27/07/2025
🌿 নীরব আর্তনাদ: ২৩ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু না বলা সত্য
=================================
আমি গত ২৩ বছর ধরে নানা বয়স, শ্রেণি ও পটভূমির মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি—সেবা দিয়েছি, সহানুভূতি দেখিয়েছি, পাশে দাঁড়িয়েছি। এই দীর্ঘ যাত্রায় আমি দেখতে পেয়েছি এমন অসংখ্য মানুষ, যারা সমাজের চোখে “নাজুক” — অথচ মানুষ হিসেবেই তাদের মূল্যায়ন করা হয় না।
এই মানুষগুলো বিভিন্ন জায়গায়, সময়ে ও পরিবেশে নানা ধরনের পীড়নের শিকার হন।
আর সবচেয়ে দুঃখজনক হলেও নির্মম সত্য হলো—এই পীড়নের পেছনে বহুক্ষেত্রেই দায়ী থাকে নিজস্ব পরিবার, যার কাছে তাদের সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা ছিল।
তাই আমি এখন লিখতে চাই, বলতে চাই, এই অব্যক্ত পীড়নের গল্প—যা হয়তো কেউ বলতে চায় না, আর কেউ শুনতেও চায় না।
❗ “পীড়ন” বলতে আমরা কী বুঝি?
পীড়ন মানেই কেবল গায়ে হাত তোলা নয়।
এটি হতে পারে ঠাণ্ডা অবহেলা, অপমানজনক কথা, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ, মানসিক চাপ কিংবা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া—সবই পীড়ন, যদি তা কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে, মর্যাদাকে পদদলিত করে বা তাকে দুর্বল ও নিয়ন্ত্রণাধীন করে তোলে।
পীড়ন মানে কারও স্বাধীনতা, মর্যাদা ও নিরাপত্তার ওপর হস্তক্ষেপ—ইচ্ছাকৃত, ধারাবাহিক এবং ধ্বংসাত্মক।
💬 কেন “Abuse” এর বাংলায় “পীড়ন” শব্দটি ব্যবহার করছি?
ভাষার সৌন্দর্য ও কার্যকারিতার দিক থেকে “পীড়ন” শব্দটি অনেক বেশি উপযুক্ত। এটি শ্রুতিমধুর, সহজে উচ্চারিত ও দৈনন্দিন ব্যবহারে বেশি প্রচলিত। আমরা যেমন বলি “আর্থিক পীড়ন”, “মানসিক পীড়ন” বা “শারীরিক পীড়ন”—তেমনই এ শব্দগুলোতে অর্থের গভীরতা ও স্পষ্টতাও থাকে।
অন্যদিকে, “নিগ্রহ” শব্দটি কিছুটা পুরাতন সাহিত্যধর্মী ও জটিলতা বোধক, যা অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক আলোচনায় ভারী ও দূরত্ব তৈরি করে।
বিশেষ করে প্রবীণ পীড়ন বা পারিবারিক পীড়নের মতো প্রসঙ্গে “পীড়ন” শব্দের ব্যবহারই আজকের সমাজে বোধগম্য, প্রাসঙ্গিক ও মানবিক।
🔍 পীড়নের ধরন কত রকম?
আমরা অনেকেই ভাবি পীড়ন মানেই গায়ে হাত তোলা, চিৎকার করা বা যৌন হয়রানি।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, পীড়নের অনেক রূপ আছে—যার অনেকগুলো আমাদের চোখের সামনেই ঘটে, কিন্তু আমরা তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
একজন প্রবীণ বাবা নিজের পেনশনের টাকা ছেলে নিয়ন্ত্রণ করলেও কিছু বলতে পারেন না।
একজন মা বারবার অনুরোধ করেন ওষুধ এনে দেওয়ার জন্য, কিন্তু বাড়ির কেউই তা গুরুত্ব দেয় না।
একজন বৃদ্ধা ঠাণ্ডা ভাত খেয়ে চুপচাপ বসে থাকেন—কারণ নাতির গেম চলতেছে বলে কেউ গরম করে দিতে চায় না।
এগুলো কি পীড়ন নয়?
🔦 কিছু পীড়নের ধরন, যেগুলো আমরা অনেক সময় বুঝিই না:
১। আর্থিক পীড়ন – প্রবীণদের আয় বা সম্পত্তি দখল করে রাখা, অথচ নিজের মতো ব্যবহার করা
২। মানসিক পীড়ন – কথা বললে “বয়স হয়েছে, চুপ থাকো” বলা
৩। সামাজিক পীড়ন – আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগে বাধা
৪। চিকিৎসাগত পীড়ন – প্রয়োজনীয় ওষুধ বা চিকিৎসা না দেওয়া
৫। ভাষাগত পীড়ন – বারবার “তুমি কিছুই বোঝো না” বলা
৬। সাংস্কৃতিক পীড়ন – নিজস্ব পোশাক, ভাষা বা বিশ্বাস নিয়ে উপহাস করা
৭। তথ্য বা সিদ্ধান্ত থেকে বঞ্চিত পীড়ন – পারিবারিক সিদ্ধান্তে প্রবীণদের মত নেওয়া হয় না
৮। ভবিষ্যৎ অস্বীকৃতি – “এই বয়সে আর কিছু হবে না, খামোখা চিকিৎসা কেন?”
৯। ভবিষ্যৎকে জোর করে তৈরি করা পীড়ন – “তুমি এখন থেকে এই ঘরে থাকবে, কোথাও যেতে পারবে না”
এই তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। কারণ পীড়নের রূপ যতই বদলায়, তার মূল ঠিক একই রয়ে যায়—একজন মানুষকে তার স্বাধীনতা ও সম্মান থেকে বঞ্চিত করা।
✊ আমরা কী করতে পারি?
• প্রথম কাজ, চোখ খুলে দেখতে শেখা—নীরব পীড়নের সংকেতগুলো বুঝতে হবে।
• তারপর, ভাষায় এবং আচরণে মানবিক হওয়া—প্রতিদিনের কথায় যেন অপমান না থাকে।
• পরিবারে প্রবীণদের জন্য সময় রাখা, তাদের সম্মান দেওয়া, নিজের আচরণে পরিবর্তন আনা।
• রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে প্রবীণদের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
🌱 শেষ কথা:
আমার এই লেখা, এই কথা বলা, এই প্রতিরোধ গড়ার প্রয়াস—এটি শুধু এক ব্যক্তির চিন্তা নয়।
এটি সেই অগণিত মুখের প্রতিনিধি, যারা প্রতিদিন পীড়নের শিকার হলেও চুপ থাকে।
যারা ধীরে ধীরে নীরব হয়ে যায়, মিশে যায় দেয়ালের সঙ্গে—কিন্তু বুকের ভিতর চিৎকার করে ওঠে।
আমি তাদের হয়ে লিখব, আমি তাদের হয়ে বলব।
কারণ পীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে শুধু অন্য কারও পাশে দাঁড়ানো নয়—বরং নিজেকেও আরও মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা।
🔔 আপনি যদি এই পথচলায় আমার সঙ্গী হন, তাহলে আমরা একসাথে অসংখ্য নীরব আর্তনাদকে আওয়াজ দিতে পারব।
চলুন, পীড়নের মুখোশ খুলে ফেলি।