02/11/2025
মায়ের দুধের পরিমাণ বাড়াতে করণীয়:
আপনার সোনামণির জন্য সেরা পুষ্টি নিশ্চিত করুন!
বুকের দুধ উৎপাদন একটি জটিল কিন্তু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা মূলত হরমোন এবং চাহিদা ও যোগানের ওপর নির্ভর করে।
অর্থাৎ, স্তন থেকে যত বেশি দুধ বের হবে, তত বেশি দুধ তৈরি হবে। সঠিক কৌশল এবং যত্নের মাধ্যমে বেশিরভাগ মা-ই পর্যাপ্ত দুধ উৎপাদন করতে পারেন।
চলুন জেনে নিই, মায়ের দুধের পরিমাণ বাড়াতে কী কী করা উচিত।
মায়ের বুকের দুধ বাড়াতে কার্যকরী উপায়সমূহ:
>> ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়ান:
- হরমোন উদ্দীপনা: এটি বুকের দুধ বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায়। শিশু যত বেশি এবং ঘন ঘন স্তন চুষবে, মায়ের শরীর থেকে প্রোলাক্টিন হরমোন তত বেশি নিঃসৃত হবে, যা সরাসরি দুধ উৎপাদন বাড়াবে।
- চাহিদা অনুযায়ী খাওয়ানো: নবজাতককে নির্দিষ্ট সময় অন্তর না খাইয়ে, যখনই সে ক্ষুধার লক্ষণ দেখাবে (যেমন – মুখ নড়াচড়া করা, হাত চুষা, স্তনের দিকে মুখ ঘোরানো), তখনই দুধ খাওয়ান। দিনে অন্তত ৮-১২ বার দুধ খাওয়ানো উচিত।
- রাতে খাওয়ানো জরুরি: রাতে প্রোলাক্টিন হরমোনের মাত্রা প্রাকৃতিকভাবেই বেশি থাকে, তাই রাতের বেলা দুধ খাওয়ানো দুধের সরবরাহ বাড়াতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
>> সঠিক অ্যাটাচমেন্ট ও পজিশন নিশ্চিত করুন:
- কার্যকরী দুধ গ্রহণ: শিশু যদি সঠিকভাবে স্তনের সাথে সংযুক্ত না হয় (সঠিক অ্যাটাচমেন্ট), তবে সে পর্যাপ্ত দুধ টানতে পারে না এবং স্তনও ভালোভাবে খালি হয় না। ফলে পর্যাপ্ত উদ্দীপনার অভাবে দুধ উৎপাদন কমে যায়।
- সঠিক অ্যাটাচমেন্টের লক্ষণ: শিশুর মুখ যতটা সম্ভব হাঁ করিয়ে স্তনের বেশিরভাগ অংশ (শুধু বোঁটা নয়, তার আশেপাশের কালো অংশও) মুখে প্রবেশ করান। শিশুর নিচের ঠোঁট বাইরের দিকে বাঁকানো থাকবে এবং চিবুক মায়ের স্তনে লেগে থাকবে।
- সহায়তা নিন: প্রয়োজন হলে একজন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী, ধাত্রী বা ল্যাকটেশন কনসালটেন্টের সাহায্য নিন সঠিক অ্যাটাচমেন্ট ও পজিশন শিখতে।
>> উভয় স্তন থেকে দুধ খাওয়ান:
- প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর সময় উভয় স্তন থেকে দুধ খাওয়ান। একটি স্তন খালি হয়ে গেলে (বা শিশু নিজে ছেড়ে দিলে) অন্য স্তন থেকে খাওয়ান। এতে উভয় স্তনই ভালোভাবে উদ্দীপিত হবে এবং দুধ উৎপাদন বাড়বে।
>> পর্যাপ্ত তরল পান করুন:
- শরীরের হাইড্রেশন: দুধের প্রধান উপাদান পানি। পর্যাপ্ত হাইড্রেশন (শরীরে পর্যাপ্ত পানি থাকা) দুধ উৎপাদনের জন্য খুবই জরুরি। দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
- অন্যান্য তরল: এছাড়াও ফলের রস, স্যুপ, ডাবের পানি, বা হারবাল চা (যেমন – মেথি চা, মৌরি চা) পান করতে পারেন। তবে মিষ্টি পানীয় বা ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন।
>> পুষ্টিকর ও সুষম খাবার গ্রহণ করুন:
- শক্তি ও পুষ্টি: মায়ের সুষম ও পুষ্টিকর খাবার দুধ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ও পুষ্টি যোগায়। আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত প্রোটিন (যেমন – মাছ, মাংস, ডিম, ডাল), জটিল শর্করা (যেমন – ভাত, রুটি, আলু), স্বাস্থ্যকর চর্বি এবং প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ (যেমন – সবুজ শাকসবজি, রঙিন ফলমূল) রাখুন।
- নির্দিষ্ট খাবার নয়: কোনো বিশেষ খাবার (যেমন – লাউ, পেঁপে) দুধ বাড়ায় বলে প্রচলিত থাকলেও, এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। বরং, সামগ্রিক সুষম খাদ্যাভ্যাসই গুরুত্বপূর্ণ।
>> পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন:
