11/09/2025
প্রাচীন মিশরে মমি তৈরি ছিল একটি জটিল ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, যা মৃতদেহকে অক্ষয় করার লক্ষ্যে করা হতো। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আত্মার পরকালীন যাত্রায় দেহকে সংরক্ষিত রাখা, কারণ মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন যে আত্মা (কা/বা) দেহকে চিনতে পারলেই পুনর্জন্ম লাভ করতে পারবে। নিচে মমি তৈরির বিস্তারিত প্রক্রিয়া ও তথ্য দেওয়া হলো:
১. মমি তৈরির ইতিহাস ও উদ্দেশ্য;
সময়কাল: প্রায় ৩,০০০ বছর ধরে (প্রাক-রাজবংশীয় যুগ, ৩২০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে রোমান যুগ, ৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) চলেছে।
ধর্মীয় বিশ্বাস:
মৃত্যুর পর ওসিরিসের বিচারে দেহ অক্ষত থাকলে আত্মা অমরত্ব লাভ করবে।
দেহের পচন রোধ করা হতো যাতে আত্মা (কা) তার আবাসস্থলকে চিনতে পারে।
২. মমিকরণ প্রক্রিয়া (৭০ দিনের আনুষ্ঠানিকতা)
প্রক্রিয়াটি পেশাদার মমিকরণকারীদের (যারা "অ্যানুবিসের পুরোহিত" নামে পরিচিত ছিলেন) দ্বারা সম্পন্ন হতো:
ধাপ ১: শরীর প্রস্তুতি (দেহ ধোয়া ও মস্তিষ্ক অপসারণ)
ধোয়া: মৃতদেহকে নীল নদের জলে ধুয়ে শুদ্ধ করা হতো।
মস্তিষ্ক অপসারণ:
নাকের মাধ্যমে একটি লোহার হুক ঢুকিয়ে মস্তিষ্ক ভেঙে টুকরো টুকরো করে বের করা হতো।
মস্তিষ্ককে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হতো, তাই এটি সংরক্ষণ করা হতো না।
ধাপ ২: অভ্যন্তরীণ অঙ্গ অপসারণ
পার্শ্বচ্ছেদ: বাম পাজরে একটি ছুরি দিয়ে চিরে ফুসফুস, যকৃত, পাকস্থলী এবং অন্ত্র বের করা হতো।
হৃদয় সংরক্ষণ: হৃদয়কে দেহের মধ্যেই রাখা হতো, কারণ এটিকে বুদ্ধি ও আবেগের কেন্দ্র বলে বিশ্বাস করা হতো।
অঙ্গগুলো সংরক্ষণ: বের করা অঙ্গগুলোকে ন্যাট্রন লবণে শুকিয়ে ক্যানোপিক জার (চারটি বিশেষ পাত্র) এ রাখা হতো। প্রতিটি জারের উপর ছিল চার পুত্র দেবতার (আমসেত, হাপি, দুয়ামুতেফ, কেবেহসেনুফ) মূর্তি।
ধাপ ৩: শুকানো প্রক্রিয়া (ন্যাট্রন লবণ ব্যবহার)
লবণে ঢেকে রাখা: দেহকে ৪০ দিন ধরে ন্যাট্রন লবণে (সোডিয়াম কার্বনেট + বাইকার্বনেট মিশ্রণ) ঢেকে রাখা হতো।
কাজ: লবণ শরীরের সমস্ত আর্দ্রতা শুষে নিত, যার ফলে দেহ সম্পূর্ণ শুকিয়ে যেত।
ফলাফল: দেহের ওজন ৭৫% কমে যেত, ত্বক কালচে বাদামী রঙ ধারণ করত।
ধাপ ৪: ত্বক পুনরুদ্ধার ও সৌন্দর্যায়ন
তেল মাখানো: শুকানোর পর দেহে সুগন্ধি তেল, মোম ও রেজিন মাখানো হতো যাতে ত্বক নমনীয় থাকে।
চোখ ও মুখ সাজানো:
খালি চক্ষুকোটরে পাথর বা কাঁচের চোখ বসানো হতো।
মুখের ভাঁজ এড়াতে ত্বকে রেজিন ইনজেকশন দেওয়া হতো।
কেশ সজ্জা: চুল কাটা বা নকল চুল লাগানো হতো।
ধাপ ৫: পট্টিকে মোড়ানো
লিনেন কাপড় ব্যবহার: দেহকে শত শত মিটার লিনেন কাপড়ে মোড়ানো হতো।
