29/10/2025
দাম্পত্য জীবনে বরকত বৃদ্ধির ১০ টি উপায়:
১| সবসময় আল্লাহকেই পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু বানাবেন। আপনি যদি শুধুমাত্র নিজের নাফসের জায়গা থেকে ভালবাসেন, তাহলে একটা পর্যায়ে গিয়ে ধরা খাবেন। নিজের মন মত কিছু না মিললেই অধৈর্য লাগবে, অস্থির লাগবে। কিন্তু আপনি যদি "আল্লাহর সন্তুষ্ট হবেন এই সম্পর্কের হক আদায় করলে"—এই চিন্তা করে ভালবাসেন, তাহলে ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবেন, অল্পতেই অধৈর্য হবেন না। এবং আল্লাহকে স্মরণ করলে আল্লাহ বরকত দিবে সংসারে এবং সম্পর্কে।
২| কথা শুরু করবেন "আমি" দিয়ে, "তুমি" দিয়ে শুরু করলে অপরপক্ষের মনে হয় তাকে অ্যাটাক করা হচ্ছে। অর্থাৎ এভাবে 'তুমি' দিয়ে শুরু করে বলবেন না যে, "তুমি এত অপরিচ্ছন্ন অগোছালো, এত কষ্ট করে গুছাই আর তুমি এসে সব এলোমেলো করো, ভালো লাগেনা!"
বরং আমি দিয়ে শুরু করুন, "আমার আসলে খুবই কষ্ট হয় যখন দেখি পরিশ্রম করে একটা গোছানো ঘর চোখের পলকে অগোছালো হয়ে গেল। বলো, আমরা দুজন মিলে কি করতে পারি এর সমাধান করতে?"
"আমি" দিয়ে শুরু করলে অপর পক্ষ সহজেই আক্রমণাত্মক বোধ করবে না বরং তার অন্তরে মায়া লাগবে।
৩| আপনার পার্টনারের ছোট ছোট দোষ ত্রুটি গুলো আপনার পরিবারের মা, বাবা/ ভাই / বোনকে কখনো বলে বেড়াবেন না। একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা যাবে, আপনার সাথে আপনার পার্টনারের সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। আপনি সেগুলো ভুলেও গেছেন! অথচ আপনার পরিবারের অন্তরে আপনার পার্টনারের প্রতি একটা নেগেটিভ মনোভাব রয়ে গেল, যেটা পরবর্তীতে আরো সমস্যার সৃষ্টি করবে।
আল্লাহ তো সূরা বাকারাহতে বলেছেন যে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাপড় হওয়ার কথা! কাপড় তো আমাদের শরীরের দাগ, দোষ ত্রুটি গুলো ঢেকে রাখে, এবং সুন্দর কাপড় আমাদেরকে সৌন্দর্য মন্ডিত করে। ঠিক তেমন ভাবেই স্বামী স্ত্রী একে অপরের দোষ ত্রুটি ঢেকে রেখে একে অপরকে আল্লাহর খুশির জন্য আরো সৌন্দর্য্য মন্ডিত করবে।
৪| প্রকৃত গত দিক থেকে একজন পুরুষ সম্মান চায়। আল্লাহ রব্বুল আলামিন স্বামীকে আমাদের অভিভাবক বানিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। সে জায়গা থেকে স্বামীকে মর্যাদা দিতে হবে। মাঝে মাঝে বলা দরকার, "আপনি যেহেতু আমার অভিভাবক, আপনিই বলেন কোনটা করলে ভালো হয়?"এতোটুকু বললে স্বামী মুখ ফুটে কিছু না বললেও, ভেতরে ভেতরে আপনার প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। এবং তাক্ওয়ার জায়গা একজন ভালো পুরুষ কখনোই এমন কোন সিদ্ধান্ত আপনার ওপর চাপিয়ে দেবেন না, যেটা আপনার দুনিয়া-আখিরাতের জন্য কষ্টকর। তার সিদ্ধান্তই ফাইনাল করা হলো এবং সেটা আপনাকে গুরুত্ব দিয়েই করা হলো আলহামদুলিল্লাহ।
৫| প্রকৃতগত দিক থেকে নারীরা ভালোবাসা চায়, একটু আদর-যত্ন চায়। এর জন্য সবপময় টাকাও খরচ করতে হয় না। আপনি যদি একটু নিয়মিত আপনার ওয়াইফের প্রশংসা করেন, সুন্দর একটা জামা পরলে তাকে সুন্দর বলবেন, শখ করে আপনার জন্য কিছু রান্না করলে সেটার প্রশংসা করবেন—এই ছোটখাটো বিষয়গুলো স্ত্রীর অন্তরে স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা আরো বৃদ্ধি করবে। দেখুন আমাদের প্রিয় রসূল ﷺ কাপের যে অংশে আঈশা(রা) মুখ লাগিয়ে খেয়েছেন, সেই জায়গাটা থেকেই তিনি খেলেন। এটা করার কি দরকার ছিল?
শ্রেষ্ঠ মহামানব এরকম একটা ছোট কাজ করে আমাদেরকে দেখাচ্ছেন যে, ছোট্ট আন্তরিক প্রচেষ্টায় দাম্পত্য জীবনে কত বরকত আসে!
