04/11/2025
ডায়াবেটিস বা ব্লাড সুগার আজকের দিনে একটি বড় উদ্বেগের কারণ। এটি একটি মেটাবলিক ডিসঅর্ডার যেখানে কিছু হরমোনের কর্মহীনতার (ডিসফাংশন) কারণে রক্তে সুগার বা গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। ডায়াবেটিসের কোনো নির্দিষ্ট বয়স থাকছে না এবং অল্প বয়সেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
ডায়াবেটিস কী ও কারণ
ডায়াবেটিস মানে শুধু সুগার বেশি হওয়া নয়। বিশেষ করে সবচেয়ে সাধারণ প্রকার, টাইপ টু ডায়াবেটিস (যা প্রায় ৯০% রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়), তার সঙ্গে স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ (ব্লাড প্রেসার), লিপিড প্রোফাইলের সমস্যা এবং রক্ত ক্লট করার প্রবণতাও যুক্ত থাকে।
এর কারণ হলো পরিবেশগত এবং জেনেটিক্স বা বংশগত কারণের একটি সংমিশ্রণ। যেহেতু জিন পরিবর্তন করা যায় না, তাই পরিবেশগত উপাদানগুলির উপরই বেশি জোর দেওয়া হয়।
ডায়াবেটিসের সঙ্গে জড়িত মূল হরমোনটি হল ইনসুলিন, যা রক্তে সুগারের মাত্রা কম রাখতে কাজ করে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, মাত্র একটি হরমোন সুগার কম রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু অন্তত চারটি হরমোন সুগার বাড়ানোর চেষ্টা করে।
▪️টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস: এতে ইনসুলিন তৈরি হয় না। এটি তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়।
▪️টাইপ টু ডায়াবেটিস: এতে ইনসুলিন তৈরি হলেও তা ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, যা ইনসুলিন রেজিস্টেন্স নামে পরিচিত।
জেনেটিক্স বাদে প্রধান সংশোধনযোগ্য কারণগুলি হলো:
1. স্থূলতা বা অতিরিক্ত চর্বি (বডি ফ্যাট): বিশেষ করে পেটের মধ্যে চর্বি জমা হওয়া (ইন্ট্রা অ্যাবডোমিনাল ফ্যাট) টাইপ টু ডায়াবেটিসের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর।
2. শারীরিক ব্যায়ামের অভাব।
3. স্ট্রেস ও ঘুমের অভাব: পর্যাপ্ত ঘুম (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অন্তত ৬-৭ ঘণ্টা সাউন্ড স্লিপ) স্বাস্থ্যের জন্য এবং ডায়াবেটিসের মতো মেটাবলিক রোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও, বর্তমানে ডায়াবেটিস বেশি ধরা পড়ার কারণগুলির মধ্যে রয়েছে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি (এটি বয়স বাড়ার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি রোগ) এবং রোগ নির্ণয় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।
লক্ষণ এবং পরীক্ষা
টাইপ টু ডায়াবেটিস ধীরে ধীরে বিকশিত হয় বলে অনেক ক্ষেত্রেই সুগার বেশি থাকা সত্ত্বেও রোগীর কোনো তাৎক্ষণিক লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তাই শুধু লক্ষণের ওপর নির্ভর করলে সকল ডায়াবেটিস রোগীকে সনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
ক্লাসিক্যাল লক্ষণগুলি সুগার মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার ফলে দেখা যায়, যা মূত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে।এগুলো হলো
1. অতিরিক্ত প্রস্রাব হওয়া (বহুমূত্র)।
2. অতিরিক্ত জল পিপাসা (পলিডিপসিয়া): শরীর থেকে জল বেরিয়ে যাওয়ার কারণে জল খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
3. খিদে বেশি পাওয়া: গ্লুকোজ বেশি থাকা সত্ত্বেও কোষগুলো তা ব্যবহার করতে পারে না, ফলে মস্তিষ্ক খাবারের অভাব অনুভব করে।
