19/10/2025
আমাদের সমাজে ইসলাম পালনের ধরন নিয়ে একটু চিন্তা করলে তিনটি ক্যাটাগরি চোখে পড়ে।
১. থেরাপিউটিক ইসলাম
প্রথম ক্যাটাগরিতে আছেন তারা, যারা ইসলামকে মূলত একটা 'থেরাপিউটিক ট্যুল' হিসেবে ব্যবহার করেন। তাদের জীবনযাপন পুরোপুরি সেক্যুলার আধুনিকতার ছকে বাঁধা; ক্যারিয়ার, লাইফস্টাইল, সোশ্যাল সার্কেল, বিনোদনের ধরন, সবকিছুই মূলধারার পশ্চিমা মডেল অনুসরণ করে। কিন্তু এই আধুনিক জীবনযাপন তাদের মধ্যে যে মানসিক চাপ, অস্থিরতা, শূন্যতা তৈরি করে, সেই টক্সিসিটি ম্যানেজ করার জন্য তারা ইসলামের কাছে ফিরে যান।
তাদের ইসলাম হচ্ছে মাইন্ডফুলনেস, মেডিটেশন, ইয়োগার মতোই আরেকটা 'ওয়েলনেস প্র্যাকটিস'। তারা হয়তো নামায পড়েন মানসিক শান্তির জন্য, কুরআন তিলাওয়াত করেন থেরাপি হিসেবে, দোয়া পড়েন পজিটিভ এফার্মেশনের মতো করে। কিন্তু ইসলাম যখন তাদের 'অথেন্টিক সেলফ' বা লাইফস্টাইলে মৌলিক পরিবর্তন দাবি করে, যখন শরিয়ার বিধান তাদের কমফোর্ট জোনকে চ্যালেঞ্জ করে, সেখানে তারা এগোতে রাজি নন।
সুদভিত্তিক ব্যাংকিং? - এখনকার যুগে তো এড়ানো অসম্ভব।
হিজাব-পর্দা? - এগুলো আরব সংস্কৃতি, অনলি গড ক্যান জাজ মি।
হালাল-হারামের বিধান? - ইনটেনশন ম্যাটারস, ফরমালিটি-ই সব না।
তাদের কাছে ইসলাম একটা 'পিক অ্যান্ড চুজ সেলফ-হেলপ সিস্টেম'-একধরনের 'স্পিরিচুয়াল বুফে' যেখান থেকে তারা যা পছন্দ, যা তাদের কমফোর্ট জোনে ফিট করে, সেটা নেবেন। বাকিটা? সেটা "কঠোর," "পুরনো," বা "প্রসঙ্গহীন" বলে ডিসমিস করে দেওয়া হয়।
২. কম্যুনাল ইসলাম: পরিচয়বাদী মুসলিম
দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে আছেন তারা, যাদের কাছে ইসলাম মূলত একটা 'এথনো-রিলিজিয়াস আইডেন্টিটি মার্কার'। এটা তাদের সোশ্যাল ক্যাপিটাল দেয়; একটা কমিউনিটি, পরিবার, বিয়ে-শাদির নেটওয়ার্ক দেয়।
বলিউডের জাভেদ আখতারের উদাহরণটা এখানে প্রাসঙ্গিক। উনার দাদার দাদা ছিলেন মাওলানা ফযলে হক্ব খাইরাবাদি যিনি ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়া দিয়েছিলেন এবং আন্দামানে নির্বাসিত হয়ে শহীদ হয়েছিলেন। ধার্মিক একটা পরিবারে বড় হয়েও জাভেদ আখতার নিজে হয়েছেন নাস্তিক। আবার, নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে "মুসলিম" বলতেন, "কালচারাল মুসলিম" বলতেন।
আমাদের সমাজেও এমন অসংখ্য "জাভেদ আখতার" আছেন। তাওহিদ-রিসালাত-আখিরাতে তাদের আসলে কোনো বিশ্বাস নেই, বা থাকলেও সেটা এতটাই দুর্বল যে তাদের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না। তারা ঈদে কুরবানি দেন, কারণ সেটা একটা সামাজিক রিচুয়াল, কিন্তু নামায-কালাম থেকে বহু দূরে।
ইসলামকে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক পর্যায়ে দেখার ব্যাপারে তাদের তীব্র আপত্তি দেখবেন। শরিয়ার কথা উঠলে তারাই সবার আগে "তালেবানি ইসলাম," "মধ্যযুগীয় চিন্তা" বলে আপত্তি জানাবেন। তাদের ইসলাম ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং সামাজিক পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ - নট মোর দ্যান দ্যাট।
৩. ট্রান্সফরমেটিভ ইসলাম: সমগ্র জীবনের দিশা
তৃতীয় ক্যাটাগরি হচ্ছে তারা, যারা ইসলামকে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাদের কাছে ইসলাম শুধু নামায-রোযা বা পার্সোনাল স্পিরিচুয়ালিটি নয়, বরং এটা একটা ট্রান্সফরমেটিভ ফোর্স যা তাদের পুরো জীবনকে নতুন করে সাজায়।