৬| স্ত্রী অথবা স্বামী আপনারা কেউই কখনো কোন দাওয়াতে, অন্যান্য যৌথ পরিবারের সদস্যদের সামনে একে অপরকে সমালোচনা করবেন না। বলবেন না যে, "...আরে আমার হাসবেন্ড! সে তো এরকম ওরকম! .." .. "আমার ওয়াইফ তুমি অমুক ভাবীর মত হতে পারো না!—এগুলো কখনোই বরকত আনে না, পরিবেশ আর মনকে বিষাক্ত করে দেয়।
৭| দুইজন দুজনকে জান্নাতুল ফেরদৌসের দিকে টেনে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হবেন। আসলেই "টেনে নিয়ে যেতে হবে"। কারণ আপনার স্বামী স্ত্রী সেও তো মানুষ। তাই মাঝে মাঝে শয়তান তাকেও এসে যখন দুর্বল এবং অলস করে ফেলবে, এটা আপনার দায়িত্বে থাকবে আপনি তাকে সুন্দরভাবে আবারও আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দিবেন। এবং বলবেন "আমি তো চাই জান্নাতে তুমি আমার স্বামী অথবা স্ত্রী হও!'
৮| স্বামী স্ত্রী আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে একজন আরেকজনকে নিয়ে অবসেস্ করবেন না। স্বামীর স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পূর্ণ হক আদায় করবেন। এর পাশাপাশি আপনার নিজের ছোটখাট হালাল আনন্দের যে বিষয়গুলো, নিজের শরীর-মনের যত্নের বিষয়গুলোকে অবহেলা করবেন না। যেমন: ইসলামিক বই পড়া, কয়েকটা হালাকায় অংশগ্রহণ করা, বান্ধবীদের বাসায় দাওয়াত দেয়া, দ্বীনি বোনদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখা। উত্তম সহবাতের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখবেন বিয়ের পরেও। তাদেরকে কাট করবেন না।
স্বামীরাও মসজিদ মুখী হবেন এবং আপনার মসজিদের মাধ্যমে আল্লাহভক্ত কিছু বড় এবং ছোট ভাইদের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক বজায় রাখবেন। ছেলেরাও তাদের ভালো সহবাতের সাথে যুক্ত থেকে কিছু হালাল আনন্দের সময় কাটালে, একসাথে খেলাধুলা করলে স্ত্রী এটা নিয়ে স্বামীকে দোষারোপ করবেন না। আপনিও তখন নিজের আত্মশুদ্ধিতে ফোকাস করবেন এবং আপনাকে মুসলিম হিসেবে আপগ্রেড করতে ফোকাস করবেন।
সারাক্ষণই স্বামী স্ত্রী একজন আরেকজনের সাথে চুম্বকের মতো লেগে থাকলে একপর্যায়ে বিরক্তির তৈরি হয়, একজন আরেকজনকে নিয়ে অবসেসড হয়ে যায়। তাই নিজস্বতা বজায় রাখা প্রয়োজন যেকোনো সম্পর্ককে হেলদি রাখতে। এবং অবসেশন ভাঙতে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই নিজের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রাখুন।
৯| যার-তার কাছ থেকে বিয়ে সংক্রান্ত উপদেশ নিবেন না। মাথায় রাখবেন সবাই তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে সীমাবদ্ধ। যার মাত্র এক অথবা দুই বছর হয়েছে বিয়ের, সে বিয়ে নিয়ে এক অন্যরকম জগতে থাকতে পারে। অনেক বছর ধরে শ্বশুরবাড়ির কাছে হেনস্থা হয়েছে, তার কাছে বিয়ের চিত্র আরেকরকম। সেজন্য বিয়ের এডভাইস নেওয়ার আগে যাচাই করে নিন, যার কাছে নিচ্ছেন, সে যেন আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে সচেতন হয়।
১০| কৃতজ্ঞ হোন, কৃতজ্ঞ হোন, এবং কৃতজ্ঞ হোন!
এখন এত অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি, অথচ মনে আছে ? এই এক বিয়ে যেন সুন্দরভাবে হয়ে যায়, সেজন্য কি পরিমান আল্লাহর কাছে জায়নামাজে কান্নাকাটি করেছিলেন? এখনো পৃথিবীতে অনেকেই অবিবাহিত অবস্থায় স্ট্রাগল করছে, সেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপনাকে বিয়ের মত একটা নিয়ামত দিয়েছেন। আপনি কেন অধৈর্য হয়ে, শয়তানের আক্রমণে পড়ে, নিজের নিয়ামত নষ্ট করবেন?
কৃতজ্ঞ থাকবেন এবং নিজের দাম্পত্য জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলোকে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করবেন না। বদ নজর, হিংসা, হাসাদ এগুলো খুবই সত্য জিনিস, যা ভালো বিয়ের সম্পর্ককে নষ্ট করে দিতে পারে।
সর্বোপরি মাথায় রাখবেন, এই টিপস গুলো প্রকৃতপক্ষে একটি হেলদি/ স্বাস্থ্যকর বিয়ের জন্য প্রযোজ্য। যদি কারো বিয়ের মধ্যে শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, কোন একজন বা দুজনের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা, আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে বড় রকমের অসচেতনতা, কোন ড্রাগ বা নেশা জনিত চ্যালেঞ্জের সমস্যা ইত্যাদি সিরিয়াস ঝামেলা থাকে, তাহলে সর্বপ্রথম সেই বিষয়ের সমাধান না করলে এই টিপসগুলো কাজে আসবে না।
- শারিন সফি অদ্রিতা