22/11/2021
শয়তানের ধূর্ততা : হতাশ করা
আপনাদের শয়তানের আরেকটি চালাকির বলবো এখন। মনে করুন আপনার অফিসে যেতে দেরী হয়েছে। এজন্য আপনার বস খুব রাগ করে বসে আছেন। অফিসে আরও অনেক মানুষ আছে। এরকম সময় আপনি কী করেন? সকলের নজর এড়িয়ে নিজের টেবিলে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়েন। তখন বসের সাথে দেখা করতে চান না।
অথবা মনে করুন আপনি যখন ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়েন। একটা বাজে রিপোর্ট কার্ড নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সেই মুহূর্তে আপনি চুপিসারে ঘরে ঢুকেন। কোনো “আসসালামু আলাইকুম” নেই, কিছু না; চুপিসারে ঘরে ঢুকে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলেন। মা যদি জিজ্ঞেস করেন, “আজকে স্কুলে কী হলো?” আপনি বলেন, “তেমন কিছু না।” আপনি যখন কাউকে হতাশ করেন তখন তার থেকে দূরে দূরে থাকেন। তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন।
এই ক্ষেত্রে, যখন আমরা অশ্লীল কাজ করি, নিজেদের উপর যুলুম করি, তখন আমরা কাকে হতাশ করি? আল্লাহ তা'আলাকে! আপনি আল্লাহ্কে অসুন্তষ্টি করেন। শয়তান তখন এর সুযোগ নেয়। আপনার কাছে এসে সে বলে—
'তুমি এখন আবার সালাত পড়তে যাবে? ভন্ড! তুমি এতসব অশ্লীল কাজ করে এখন আবার ক্লাস করতে যাবে? এখন তুমি ইবাদত করতে যাবে? তুমি তো দু’মুখো মানুষ!'
তখন আপনি বলেন—
‘হ্যাঁ’, আমি তো আসলেই দু’মুখো মানুষ; আমার সালাত পড়া উচিত না।'
শয়তান আপনার গুনাহের সুযোগ নিয়ে আপনাকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আপনি তখন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে বিব্রতবোধ করেন।
কিন্তু একজন সত্যিকারের মুত্তাকী যখন কোনো ভুল করে, তৎক্ষণাৎ সে কী করে জানেন? সে আল্লাহকে স্মরণ করে! ذَكَرُوا اللَّهَ ﴾আল্লাহকে স্মরণ করে﴿ [সূরা আলে-ইমরান : ১৩৫]। ফা বা সুম্মা (অতঃপর, এরপর) এ ধরনের কোনো শব্দও আসেনি এখানে! فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ ﴾তারপর তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়।﴿
অর্থাৎ, মুত্তাকী মানুষরা পাপ করে আল্লাহকে হতাশ করলে তারা বরং ভুলটি বুঝে ফেলে। এবং শয়তানকে সুযোগ না দিয়ে আল্লাহর কাছে ফিরে আসে, দূরে সরে যান না।
এখানে যুনুব (ذُنُوب) শব্দটা যানাব (ذنب) থেকে এসেছে। 'যানাব' দিয়ে মূলত এমন একটা পাপ বোঝানো হয় যার কারণে আপনি অসম্মানিত বোধ করেন। এমন কোনো কাজ যার কারণে আপনি লজ্জিত, বিব্রত। ফলে তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ঐ লজ্জাজনক কাজ থেকে।
وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ ﴾আর আল্লাহ ছাড়া আর কে গুনাহ ক্ষমা করতে পারে?﴿ [সূরা আলে-ইমরান : ১৩৫]
আপনি আর কার কাছে যাবেন? আর কোথায় যাবেন? আল্লাহ ছাড়া আর কে জানে আপনি-আমি কী কী ভুল করেছি?
আমাদের গুনাহের খাতায় বহু জিনিস আছে যা আল্লাহ প্রকাশ করেননি। শুধু আল্লাহই সে-সব জানেন। সে-সবের জন্য আল্লাহর কাছে আমাদের ক্ষমা চাইতে হবে। যারা জান্নাতে যাবে তাদের বর্ণনায় যেসব বৈশিষ্ট্য এসেছে তার মাঝে এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য।
أُولٰٓئِكَ جَزَآؤُهُم مَّغْفِرَةٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَجَنّٰتٌ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ خٰلِدِينَ فِيهَا ۚ وَنِعْمَ أَجْرُ الْعٰمِلِينَ
﴾তাদেরই জন্য প্রতিদান হলো তাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ঝর্ণা, যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আর সৎকর্মশীলদের কতই না উত্তম প্রতিদান! ﴿[সূরা আলে-ইমরান : ১৩৬]।
আমি আমার পরিবারের সাথে একবার শপিংমলে গিয়েছিলাম। সেখানে এক মা তার ছেলেকে ভীষণ বকা দিচ্ছিল আর ছেলেটা চিৎকার করে কাঁদছিল। মা ছেলেকে কষে একটা চড়ও বসিয়ে দিল। কিন্তু জানেন, বাচ্চাটা তারপরও কার কাছে গেল? মার কাছে, মাকেই ধরে রইল। তার মাকে ছাড়ছে না। চারপাশে সব অদ্ভূদ অচেনা মানুষ, সে তাদের কাছে যেতে চায় না। যদিও তার মা তার উপর রাগ হয়েছে, হতাশ হয়েছে, তাকে বকা দিচ্ছে কিন্তু তার আশ্রয়, সুরক্ষা সে কার কাছে পাবে? তার মায়ের কাছেই! এই দৃশ্য আমাকে ভাবিয়েছে। সুবহানাল্লাহ।
যখন আমি-আপনি গুনাহ করি, যখন আমরা আল্লাহকে হতাশ করি, তাঁর অবাধ্য হই—আমরা তখন কার কাছে যাব? আমাদের আর কোথায় যাওয়ার আছে! তাই আমরা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করলেও, আল্লাহ আমাদের যেমন দেখতে চান তেমন হতে না পারলেও—তবুও সত্যিকারের মুত্তাকী কখনোই আল্লাহর উপর আশা হারায় না। আল্লাহর উপর আশা হারানোর অনুমতি তিনি আমাদের দেননি। এই আচরণ আমাদের রপ্ত করতে হবে।
[বই: শয়তানের থাবা : আক্রমণ ও কৌশল, উস্তাদ নোমান আলী খান]