25/09/2025
" মৃত্তিকার ঘ্রান "
পর্ব _ ২৬ -- গগন বাবুর মরণ যাত্রা।
অবশেষে গগন বাবুর মরণ যাত্রা শুরু হল।
গগন বাবুর মনে হল তিনি পাখির পালকের মত হালকা হয়ে গিয়েছেন।
আস্তে আস্তে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে তিনি উর্দ্ধগগনের দিকে গমন করছেন ।
নিজেকে এত হালকা, এত ভারমুক্ত জীবনে কখনো মনে হয়নি! তবে কি মাধ্যাকর্ষনের টান হারিয়ে গিয়েছে? নাকি তিনি পার্থিব জগতের মায়া কাটিয়ে চিরকালের জন্য পরকালে চলে যাচ্ছেন?
পরকালের সম্ভাবনাই বেশি। হয়তোবা তার মৃত্যুই ঘটেছে!
বিগত দুই মাসেরও বেশি সময় যাবত তিনি নিজ গৃহের, নিজ বিছানায়, কলাগাছের ন্যায় পড়ে ছিলেন।
তিনি একদম নড়াচড়া করতে পারতেন না। একটি কথাও বলতে পারতেন না। মুখ দিয়ে বের হওয়া গোঁ গোঁ শব্দ গৃহের পরিবেশ আরো ভয়ঙ্কর ভারী করে তুলতো। আপন জন কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকাডাকি করলে তাদের মুখমন্ডল গুলি অস্পষ্ট ছায়ার মত ক্ষনকালের জন্য ভেসে উঠে পরক্ষনেই আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। তবে কে কি বলছে তা তিনি অস্পষ্ট হলেও বুঝতে পারছিলেন।
দুই মাস পূর্বে স্ট্রোক হয়ে তার সমস্ত শরীর একদম অবশ হয়ে গিয়েছে।
তিনি নাকি পাঁচ পাঁচটি দিন সম্পুর্ন অচেতন অবস্থায় ছিলেন। তাকে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের আইসিইউ তে ভর্তি রাখা হয়েছিলো।
চৌদ্দ দিনের দিন তাকে নিজ গৃহে ফেরত আনা হয়েছে।
সেই থেকে তিনি নিজের বিছানায় অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে ছিলেন।
স্ত্রী, পুত্র, পরিবারের উদ্বিঘ্ন কথাবার্তা কানে ভেসে আসছিল। নিকটাত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীগন শেষ দেখা দেখতে এসে আড়ালে আবডালে বলতে লাগল - 'বেঁচে ওঠার কোন আশাই আর অবশিষ্ট নেই।'
আস্তে আস্তে সকলের আসা যাওয়া কমে যেতে লাগলো।
ইতিমধ্যে গগন বাবুর ঘরে নিজ স্ত্রী পুত্রের আনাগোনাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল ।
তা না হওয়ার কোন কারন ছিল না।
সমস্ত ঘরে উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল।
কোমরের নীচে বেড শোর হয়ে বড় গর্তের মত পঁচন ধরে গিয়েছিল।
প্রস্রাবের রাস্তায় ক্যাথেটার পরানো থাকলেও ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিছানা ভিজে গিয়ে এমোনিয়ার গন্ধ ছড়াচ্ছিল।
প্রথম দিকে আত্মীয় স্বজনের নিয়ে আসা ফলমুল ব্লেন্ডারে ঘুঁটে অনবরত নাকের নল দিয়ে পাকস্থলীতে চালান করা হচ্ছিল। এতে গগনবাবু বিপুল পরিমাণে কটু গন্ধযুক্ত মল ত্যাগ করে বিছানা ভাসাতে লাগলেন। এর পর খাওয়ানোর মাত্রা কমিয়ে দেওয়া হল ।
কখনও বা হড় হড় করে বমি করে চোখ উল্টে ফেলে মৃত্যুর উপক্রম হতে লাগল।
দুর্গন্ধ দুর করার নিমিত্তে ঘন ঘন এয়ার ফ্রেসনার স্প্রে করা শুরু হল। কখনও কখনও ধূপ ধূনা, আগরবাতি জ্বালানো হতে লাগল ।
তাতে সকল রকমের কটু গন্ধ মিলে মিশে ককটেল হয়ে এক অদ্ভুত রকমের দুর্গন্ধ গগনবাবুর ঘরের কোণা ছাড়িয়ে আশে পাশের ঘরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ।
গগন বাবুর স্ত্রী অত্যন্ত ত্যক্তবিরক্ত হয়ে কাজের মহিলার উপরে গর্জে গর্জে উঠতে লাগলেন।
ছেলে মেয়েরা ভাতের থালা হাতে নিয়ে ছাদে গমন করতে লাগল।
সেবা যত্নের জন্য একজন সার্বক্ষণিক লোক নিয়োগ করা হয়েছিল।
তিনি সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে কারনে অকারনে ঘরের ব্যালকনিতে গিয়ে হাওয়া খেতে লাগলেন।
এমনি করে চলতে চলতে আজ সকালে মনে হল যেন সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে! স্ত্রী পুত্র কন্যাগন কেমন করে যেন ব্যাকুল হয়ে ঘিরে ধরে আছে। অথচ তাদের কোন কথাবার্তাই আর কর্নকূহরে প্রবিষ্ট হচ্ছিল না।
হঠাৎ গগন বাবু উপলব্ধি করলেন যে, তিনি একদম হালকা হয়ে গিয়েছেন।
পাখির পালকের মত ভাসতে ভাসতে তিনি শুন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছেন!