ধর্মীয় প্রতীক: প্রতিটি স্তরের মধ্যে অ্যামিউলেট (তাবিজ) ও ধর্মীয় লিপি রাখা হতো (যেমন "ডেড অফ দ্য ডেড" থেকে উদ্ধৃতি)।
বিশেষ যত্ন: আঙুল ও পায়ের নখ আলাদাভাবে মোড়ানো হতো।
ধাপ ৬: মুখোশ ও সমাধি প্রস্তুতি
স্বর্ণ মুখোশ: মুখে স্বর্ণ বা রঙিন মুখোশ পরানো হতো, যা মৃত ব্যক্তির মুখের হুবহু প্রতিলিপি হতো।
সমাধিস্থ করা: মমিকে তিনটি কফিনের মধ্যে রেখে পিরামিড বা গোরস্থানে সমাধিস্থ করা হতো।
৪. বিভিন্ন শ্রেণীর মমি
রাজকীয় মমি: যেমন তুতানখামেন, রামসেস দ্বিতীয় - স্বর্ণ মুখোশ ও বিলাসবহুল সমাধি।
সাধারণ মানুষের মমি: সরল পদ্ধতিতে তৈরি, কম ব্যয়বহুল।
প্রাণীদের মমি: বিড়াল, কুকুর, কুমির ইত্যাদিকেও মমি করা হতো ধর্মীয় উদ্দেশ্যে।
৫. মমি তৈরির বৈজ্ঞানিক দক্ষতা
অ্যানাটমি জ্ঞান: মমিকরণকারীরা মানবদেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসংস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান রাখতেন।
রসায়ন ব্যবহার: ন্যাট্রন লবণ ও রেজিনের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল।
শল্যচিকিৎসা দক্ষতা: অঙ্গ অপসারণ ও দেহ সেলাই করার কৌশল ছিল অত্যাধুনিক।
৬. আধুনিক গবেষণা ও আবিষ্কার
সিটি স্ক্যান: আধুনিক প্রযুক্তিতে মমির অভ্যন্তরীণ অঙ্গ পরীক্ষা করে জানা গেছে যে, তাদের মধ্যে হৃদরোগ, আর্থ্রাইটিস, প্যারাসাইট ছিল।
ডিএনএ বিশ্লেষণ: তুতানখামেনের ডিএনএ থেকে জানা গেছে তিনি ম্যালেরিয়ায় মারা গিয়েছিলেন।
সংরক্ষণ পদ্ধতি: মমির ত্বকে পাওয়া রেজিনের প্রলেপ আজও অক্ষয়।
৭. মমি তৈরি বনাম স্বাভাবিক সংরক্ষণ
স্বাভাবিক মমি: মিশরের গরম ও শুষ্ক মরুভূমিতে কিছু দেহ স্বাভাবিকভাবেই মমিতে পরিণত হয়েছে (যেমন গেবেলেইন মমি)।
কৃত্রিম মমি: ধর্মীয় আচার অনুসারে তৈরি, যা অধিক টেকসই।
৮. মমি সংস্কৃতির প্রভাব
গ্রিক-রোমান যুগে: মিশরীয় মমি তৈরি প্রক্রিয়া গ্রিক ও রোমানদের দ্বারা অনুকরণ করা হয়েছিল।
আধুনিক জনপ্রিয়তা: মমি হলিউড সিনেমা, বই ও ভিডিও গেম (যেমন "দ্য মামি") এর অনুপ্রেরণা।
১০. মমি তৈরির পতন
খ্রিস্টধর্মের প্রভাব: রোমান যুগে খ্রিস্টান ধর্ম প্রসারের সাথে মমি তৈরি বন্ধ হয়ে যায়।
অর্থনৈতিক কারণ: মমি তৈরি অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
উপসংহার:
প্রাচীন মিশরে মমি তৈরি ছিল বিশ্বাস, বিজ্ঞান ও শিল্পের এক অনন্য সংমিশ্রণ। এই প্রক্রিয়া শুধু দেহ সংরক্ষণ নয়, বরং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে। আজও মমি আমাদের প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়ন ও দর্শন সম্পর্কে অমূল্য তথ্য দেয়। মিশরের মরুভূমিতে প্রাপ্ত মমিগুলো আজ বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে (যেমন কায়রোর মিশরীয় জাদুঘর, ব্রিটিশ মিউজিয়াম) সংরক্ষিত আছে, যা মানব সভ্যতার এক অমর নিদর্শন।
সময় নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।🥰
Post from Science Hunter