18/03/2020
#করোনাভাইরাস
ইলেকট্রন (ইলেকট্রনিক নয়) অণুবীক্ষণে দেখলে করোনাভাইরাসের চারপাশে একটা রাজকীয় মুকুটের মতো গঠন আছে বলে মনে হয়। তাই মুকুটের প্রতিশব্দ করোনা থেকে এই নাম। করোনাভাইরাসের ( সংক্ষেপে CoV) ২০০ প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে কেবল সাতটি মানুষকে আক্রান্ত করে। তার মধ্যে তিনটি প্রজাতি মানুষের জন্য মারাত্মক: SARS-CoV (সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস) MERS-CoV (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস) এবং 2019-nCoV ২০১৯ সালের নতুন বা নভেল করোনাভাইরাস) শেষোক্তটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে। ভাইরাসের এই নামটি প্রাথমিকভাবে দেওয়া হয়েছিল। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর স্থায়ী নাম দেয় covid-19।
#কোথা_থেকে_এল?
কমপক্ষে ১০ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিল করোনাভাইরাস। তখন থেকেই বাদুড় প্রভৃতি স্তন্যপায়ী ও পাখিতে (অর্থাৎ উষ্ণ রক্তের প্রাণীতে) করোনাভাইরাসের বিভিন্ন প্রজাতি পাওয়া যায়। সেগুলো বাদুড়ের দেহে কোনো অসুখ তৈরি করে না। তবে বাদুড় থেকে অন্যান্য জীবে সংক্রমিত হলে অসুখ হতে পারে। প্রাণী থেকে মানুষে জীবাণু ছড়ানোকে বলে জুনোসিস। বিভিন্ন জীবের মধ্যে জৈব অভিব্যক্তিক সম্পর্ক থাকার কারণে এটি সম্ভব হয়। মিউটেশন, জেনেটিক প্রফিট, প্রাকৃতিক নির্বাচন ইত্যাদি উপায়ে ভাইরাসের জিনোম এবং কাঠামো ক্রমাগত পাল্টাতে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে, উহানের সামুদ্রিক খাবার ও বন্যপ্রাণী বিক্রির কাঁচাবাজার থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে অভিব্যক্তির কারণে ভাইরাসটি পাল্টে যাচ্ছে। বাড়ছে তার সংক্রমণ ক্ষমতা।
#কীভাবে_আক্রমণ_করে
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যেহেতু আরএনএ জিনোম থাকে তাই কোষের ভেতরে সরাসরি তা থেকে প্রোটিন তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে তৈরি হয় আরএনএ জিনোমের অসংখ্য অনুলিপি। তবে এই কাজের জন্য কিছু প্রোটিন দরকার যেগুলো আগে থেকে বহুকোষী জীবের (যেমন মানুষ,বাদুড় ইত্যাদি)কোষে থাকে না।জিনোমের অনুলিপি করতে আরএনএ ডিপেন্ডন্ট আরএনএ পলিমারেজ, বিভিন্ন ভাইরাল প্রোটিনকে সুবিধামতো আকারে কেটে নিতে বিশেষ প্রোটিয়েজ এনজাইম ইত্যাদি। এগুলোকে বলে নন-স্ট্রাকচারাল প্রোটিন,কেননা এগুলো শেষ পর্যন্ত ভাইরাসের স্ট্রাকচার বা কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হয় না। এভাবে একটি ভাইরাস কোনো কোষে ঢুকে সেই কোষের যন্ত্রপাতি ও পুষ্টির শেষ নির্যাসটুকু পর্যন্ত ব্যবহার করে শত-সহস্র নতুন ভাইরাস কণা তৈরি করার জন্য । ভাইরাসের এনভেলপে যে ফসফোলিপিড থাকে, সেটাও আসলে আক্রান্ত কোষের ঝিল্লির অংশ ছিল।
একটি বিশেষ নকশার তালা খুলতে যেমন একটি সুনির্দিষ্ট নকশার চাবি প্রয়োজন, তেমনি কোনো ভাইরাসকে যদি কোনো কোষে ঢুকতে হয়, তাহলে ভাইরাসের পৃষ্ঠে থাকা কোনো প্রোটিনের সঙ্গে সেই কোষের পৃষ্ঠতলে থাকা কোনো প্রোটিনের গঠন খাপে খাপে মিলতে হবে।এজন্য সব ভাইরাস সব জীবে কিংবা কোনো জীবের সব কোষে ঢুকতে পারে না। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সাধারণত তার স্পাইক প্রোটিন সেই চাবির কাজ করে। সার্স করোনাভাইরাসের মতো covid-19 এর ক্ষেত্রেও টার্গেট কোষের টার্গেট প্রোটিন (অর্থাৎ কোষীয় থালা) হলো এনজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম নং ২ (ACE2) নামে একটি প্রোটিন । এই ACE2 রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফুসফুস ও কিডনিতে এটি বেশি সংখ্যায় থাকে বলে এই ভাইরাসের আক্রমণে এই দুটি অঙ্গই সর্বাগ্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ভাইরাস কর্তৃক শরীর আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অযাচিত আচরণের কারণেও রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ রক্ষকই যখন ভক্ষক হয়, তখন আর কিছু করার থাকে না।
#আক্রান্ত_হয়েছি_কিনা_বুঝব_কিভাবে?
