27/11/2025
রথীন্দ্রনাথের পেটে কি একটা গোলমাল, অসুস্থবোধ করতেন, খাওয়া দাওয়া একেবারেই রোগীর পথ্য। ওদিকে পিতৃদেব রবীন্দ্রনাথ পুত্রের স্বাস্থ নিয়ে নিজের উদ্বেগ গোপন করলেন না, বলতেন রথী না জানি আমার আগেই যায়। দুঃখ করে একবার বলেছেন রথীর দুর্ভাগ্য,সে আমার পুত্র। তাই রথীর গুণগুলো কারও চোখে পড়ল না,আমার আড়ালে সব চাপা পড়ে গেল।
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
মানুষ রথীন্দ্রনাথ আদপে যথেষ্ট লাজুক প্রকৃতির। বিখ্যাত পিতার ছেলে হয়েও নিজে কম গুণের অধিকারী ছিলেন না। নানারকম যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে নতুন কিছু বের করা ছিল তাঁর নেশা। উদয়নে প্রতিমা দেবী -রথীন্দ্রনাথের শোবার ঘর। সেখান ছিল মস্ত এক নীচু খাট, টানটান বিছানা, ছোট -বড় কয়েকটি তাকিয়া আর বালিশ। রথীন্দ্রনাথের অভ্যাস বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় লেখালেখি করা।চিঠিপত্র থেকে প্রয়োজনীয় লেখা সব বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাতেই লিখতেন।
ঘরের বড় বড় দরজা,জানলা সব খোলা। কবি ঘনিষ্ঠ রানী চন্দ প্রতিমা- রথীর ঘরের পাশ দিয়ে রাতে শোবার সময় দেখতেন রথীন্দ্রনাথ বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিখেছেন। প্রতিমা দেবী পাশে বসে একটা তাকিয়া কোলে কথা বলেই চলেছেন। রথীন্দ্রনাথ লিখতে লিখতে মাঝে মাঝে একটু হাঁ হুঁ করতেন কি করতেন না এর বেশি নয়। তবে তাতে প্রতিমা দেবীর কথা শেষ হত না। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে রানী চন্দ শুতে যেতেন। আবার খুব ভোরে যখন তিনি নেমে আসতেন দেখতেন প্রতিমা সেই ভাবে রথীর সাথে কথা বলছেন। আর রথী শিয়রের কাছে বাতি জ্বেলে সেই রকম শোওয়া অবস্থায় বই পড়ছেন।
তাই রানী চন্দ লিখেছেন " রথীদা- বোঠানের শয্যার এই দৃশ্যটি আমার বড় মধুর লাগত,এখনো লাগে যখন ভাবি তাঁদের কথা। বোঠান -রথীদাকে আলাদা করে ভাবতে পারি না। দুজনেই যেন এক। তাঁদের কাজ পৃথক আকারের হলেও সুর ছিল এক তারে বাঁধা"।
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
প্রতিমা দেবী বাগান করতে শুরু করলেন, চারিদিকে জুঁই,বেশি, দোলনচাঁপার সারি। রথীন্দ্রনাথের কারখানা ঘর ঢেকে দিলেন বসন্তমালতী ঝুমকোলতায়। ওদিকে রথীন্দ্রনাথ ও বাগান করা শুরু করেছেন। রানী চন্দরা ছুটোছুটি করেন আর দেখেন দুই বাগানের কোনটি সেরা। সেই সব দেখে রথীন্দ্রনাথ হাসেন মিটিমিটি,প্রতিমা খুকখুক করে। দিনে দিনে রথীন্দ্রনাথের বাগানের নেশা বাড়ে।আশ্রমে ঘুরে ঘুরে বেছে গাছ লাগাতেন। স্বামী- স্ত্রীর বাগানে উত্তরায়ণ আলোকিত হয়ে ওঠে ঘন ছায়া ফেলল। শ্যামলে শ্যামলে সবার চোখ জুড়িয়ে যায়, আশ্রমের রাঙামাটি দিকে দিকে ঢাকা পড়ে।
প্রতিমা ছিলেন জাত শিল্পী এই সম্পদ তাঁর জন্মগত। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদরের ভাগ্নী। জোড়াসাঁকোয় যখন ' বিচিত্রা' শুরু হয় সেখানে ছবি আঁকতেন। নিজের বলে কোনও সময় ছিল না, তাঁকে না হলে রবীন্দ্রনাথের চলত না। আর প্রতিমার নিজের বলে কোনও সময় ছিল না। গুরুদেব আছেন,সংসার আছে, আছে আশ্রম। কত কিছু তাঁর দায়িত্ব। সব হাসিমুখে সামলে নিতেন। প্রতিমা নিজেও খুব সুস্থ ছিলেন না। হাঁপানির সমস্যা ছিল। যখন সেই সাংঘাতিক টান উঠত দাঁড়িয়ে দেখা ছিল দুঃসহ। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন একটানা কষ্ট পেতেন।
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সুখ স্মৃতির কথা পঙ্কজ মল্লিক নিজের কলমে লিখেছেন "আজ সেই রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎকারের কথা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আমার 'চোখ ভেসে যায় চোখের জলে '। তাঁকে ভুলে গেলে যে মহাপাপের ভাগী হব"!