- শারীরিক পুনরুদ্ধার ও হরমোন: নতুন মায়ের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম খুবই জরুরি। মায়ের ক্লান্তি দুধ উৎপাদনকারী হরমোন প্রোলাক্টিনের নিঃসরণ কমিয়ে দিতে পারে। যখনই সুযোগ পান, বিশ্রাম নিন বা ঘুমানোর চেষ্টা করুন, এমনকি দিনের বেলাতেও।
>> মানসিক চাপ কমান:
- অক্সিটোসিনের প্রভাব: অতিরিক্ত মানসিক চাপ দুধ উৎপাদনকারী হরমোন অক্সিটোসিনের নিঃসরণে বাধা দিতে পারে, যা দুধ নির্গমনে সমস্যা সৃষ্টি করে। অক্সিটোসিন নিঃসৃত না হলে দুধ স্তন থেকে সহজে বেরিয়ে আসে না।
- চাপমুক্ত থাকুন: যতটা সম্ভব চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নিন, বন্ধুদের সাথে কথা বলুন বা প্রয়োজনে কাউন্সিলিংয়ের সাহায্য নিন। আরামদায়ক কার্যকলাপ (যেমন – হালকা সঙ্গীত শোনা, বই পড়া) মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
>> ব্রেস্ট পাম্প ব্যবহার করুন (প্রয়োজনে):
- অতিরিক্ত উদ্দীপনা: যদি শিশু পর্যাপ্ত দুধ টানতে না পারে বা আপনার দুধের পরিমাণ কম মনে হয়, তাহলে পাম্প ব্যবহার করে স্তন থেকে দুধ বের করুন। এতে স্তন উদ্দীপিত হবে এবং প্রোলাক্টিনের মাত্রা বাড়বে, ফলে দুধ উৎপাদনও বাড়বে।
- নিয়মিত পাম্পিং: দিনে ২-৩ বার পাম্পিং করলে দুধের সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে। কাজের সময়ও পাম্প করে দুধ সংরক্ষণ করতে পারেন। তবে যদি কারো পাম্পিং এর মাধ্যমে দুধ না আসে তবে এটা মনে করবেন না যে বাবু যখন সাক করে তখনও আসে না৷ কারন পাম্পে আবেগ নেই।
>> ত্বকের সাথে ত্বকের সংস্পর্শ (Skin-to-Skin Contact):
- নবজাতককে পোশাক ছাড়া মায়ের বুকে সরাসরি শুইয়ে দিন। এই ত্বকের সাথে ত্বকের সংস্পর্শ মায়ের অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে, যা দুধ নির্গমন (লেট-ডাউন রিফ্লেক্স) এবং দুধ উৎপাদনে সহায়তা করে। এটি মা ও শিশুর বন্ধনকেও দৃঢ় করে।
>> চিকিৎসকের পরামর্শ:
- যদি উপরের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করার পরও দুধের পরিমাণ না বাড়ে বা আপনার কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে, তবে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কিছু ক্ষেত্রে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা (যেমন – থাইরয়েডের সমস্যা), জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল বা অন্য কোনো শারীরিক কারণে দুধ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে, যার জন্য চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
বুকের দুধ উৎপাদনে হরমোনের ভূমিকা:
বুকের দুধ উৎপাদন মূলত দুটি প্রধান হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়:
১. প্রোলাক্টিন (Prolactin): এই হরমোনটি দুধ উৎপাদনের জন্য দায়ী। শিশু যখন স্তন চুষতে শুরু করে, তখন মায়ের শরীর থেকে প্রোলাক্টিন নিঃসৃত হয়। যত বেশি এবং ঘন ঘন স্তন উদ্দীপিত হয়, প্রোলাক্টিনের মাত্রা তত বাড়ে এবং দুধ উৎপাদন তত বেশি হয়।
২. অক্সিটোসিন (Oxytocin): এই হরমোনটি 'লাভ হরমোন' নামেও পরিচিত। অক্সিটোসিন দুধ নির্গমনে (let-down reflex) সাহায্য করে, অর্থাৎ এটি স্তন থেকে দুধ বের করে আনে। মা যখন তার শিশুকে দেখেন, স্পর্শ করেন বা ভালোবাসেন, তখন অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়। মায়ের মানসিক অবস্থা (যেমন – চাপ বা উদ্বেগ) অক্সিটোসিনের নিঃসরণে বাধা দিতে পারে।
বুকের দুধ খাওয়ানো একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা মা ও শিশুর মধ্যে এক গভীর বন্ধন তৈরি করে। ধৈর্য ধরুন এবং নিজের প্রতি আস্থা রাখুন এবং আত্মবিশ্বাসী হোন। সঠিক হরমোন উদ্দীপনা এবং পুষ্টিকর জীবনযাপন আপনার সোনামণির সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।
আপনার বুকের দুধ বাড়ানোর অভিজ্ঞতা কেমন? নিচে মন্তব্য করে আমাদের সাথে আপনার মূল্যবান মতামত ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন।
©পুষ্টিবিদ হেলেনা আক্তার