11/04/2025
ASAD HOLISTIC HEALTH-দৈনন্দিন স্বাস্থ্য কথা- Episode-6
উচ্চ রক্ত চাপ, স্ট্রোক এবং হার্ট এটাক বলতে কী বোঝায়?
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
এই এপিসোড প্রথম পাবলিকেশনের তারিখ : Episode 16- Tuesday, June 12, 2018 at 11:33 PM
যেকোনো জিনিসের ত্রুটিবিহীন ডিজাইন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ডিজাইনে কোনো ত্রুটি নেই৷ তাই আমাদের দেহের প্রতিটা পার্টস নির্ভুল ডিজাইনে তৈরি। এমনই একটি অর্গান হার্ট এবং তার প্রেসার সম্পর্কে আজ লিখব ৷
হার্ট এবং পানি তোলা পাম্পের ফাংকশনাল ডিজাইন একই, আর শিরা হলো হার্টের সাকশন হেড এবং ধমনী হলো ডিসচার্জ হেড ৷ হার্ট রক্ত পাম্প করে ডিসচার্জ হেড অর্থাৎ ধমনীতে ছেড়ে দেয় আর শিরার মাধ্যমে সাকশন করে হার্টে ফিরিয়ে নেই ৷
সংক্ষেপে প্রেসার বলতে বুঝায় গ্যাস বা তরলের অণু যে পাত্রে থাকে তার ওয়ালে যে ধাক্কা দেয়, সেটাই প্রেসার ৷ এই ধাক্কার পরিমাপ হলো প্রতি বর্গ ইঞ্চি জায়গায় গ্যাস বা তরলের অণু কতৃর্ক প্রয়োগ কৃত বল ৷ গ্যাসের সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে, তার চাপ কম বা বেশি তা নির্ভর করে তাতে অণুর সংখ্যা কম বা বেশির উপরে ৷ অণুর সংখ্যা বেশি মানে, প্রতি বর্গ ইঞ্চি জায়গায় ধাক্কার সংখ্যা বেশি ফলে প্রেসার বেশি ৷ তরলের ক্ষেত্রে, মনে করি একটি ড্রামের মধ্যে পানির উচ্চতা ৬ ইঞ্চি, তাহলে ওই ড্রামের ওয়ালের উপরে পানির একটা নির্দিষ্ট চাপ পড়বে ৷ কিন্তু যদি পানির উচ্চতা ৩ ফুট হয় তবে তার প্রেসার অনেকগুন বেশি হবে ৷ অর্থাৎ তরল বা গ্যাসের চাপ হলো তার পাত্রের গায়ে প্রয়োগকৃত বল ৷
কৃষকের ধান ক্ষেতের ইরিগেশন সিস্টেমের দিকে তাকালে আমরা কী দেখি ? ডিপ টিউবঅয়েল বা শ্যালো মেশিনে মাটির নিচ থেকে পানি তুলে ক্যানেলের মধ্যে ছেড়ে দেয় ৷ পানি ক্যানেলের মধ্যে দিয়ে ধান খেতে পোঁছায় ৷ ওই পানি ক্যানেলের ওয়ালে বল প্রয়োগ করে বা ধাক্কা দেয় যা ওয়ালের উপরে প্রেসার সৃষ্টি করে ৷ যদি ওয়াল শক্ত না হয়, তাহলে তা ভেঙে পানি বের হয়ে যাবে ৷ অথবা সোজা ক্যানেলের মধ্যে যদি হঠাৎ চিকন হয়ে যায় তাহলে পানি প্রবাহে বাধা বেড়ে যাবে ফলে ক্যানেলের ওয়ালে ধাক্কা বা বল বা প্রেসার বেড়ে যাবে, ফলে ক্যানেল ভেঙে পানি বেরিয়ে যাবে ৷ আরেকটি উদাহরণ, ফুল বাগানে বা যেকোনো গাছে আমরা প্লাস্টিক টিউব লাইনের মাধ্যমে পানি দিয়ে থাকি। পানির টিউবের ব্যাসার্ধ ঠিক থাকায় একটা নির্দিষ্ট প্রেসারে টিউবের মধ্যে দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে গাছ পর্যন্ত পোঁছায় ৷ পানি একটু দূরে পাঠানোর জন্য আমরা টিউবের মুখে চেপে ধরি, ফলে টিউবের পানির প্রেসার বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত প্রেসারের কারণে পানি দূরে যায় ৷ সাপ্লায়ের চাইতে ডিসচার্জ কমে গেলে প্রেসার বেড়ে যায়, তাই সাপ্লাইয়ের চাইতে ডিসচার্জ কোনোমতেই কমানো যাবে না ৷ যদি তা হয় তবে টিউব একসময় ফেটে যাবে ৷ এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই জানে, কিন্তু হার্টের প্রেসার সম্পর্কে খুব কম লোকই জানে ৷ কিন্তু বিষয়গুলো হুবহু একই ৷