কলকাতা, শান্তিনিকেতন দেরাদুন যেখানেই রথীন্দ্রনাথ থাকুন পঙ্কজ মল্লিকের সাথে তাঁর যোগাযোগ কখনও ছিন্ন হয় নি।কবিগুরুর জন্মশতবর্ষে নিমন্ত্রণ পেয়ে পঙ্কজ মল্লিক চলে গিয়েছিলেন দেরাদুনে রথীন্দ্রনাথের গৃহে। সেখানে তিনি তাঁর দীর্ঘ আতিথ্য গ্ৰহন করেন। দেরাদুনে বাবামশাইয়ের জন্মশতবর্ষ পালন করছিলেন রথীন্দ্রনাথ,পঙ্কজ মল্লিক ছিলেন একমাত্র আমন্ত্রিত কণ্ঠশিল্পী। রথীন্দ্রনাথ,পঙ্কজ কুমার মল্লিককে আদেশ করলেন 'বর্ষার গান করুন'। দেরাদুনের পাহাড়ের গায়ে বর্ষা নেমেছে, অপরূপ সুন্দর সেই দৃশ্য বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলেন। এমন প্রাণ ঢালা বর্ষার গান বেতারে, রেকর্ডে বোধহয় আর কখনও তিনি গান নি। একের পর এক নিবেদন করেছেন কবিগুরুর উদ্দেশ্য,তাঁরই আত্মজের পাশে দাঁড়িয়ে।
প্রচার বিমুখ রথীন্দ্রনাথ বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষাতেই খুব ভাল লিখতেন। উদ্ভিদ ও উদ্যান বিদ্যায় তিনি ছিলেন অসাধারণ। বিচিত্র ও বহুবিস্তৃত ছিল তাঁর হাতের কাজ ও কারুকর্মের ক্ষমতা নিজের চোখে দিনের পর দিন দেখেছেন পঙ্কজ মল্লিক।
পিতৃদেবের গান বিভিন্ন ভাষায় ভাষান্তরিত হয়ে প্রচারিত হোক রথীন্দ্রনাথ চাইতেন,সত্যি বলতে পিতার মত রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচার ও প্রসার সম্পর্কে তাঁরও কোনও গোঁড়ামি ছিল না।
সেবার সবাই ঠিক করলেন রথীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছরের জন্মোৎসব পালন করা হবে। বন্ধু,স্নেহাস্পদদের উৎসাহ তিনি কিছুতেই থামাতে পারেন না। কাতর হয়ে শুধু বললেন আশ্রমে কিছু করো না,বাবামশায় আছেন। তাঁর সামনে আমাকে লজ্জা দিয়ো না।
তবে সেই খবর রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছে যায়। তিনি বললেন সবাই ভাল করে আয়োজন কর,আমি নিজে রথীর জন্মোৎসবে যোগ দেব। সেই খবর পেয়ে রথীন্দ্রনাথ লজ্জা পেয়ে একপ্রকার বেঁকে বসলেন। শেষে ঠিক হয় অনুষ্ঠান হবে শ্রীনিকেতনে।
আমগাছের ছায়ায় বেদীতে রবীন্দ্রনাথ বসেছেন, পাশে রথীন্দ্রনাথ,উৎসব রঙের হলুদ চাদর গায়ে। ক্ষিতিমোহন সেন,হাজারীপ্রসাদ দ্বিবেদীজী মন্ত্র পড়লেন। কবিগুরু আশীর্বাদী কবিতা লিখে এনেছিলেন, পড়লেন,বড় মর্মস্পর্শী সেই কবিতা -
"মধ্যপথে জীবনের মধ্যদিনে
উত্তরিলে আজি,এই পথ নিয়েছিলে চিনে
সাড়া পেয়েছিলে তব প্রাণে
দুরগামী দুর্গমের স্পর্ধিত আহ্বানে,
ছিল যবে প্রথম যৌবন"।
শেষ ক'লাইন-
"বিদায়প্রহরে রবি দিনান্তের অস্তনত করে
রেখে যাবে আশীর্বাদ তোমার ত্যাগের ক্ষেত্র -, পরে।
গান হল, রথীন্দ্রনাথ নতমস্তকে বসে আছেন। পিতা-পুত্র বসে আছেন পাশাপাশি, অপূর্ব এক দৃশ্য। রানী চন্দ লিখেছেন " শুধু একবারই আমরা দেখেছি এ ছবি"। আজ রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।।
সংকলনে ✍🏻 অরুণাভ সেন।।
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
পুস্তক ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার,সব হতে আপন,রানী চন্দ,আমার যুগ আমার গান, পঙ্কজকুমার মল্লিক , অনুলিখন অরুণাভ সেনগুপ্ত