অন্যান্য সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে দুর্বলতা, ঘন ঘন সংক্রমণ বা ফোঁড়া হওয়া, কেটে গেলে শুকোতে দেরি হওয়া এবং দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া বা চশমার পাওয়ার ঘন ঘন পরিবর্তন।
ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য প্রধানত তিনটি পরীক্ষা করা হয়:
1. খালি পেটে সুগার টেস্ট: অন্তত ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা না খেয়ে এই পরীক্ষা করতে হয় (জল পান করা যেতে পারে)।
2. খাওয়ার পরের পরীক্ষা (পোস্ট-প্র্যান্ডিয়াল): সাধারণত ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে এটি করা হয়।
3. গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন (HbA1c): এই পরীক্ষাটি খাবার খাওয়া বা না খাওয়ার ওপর নির্ভর করে না এবং এটি গত দুই-তিন মাসের গড় সুগার নিয়ন্ত্রণের একটি ধারণা দেয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি
চিকিৎসার শুরুতে রোগীর সঙ্গে এবং তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রোগটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়, যাতে তারা চিকিৎসার গুরুত্ব ও দীর্ঘমেয়াদী প্রকৃতি বুঝতে পারে।
প্রাথমিকভাবে কিছু লক্ষ্যমাত্রা (টার্গেট) সেট করা হয়—যেমন শরীরের ওজন, রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং নির্দিষ্ট সুগারের মাত্রা (খালি পেটে, খাওয়ার পর এবং HbA1c) কত রাখতে হবে।
যদি সুগারের মাত্রা খুব বেশি না থাকে বা গুরুতর লক্ষণ প্রকাশ না পায়, তবে প্রাথমিকভাবে জীবনযাত্রার পরিবর্তন, যেমন খাদ্যভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
ওষুধ এবং ইনসুলিন
লাইফস্টাইল পরিবর্তন সত্ত্বেও সুগার নিয়ন্ত্রণে না এলে বা শুরুতেই সুগারের মাত্রা অত্যন্ত বেশি থাকলে (যেমন খালি পেটে ২৫০-এর বেশি, খাওয়ার দু’ঘণ্টা পর ৩৫০-৪০০ বা HbA1c ৯ বা ৯.৫-এর বেশি) ওষুধ বা ইনসুলিন শুরু করা হয়।
অত্যন্ত বেশি সুগার থাকলে প্রথমে ইনসুলিন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে পরে ট্যাবলেটে ফেরত যাওয়া যেতে পারে। তবে, ডায়াবেটিসের মূল সমস্যাটি থেকে যায় বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওষুধ একবার শুরু করলে তা বন্ধ করা যায় না, বরং চালিয়ে যেতে হয়, যদিও ডোজ কমানো যেতে পারে।
শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও যাদের হাঁটুর ব্যথা বা অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হয়, তাদের জন্য নন-ওয়েট বিয়ারিং এক্সারসাইজ (যেমন হাত ঘোরানো বা সাঁতার) করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই ধরনের ব্যায়াম হাঁটার তুলনায় কম কার্যকরী হতে পারে, তাই এর সময়কাল বাড়াতে হতে পারে ।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া এবং খাদ্যাভ্যাস
সুগারের কিছু ওষুধ বা ইনসুলিন ব্যবহারের ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা অত্যধিক কমে যেতে পারে (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ গ্লুকোজ সরবরাহ কমে গেলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়, যার ফলে ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, খিঁচুনি হতে পারে এবং এমনকি ১৫ মিনিটের মধ্যে মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাই সুগার কমানোর ওষুধ বা ইনসুলিন নিলে সময়মতো খাওয়া খুব দরকার। কর্মব্যস্ত জীবনে খাবার খেতে দেরি হলে সামান্য বিস্কিট বা কিছু একটা সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।
✍️নিলুফার ইয়াসমিন দিপা
ফুড এন্ড নিউট্রিশন