সাধারণ সর্দি-কাশি থেকে এর লক্ষণে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। জ্বর থাকতে পারে। সাধারণত কাশিটা হয় শুকনা গোছের, কোনো কফ বের হয় না। সঙ্গে ডায়রিয়া থাকতে পারে। অনেকের শরীরে তো সেটুকু লক্ষণও প্রকাশ করে না। তবে যাদের বেলায় এটা নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (বিশেষ করে ফুসফুস ও কিডনি) বিকল হওয়ার দিকে মোড় নেয়, তাদের ক্ষেত্রে এটা মারাত্মক। তখন রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া লাগতে পারে।
১২ থেকে ১৮ বয়সী শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি ডায়াবেটিসের রোগী, যক্ষ্মা রোগী, গর্ভবতী, ক্যানসার ক্যান্সার কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি পাওয়া ব্যক্তি, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তারাই মূলত রোগটির জন্য সর্বাধিক ঝুঁকিতে আছে। এই লেখা পর্যন্ত (২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০) প্রাপ্ত উপাত্ত অনুসারে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৮ হাজার এবং মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৩০০ এর বেশি। ভাইরাসটি ছড়ায় সরাসরি সংস্পর্শ থেকে এবং বাতাসে ভর করে। কাপড়, ডোরনব, হাতল, রেলিং, মোবাইল ফোন, রিমোট ইত্যাদি পৃষ্ঠতলে ভাইরাসটি বেশ কয়েক দিন পর্যন্ত সংক্রমণক্ষম অবস্থায় থাকতে পারে।
সন্দেহজনক রোগীর শ্বাসতন্ত্র থেকে সংগৃহীত নমুনা কিংবা রক্ত পরীক্ষা করে সংক্রমণের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। আপাতত দেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (IEDCR) নামের সরকারি গবেষণাগারে PCR নামের একটি পরীক্ষার মাধ্যমে এটা জানা যাবে যে নমুনায় ভাইরাসটির আরএনএ উপস্থিত আছে কি না।
#বাঁচার_উপায়_কি?
ব্যাকটেরিয়ার কাজ করে যেসব ওষুধ, অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক, আমাদের মতো বহুকোষী জীবের তুলনায় ভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে বংশবৃদ্ধি করে বলে এদের টার্গেট করা সহজ। তবে ভাইরাসবিরোধী ওষুধ তথা অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগসমূহ ততটা নিবিড়ভাবে কাজ করতে পারে না, কেননা ভাইরাস তার বংশবৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করে আমাদেরই কোষের কলকবজাগুলো। তাই দেহের কোষের ভেতরে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি ঠেকাতে গেলে অনেক সময় নিজের কোষীয় যন্ত্রপাতিগুলোকেই আক্রমণ করতে
হয়। তারপরও চেষ্টা করা হচ্ছে ভাইরাসের জীবনচক্রের সেই রাসায়নিকগুলোকে আক্রমণ করার, যেগুলো আমাদের দেহের অংশ নয়। যেমন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিন, আরএনএ ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ, বিশেষ প্রোটিয়েজ এনজাইম ইত্যাদি। তবে সেই প্রচেষ্টা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। করোনাভাইরাস দ্রুত বিবর্তিত হয় বলে এর বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা তৈরি করাও খুব কঠিন। টিকা কাজ করে ভাইরাসের বিভিন্ন প্রোটিনের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার মাধ্যমে। কিন্তু সেই প্রোটিনগুলোর গঠনই যদি হুটহাট পাল্টায় তাহলে টিকা কোনো কাজে লাগে না।
তাই covid-19 থেকে বাঁচার নিশ্চিত উপায় আপাতত একটাই, আক্রান্ত না হওয়া। নিয়মিত হাত সাবান দিয়ে ধুতে হবে,পারলে সাবান দিয়ে। অন্তত ৩০ সেকেন্ড ধরে। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি যাওয়া যাবে না। রোগাক্রান্ত হয়ে কেউ বাড়িতে চিকিৎসাধীন থাকলে তার ঘরে শুধু সেবাদানকারী ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ যাবে না, তাও সব সতর্কতা মেনে। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে রোগীও বের হবেন না। এর ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা সুপ্তিকাল ২-১৪ দিন পর্যন্ত। অর্থাৎ ভাইরাস শরীরে ঢোকার পর থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত কেউ কোনো প্রকার লক্ষণ প্রকাশ না-ও করতে পারে। অথচ তখনো কিন্তু ভাইরাসটি তার থেকে ছড়ায়। তাই বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন আগমনস্থলে শুধু স্বর্দিজ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নয় বরং রোগটির প্রাদুর্ভাব আছে এমন এলাকা থেকে আসা সব যাত্রীকে পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। সম্ভব হলে তাকে দুই সপ্তাহ পৃথক করে (অর্থাৎ কোয়ারেন্টাইন) রাখতে হবে। না হলে অন্ততপক্ষে প্যাসেঞ্জার লোকেটর ফর্ম নামের একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে তার গতিবিধি নজরদারিতে রাখতে হবে। ইতিমধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিকটবর্তী কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে করোনাভাইরাস সন্দেহভাজন যাত্রী বা ব্যক্তিদের জন্য পৃথক ইউনিট খোলা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রোগটি মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসেবাদাতাদের জন্য গাইডলাইন প্রস্তুত করছে।
#মাস্ক_ব্যবহার_করে_লাভ_হবে_কি?
সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার পরলে ধুলোবালি থেকে বাঁচা যায় ঠিকই, তবে ভাইরাস থেকে নয়। অবশ্য আক্রান্ত ব্যক্তি এটি পড়তে পারেন, যাতে তার শ্বাসতন্ত্র থেকে বাতাসে ভাইরাসটি কম ছড়ায়। আর সুস্থ ব্যক্তি, যিনি ভাইরাস থেকে বাঁচতে চান তিনি N95 রেসপিরেটর মাস্ক পরলে আংশিক সুরক্ষা পাবেন। এটি ০.৩ মাইক্রন ব্যাসের ৯৫ শতাংশ কণা আটকে দেয়। তার চেয়ে বড় আকারের কণা তো আটকাতে পারেই। এজন্য এর নামের একটি অংশ N95। করোনা ভাইরাসের আকার প্রায় ০.১২মাইক্রন হলেও সাধারণত বাতাসে এটি গড়ে ৫ মাইক্রন আকারের জলকণায় চেপে ভেসে বেড়ায় বলে N95 মাস্ক একে ফিল্টার করতে পারে। আর তেলজাতীয় পদার্থ আটকাতে পারে না(Not resistant to oil)।সেজন্য মাস্কের নামের প্রথম অংশটি N। দুইয়ে মিলে N95। এতে থাকা অনুবীক্ষণিক ছিদ্রগুলো ময়লা জমে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শ্বাসকার্য বা রেসপিরেশনের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস সরবরাহ করে বলে নামের সঙ্গে রেসপিরেটরি শব্দ জুড়ে দেয়া হয়েছে। আসলেই কোনো মাস্ক রেসপিরেটর তকমার উপযুক্ত কিনা, তা নির্ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ (NIOSH)। এই সংস্থা কর্তৃক অনুমোদনের বৈধ সিল না থাকলে ধরে নিতে হবে মাস্কটি নকল।
N95 আঁটসাঁটভাবে না পরলে কোনো লাভ নেই। আর কিছুক্ষণ পরে থাকলে গুমোট ভাব হয় বলে অনেকে তা আলগা করে পরেন, যা না পড়ারই সমতুল্য। একটা মাস্ক, সেটা N95 হোক বা সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক, অবশ্যই কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনের বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে মাস্কটি ময়লা হয়ে গিয়ে বরং রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। করোনাভাইরাস যেহেতু চোখের সংস্পর্শে এসেও সংক্রমণ ঘটাতে পারে, সেহেতু মাস্ক সেক্ষেত্রে কোনো সুরক্ষা দেয় না। যাঁরা এই ভাইরাসের নমুনা নিয়ে গবেষণাগারে কাজ করেন কিংবা সরাসরি রোগীকে চিকিৎসা দেন, তাঁদের বেলায় অবশ্য শুধু মাস্ক নয়, বিশেষ চশমাসহ সব ধরনের সুরক্ষামূলক উপকরণ ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।
#লেখক
#সৌমিত্র_চক্রবর্তী
#সহকারী_অধ্যাপক
#বঙ্গবন্ধু_শেখ_মুজিব_মেডিক্যাল_বিশ্ববিদ্যালয়
নোট: লেখাটি "মাসিক চলতি ঘটনা বাংলাদেশ ও বিশ্ব" মার্চ ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
ছবি: বণিক বার্তা