেষ করে হোসাইন বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে৷ তাদের বাড়ি থেকে নদী হেঁটে হেঁটে প্রায় দশ মিনিটের রাস্তা। কিন্তু যে পরিমাণে পানি বেড়েছে, হোসাইন বুঝতে পারল সাঁতরে ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। পড়নের লুঙ্গিটা তাই সে ভালো করে বেঁধে সাঁতরে নদীর রাস্তা ধরলো।
রোকেয়া তখন থেকে শুকনা খাবারগুলো পলিথিনে বেঁধে রাখছে৷ দুটো পলিথিনে কেজি পাঁচেক মুড়ি আর একটা পলিথিনে দুই কেজি চিড়া বেঁধে রেখেছে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, পরিস্কার পানি নিতে সে একদম ভুলে গেছে। টিউবওয়েল টাও ডুবে গেছে। মনে মনে কিছুটা ভয় জমাট বাঁধলো তার মনে। সে জানে, বন্যার সময় পরিস্কার পানির অভাব কতটা! আর আইরিনের বাবা জানলে যে গালাগালি করবে এও সে বুঝতে পারছে।
তাদের ঘরটা সামান্য নিচু৷ তাই হাঁটু সমান পানি উঠে গেছে ইতোমধ্যে। আর এক ফুট পানি উঠলে বিছানা ডুবে যাবে। বিছানায় চার বছরের আইরিন চুপ করে দেখে আছে পানির ক্ষীণ স্রোতের দিকে। তার চোখেমুখে একরাশ বিস্ময় আর সাথে বেশখানিকটা ভয় ফুটে উঠেছে। সে একবার পানির দিকে আরেকবার তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। রোকেয়া কাজের ফাঁকে প্রতি মুহূর্তে মেয়ে আইরিনের দিকে তাকিয়ে অভয়ের ইশারা দিচ্ছে।
হালিম দ্রুতগতিতে গোয়ালঘরে গিয়ে একে একে তিনটা গোরুর দড়িগুলো খুলে দিল। একটা লাঠি নিয়ে ঘরথেকে বের করে দিল গোরু তিনটিকে। তারপর ছাগলগুলো নিজের বিছানার উপর তুলে রাখল এক এক করে। হালিম এতো কঠিন সময়ের মুখোমুখি আগে হয়নি। তার মনে আছে, এর আগের বার যখন বন্যা হলো তখন সে স্কুলে ভর্তি হয়েছে কেবল। এখন সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আট বছর আগে সে বন্যায় তাদের নদীর ধারের ঘরটা ভেঙে নদীতে ভেসে গিয়েছিল। সে সময়কার তার অসুস্থ মায়ের ঘোলাটে একটা অবয়ব হালিমের মাথায় ঘুরে সবসময়। সে সময়েই সে অনুভব করেছিল, বন্যা জিনিসটা বড্ড কঠিন।
আকবর আলী বিড়িটা লম্বা সময় ধরে শেষ করে ঘর থেকে বের হলেন। ঘরে ততোক্ষণে হাঁটু সমান পানি উঠে গেছে। আঙিনায় কোমর সমান হবে। এখন বৃষ্টি হচ্ছেনা। তবে মেঘে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ। আকবর আলী অনুমান করতে পারলেন, কি হতে চলেছে।
আকবর আলী কোমরে লুঙ্গিটা ভালো করে বেঁধে নিলেন। বিড়ির প্যাকেটটা আর লাইটার কোমরে গুঁজে নিলেন শক্ত করে। গোরুগুলো গেটের উঁচু জায়গাটায় ফ্যাকাসে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকবর আলী একটা লাঠি নিয়ে গোরু তিনটিকে স্কুল ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পানি ঠেলে বের হয়ে গেলেন।
হোসাইন নৌকা নিয়ে এলো প্রায় ঘন্টাখানেক পর৷ ততোক্ষণে পানি বেড়েছে আরো কয়েক ফুট। বৃষ্টিও পড়ছে মুষলধারে। প্রথমে সে নৌকাটা বারান্দার একটা বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে নিজের ঘরে ঢুকলো।
রোকেয়া আইরিনকে কোলে নিয়ে তখন বিছানার উপর দাঁড়িয়ে কাপড়চোপড় গুলো গুছিয়ে একটা ব্যাগে ঢুকাচ্ছে। এর মধ্যে হালিম বেশ কয়েকবার এসে তাদের খবর নিয়ে গেছে।
"আব্বা, আব্বা।" আইরিনের তীক্ষ্ণ গলার স্বর শুনে রোকেয়া তাকাল তার স্বামীর দিকে।
হোসাইন ভিজে শরীর নিয়ে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভারী কণ্ঠে বলল, "রোকেয়া, নৌকা নিয়া আইছি। তুই আইরিনরে নিয়া নৌকায় উঠ। আমি বস্তাগুলারে তুইলা দিচ্ছি নৌকায়৷"
"আমি নিয়া যাচ্ছি বস্তাগুলারে৷ আপনে হালিমরে সাহায্য করেন। ছেলেটা একা একা তখন থেইকা যে কি করতাছে।"
হোসাইন এবার কিছুটা রাগী স্বরে বলে উঠল, "তুই আইরিনরে নিয়া নৌকায় উঠ কইছি নাহ৷ আমি দেখতাছি এইদিক।"