যেমন করে জুম করে গুগল ম্যাপ দেখা হয়, তেমনি হঠাৎ করে গগনবাবুর দৃষ্টি তার নিজ গৃহের দিকে নিবদ্ধ হলো।
তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন তার স্ত্রী তার নিশ্চল দেহখানি জড়িয়ে ধরে উথালি পাথালি করে কাঁদছেন। তার বড়পুত্র চিৎকার চেঁচামিচি করে কাঁদতে লাগলো । ছোট পুত্র চুপচাপ ফোন তুলে আত্মীয় স্বজনকে মৃত্যু সংবাদ দিতে থাকলো। তার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কন্যাটি খুন খুন করে অশ্র বিসর্জন করতে লাগলো ।
পাড়া প্রতিবেশীদের কেউ কেউ এগিয়ে এলো। কেউ কেউ দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে লাগলো ।
কিছু পরে গগন বাবু স্পষ্ট শুনতে পেলেন , মাইকিং হচ্ছে! - - " একটি শোক সংবাদ! একটি শোক সংবাদ!! জীবনপাড়া মহল্লা নিবাসী সকলের সুপরিচিত গগন কুমার গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে গগনবাবু অদ্য সকাল সাত ঘটিকায় ইহকালের মায়া ত্যাগ করে পরলোক গমন করেছেন । - দিব্যান লোকান স্বগচ্ছতু:। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দুপুর দুই ঘটিকায় মড়াপাড়া মহাশশ্মানে অনুষ্ঠিত হবে। "
গগনবাবু এইবার নিশ্চিত বুঝতে পারলেন যে, তিনি আসলেই মৃত্যুবরণ করেছেন !
কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না যে, পরকাল বলতে তিনি ঠিক কোথায় আছেন!?
কোন আলো নেই , কোন ছায়া নেই, কোন অন্ধকার নেই, কোন জোনাকি নেই, কোন শব্দ নেই, কোন গন্ধ নেই, কোন অনুভূতি নেই, কোন আশা নেই, কোন নিরাশা নেই, কোন আনন্দ নেই , কোন বেদনা নেই,
কোন অস্তিত্ব নেই , কোন অনস্তিত্বও নেই!
চারিদিকে শুধুই ধোঁয়াশা! অবিচ্ছিন্ন জড়তা!
গগন বাবুর মানস চক্ষুতে কেবলই তার মফস্বল শহরের বাড়িখানি ভেসে উঠতে লাগলো। বাড়ির পাশের পুকুরে হাঁসেদের প্যাঁক প্যাঁক শব্দ! পুকুর পাড়ের আম বাগানে পাখিদের কিঁচির মিচির! কাঁঠাল গাছের পাতার ফাঁকে ঝরে পড়া নরম চাঁদের আলো! ঝিঁঝিঁর একটানা কানফাটানো আর্তনাদ! সকাল বেলার উঠোনে ঝরে পড়া সাদা শিউলি ফুল!
গগনবাবু এখন সকল কিছুর উর্দ্ধে।
গগনবাবু স্পষ্টত দেখতে পেলেন , শুনতে পেলেন , তার ফেলে আসা পরিবারের মানুষদের হৃদয়ের কথা!
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মন হতে গগনবাবুর নাম নিশানা চিরকালের মত মুছে গিয়ে নিজ নিজ স্বার্থের আত্মকলহ শুরু হয়ে গিয়েছে!
গগন বাবু এদের জন্য সারাটি জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। বড় পুত্রের বিয়ে দিয়ে নাতি নাতনির মুখ দর্শন করতে চেয়েছিলেন । মেয়েটিকে দেখে শুনে পাত্রস্থ করতে চেয়েছিলেন । অত্যধিক চুপচাপ ছোট পুত্রটির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন ।
এইসকল বৈষয়িক ব্যাপারে এত বেশি আত্মমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, নিজের ব্যাক্তিগত সাধ আহ্লাদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন।
গগন বাবু জীবনে একটি বার কৈলাশ পর্বতে যাত্রা করবার বাসনা হৃদয়ে ধারন করেছিলেন!
পৃথিবীর ছাদ - পামীর মালভূমিতে একটি বার পায়ে হেঁটে ভ্রমন করার দুর্নিবার ইচ্ছা মনে মনে পোষন করেছিলেন! মালদ্বীপের নীল সমুদ্রে জীবনে একটিবার স্কুবা ডাইভিং দিয়ে রঙিন মাছেদের ভেসে বেড়ানো দেখবার স্বপ্ন সাধ মনে জেগে উঠেছিলো!
ছাপোষা গগন বাবুর পক্ষে কখনোই এই সব স্বপ্ন সাধের কথা মুখ ফুটে উচ্চারণ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে নাই!
আহা! একটিবার, আরো একটিবার, যদি যেকোন উপায়ে মাটির পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া সম্ভবপর হতো!!
( চলবে)
---------- সুকুমার সুর রায়।