এই মানুষগুলো বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর দাসত্ব মানে শুধু ইবাদতখানায় নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থাৎ অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে, পারিবারিক সম্পর্কে, ব্যবসায়, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে। তারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নিজেদের জীবনকে ক্রমাগত রিফর্ম করতে থাকেন।
তাদের জন্য ইসলাম মানে:
-ব্যক্তিগত স্তরে: তাকওয়া, আখলাক, ইখলাস।
- পারিবারিক স্তরে: ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে পরিবার তৈরি করা, সন্তানদের দ্বীনদার হিসেবে গড়ে তোলা।
- সামাজিক স্তরে: আমর বিল মা'রুফ, সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে কাজ করা।
-রাষ্ট্রীয় স্তরে: আল্লাহর আইনকে জমিনে বাস্তবায়ন করার স্বপ্ন দেখা, সে জন্য চেষ্টা করা।
তারা বোঝেন যে, ইসলাম একটা পূর্নাজ্ঞ জীবনব্যবস্থা হিসাবে স্ট্যাটাস কো'-কে চ্যালেঞ্জ করবেই। তাই আধুনিকতার সাথে সংঘাত হলে তারা কমপ্রোমাইজ করেন না, বরং দ্বীনের উপর অটল থাকার চেষ্টা করেন, সেটা যতই কঠিন হোক না। নিজের কাজকর্মে ভুলত্রুটি থাকলেও সেটাকে অ্যাকনলেজ করেন, জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেন না।
আমাদের প্রত্যেকের নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত: আমি কোন ক্যাটাগরিতে পড়ি?
- আমার ইসলাম কি 'কনজিউমার স্পিরিচুয়ালিটি' যেখান থেকে আমি অন্তরের শান্তি খুঁজি মাত্র, কিন্তু আমার আসল জীবনে কোন স্যাক্রিফাইস করতে আমি প্রস্তুত না?
- নাকি আমার ইসলাম শুধুই একটা 'কালচারাল আইডেন্টিটি', যেটা আমাকে একটা কমিউনিটি দেয়, কিন্তু আমার ঈমান-আমল-আখলাকের সাথে তার কোনো গভীর সম্পর্ক নেই?
- নাকি আমি সত্যিই চাই যে আমার ইচ্ছাকে আমার রবের সামনে সমর্পণ করতে? সত্যিই চাই ইসলাম আমার পুরো জীবনে প্রতিফলিত হোক - তা যতই কঠিন হোক, যতই সমাজের মূলধারার বিপরীত হোক?
প্রথম দুই ধরনের ইসলাম বেশ 'নিরাপদ ইসলাম' - এতে দুনিয়াতে তেমন কোনো মূল্য দিতে হয় না, কোনো রিস্ক নেই। কিন্তু,তৃতীয় ধরণে প্রবেশ করতে আপনাকে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করা লাগতে পারে - বন্ধুবান্ধব, লাইফস্টাইল, হারাম ইনকাম সোর্স, ইত্যাদি।
কুরআনে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:
"তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে ঈমান আনো এবং কিছু অংশে কুফরী করো ? তাহলে তোমাদের যারা এরুপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ও অপমান এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে কঠিনতম শাস্তির দিকে। আর তারা যা করে আল্লাহ্ সে সম্পর্কে গাফিল নন।" (সূরা বাকারা: ৮৫)
আরেকটি আয়াতে:
"হে মুমিনগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের জন্য প্রকাশ্য শত্রু" (সূরা বাকারা: ২০৮)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাদের সবাইকে প্রকৃত অর্থে মুসলিম হওয়ার তাওফিক দান করুন। এমন মুসলিম হওয়ার তাওফিক দিন, যারা ইসলামকে শুধু একটা আইডেন্টেটি মনে করে না, বরং পুরো জীবনের দিশা হিসেবে গ্রহণ করে। আমীন।
©️আহমেদ শাফি