রোকেয়া আর কথা বাড়াল না৷ আইরিনকে কোলে নিয়ে নৌকায় গিয়ে বসল।
হালিম বইয়ের বস্তাটা নৌকার একদিকে এনে রেখেছে। তারপর এক এক করে ছাগল ছানা গুলো নৌকার আরেকদিকে তুলছে। ছেলেটা ভীষণ ব্যস্ত।
হোসাইন ওদিকের সব কাজ শেষ করে হালিমকে সাহায্য করলো সব ঠিকমতো করতে। বৃষ্টি যেন ক্রমেই বাড়ছে। সাথে তাল মিলিয়ে পানিও বাড়ছে ইঞ্চি হারে৷
মাঝারি আকারের নৌকাটা ভর্তি হয়ে গেছে দরকারি সব জিনিসপত্র দিয়ে। বাড়ি থেকে স্কুলঘরটার দূরত্ব এক কিমির বেশি হবে। বৃষ্টি এখন থেমেছে। মেঘের আড়াল থেকে সূর্যটা একমুহূর্তের জন্য পূব আকাশে দেখা মিলে। পরক্ষণেই আবার হারিয়ে যায় কালো দৈত্যের মতো মেঘের ওপাশে।
আকবর আলী ফিরেছেন কিছুক্ষণ আগে। বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকার একপাশে বসেছেন তিনি। মাঝখানে রোকেয়া আইরিনকে কোলে নিয়ে বসে আছে, আর হালিম ছাগলছানাগুলো দেখে রাখছে। হোসাইন নৌকাটা বের করতে তখন ব্যস্ত। নৌকায় উঠেনি সে তখনো।
এমন সময়ে আকবর আলী হঠাৎ বলে উঠলেম, "হোছাইন দাঁড়া। একখান জিনিস নিবার ভুইলা গেছি। নিয়া আহি।" কথা শেষ করেই আকবর আলী পানিতে নেমে পড়লেন।
আঙিনায় এতোক্ষণে মাথা সমান পানি উঠে গেছে। সাঁতরে ছাড়া ঘরের দিকে যাওয়া যায়না। আকবর আলী সাঁতারে ভীষণ পটু৷ খুব তাড়াতাড়িই বারান্দায় পৌঁছে গেলেন সাঁতরে।
নিজের ঘরে ঢুকে সরাসরি তাঁর স্ত্রীর ছবিটার দিকে তাকালেন। এখনো তাতে পানি স্পর্শ করেনি। আকবর আলীর আট বছর আগে সে দিনটার কথা খুব মনে পড়ছে। সেবারও হঠাৎ করে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো। পানি বাড়তে বাড়তে কয়েক ঘন্টায় বাড়িঘর সব ডুবে যেতে শুরু করলো। ঘরের মধ্যে অসুস্থ স্ত্রী। আকবর আলীর নিজের কোন নৌকা নেই তখন। চারদিকে নৌকার অনেক খোঁজ করলেন। কিন্তু পেলেন না কোন নৌকা। আর দুই একটা নৌকা পেলেও যে পরিমাণ দাম হাঁকাল, তা দেবার সামর্থ নেই আকবর আলীর। হোসাইন তখন শহরে থাকে। শেষে সন্ধ্যার সময় যখন ঘরে গেলেন, আকবর আলী দেখে ঘরের মধ্যে প্রায় বিছানা সমান পানি। বিছানায় তাঁর অসুস্থ স্ত্রী আর ছয় বছরের হালিম। অসুস্থ শরীরে তাঁর স্ত্রীর হাঁটতে খুবই কষ্ট হয়। পানির মধ্যে তা অসম্ভবই প্রায়৷ আকবর আলী প্রথমে ছেলে আর স্ত্রীকে একসাথে আশ্রয়কেন্দ্রের ওই স্কুলঘরটায় নিয়ে যেতে চাইলেও পারলেন না। পরে স্ত্রীর অনুরোধে প্রথমে ছেলেকে রাখতে গেলেন। তারপর মিনিট বিশেক পর যখন ছেলেকে পৌঁছে দিয়ে স্ত্রীকে নিতে গেলেন, তখন বুঝতে পারলেন পানি খুব বেশি পরিমাণে বাড়ছে। কোথা থেকে এক খবর ভেসে আসলো যে কোন বাঁধ নাকি ভেঙে গেছে। পানি কয়েক মিনিটে কয়েক ফুট বেড়ে গেল। পানির স্রোত যেন রাক্ষসীর চুলের ভয়ার্ত রূপে বইতে লাগল। সেই স্রোত ঠেলে তিনি যখন বাড়ির কাছে গেলেন প্রায় আধা ঘন্টা পর, কুঠেঘরটা তখন নেই। পানির তীব্র স্রোতে নড়বড়ে ঘরটা ভেসে গেছে। কত খোঁজাখুঁজি করলেন তিনি তাঁর স্ত্রীকে, কিন্তু পেলেন না। আকবর আলী হারিয়ে ফেললেন চিরতরে স্ত্রীকে।
আকবর আলী তাঁর স্ত্রীর ছবিটা নিয়ে নৌকায় ফিরে এলেন আবার। নৌকায় উঠে একদিকে ছবিটা ঠিকমতো রেখে কোমর থেকে লুঙ্গির ভাজ খুলে বিড়ির প্যাকেটটা বের করলেন। পলিথিনে মোড়া ছিল বলে তা ভিজেনি। বিড়িটা ধরিয়ে একগাল ধোঁয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে ছাড়লেন তিনি। তারপর তিনি তাঁর স্ত্রীর ছবিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। এক বন্যায় তিনি স্ত্রীকে পানির অতলে হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি আরেকবার হারাতে চান না।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। বিড়িটা নিভে যায়নি এখনো। আকবর আলী বৃষ্টির মধ্যে ধোঁয়া উড়িয়ে নৌকার বৈঠা বইতে লাগলেন।
-- বান
লেখায়: শিশির সেন