বলেছি সৃষ্টিকর্তার ডিজাইনে ভুল নেই ৷ অর্থাৎ আমাদের হার্ট কতটুকু রক্ত পাম্প করবে আর তার জন্য কত ব্যাসার্ধের টিউব লাগবে, ধমনী, তা নির্ভুলভাবে ডিজাইন করা ৷ ধমনীর ওয়াল, ক্যানেল বা টিউবের মতো শক্ত নয়, বরং নমনীয় ৷
হার্ট সংকোচন এবং রিলাক্সেশনের মাধ্যমে রক্ত পাম্প করে ৷ যখন সংকুচিত হয় তখন রক্ত হার্ট থেকে ধমনীতে যায়, আর যখন রিলাক্স স্টেটে ফিরে আসে তখন শিরা থেকে রক্ত হার্টে প্রবেশ করে ৷ হার্ট সংকোচনের ফলে রক্তের উপরে যে প্রেসার পড়ে সেটাকে সিস্টোলিক প্রেসার বলে আর এই প্রেসার ধমনীর ওয়ালে পড়ে ৷ আবার হার্ট যখন রিলাক্সে আসে তখন তার আরেকটি প্রেসার তৈরি হয় সেটাকে ডায়াস্টোলিক প্রেসার বলে ৷ অর্থাৎ হার্ট রিলাক্সে আসলে ধমনী ও রিলাক্সে আসে ৷
ডাক্তাররা প্রেসার মাপে হার্টে না হাতে ৷ কারণ হার্ট সংকুচিত হলে ধমনীতে হাই প্রেসার পড়ে আবার হার্ট রিলাক্সে আসলে ধমনীতে লো প্রেসার পড়ে ৷ এজন্য সিস্টোলিক প্রেসার হাই এবং সর্বোচ্চ মাত্রা ১৪০ মিলিমিটার মার্কারি আর ডায়াস্টোলিক প্রেসার লো এবং সর্বোচ্চ লিমিট ৯০ মিলিমিটার মার্কারি ৷
এখন হাই প্রেসার রোগ বলতে কী বুঝায় ?
যদি কোনো কারণে ধমনীর ব্যাসার্ধ কমে যায় তাহলে রক্ত প্রবাহের বাধা বা ধাক্কা বেড়ে যায়, অর্থাৎ প্রেসার বেড়ে যায় ৷ ১৪০ এর উপরে সিস্টোলিক প্রেসার গেলে অথবা ৯০ এর উপরে ডায়াস্টোলিক প্রেসার গেলে হাই প্রেসার রোগ বলা হয়। নিচেরটা ৯০ এর উপরে গেলে বেশি ক্ষতিকর ৷ হার্ট যদি কমপ্লিট রিলাক্সে ফিরে আসে তবে তার প্রেসার হবে ৯০ এর নিচে ৷ কিন্তু এই প্রেসার যদি ৯০ এর নিচে না আসে তবে বুঝতে হবে যে হার্ট কখনই রিলাক্স পাচ্ছে না ৷
মানুষ যদি দিনে এবং রাতে রিলাক্স না করে সমানে কাজ করে, তবে এক সপ্তাহও বাঁচবে না ৷ তাই হার্ট যদি তার প্রক্রিয়ায় রিলাক্স স্টেটে না আসতে পারে তা হলে খুব তাড়াতাড়ি ড্যামেজ হয়ে যাবে ৷ স্লিপিং মুডে রক্ত সঞ্চালন কম হয়, ফলে পুরা ব্লাড সার্কুলেশন সিস্টেম একটু রিলাক্স পাই ৷ এ কারণে অমরা হার্টের রুগীদেরকে বা সবাইকে নিয়মিত এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ, প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ৬ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমাতে বলি ৷
এখন ধমনীর ব্যাসার্ধই বা কমবে কেন আর রক্তের প্রেসারই বা বাড়বে কেন ৷ আমাদের ভুলের কারণেই তা হয় ৷ প্রাপ্ত বয়সে আমরা যে খাবার খায় তা সম্পূর্ণরূপে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার কথা ৷ কিছু অংশ অবশ্য প্রোটিনে রূপান্তরিত হয়ে শরীরের ক্ষয় পূরণ করে ৷
খাবার সম্পূর্ণরূপে শক্তিতে রূপান্তরিত হতে সমানুবিক পরিমান অক্সিজেন সাপ্লাই দিতে হয় ৷ আপনার শরীরে যদি মেদ জমে তাহলে জানতে হবে আপনি পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন সাপ্লাই দিচ্ছেন না ৷ ফলে খাদ্যের একটি অংশ ফ্যাট আকারে, ট্রাই-গ্লিসারাইড, শরীরে জমে যাচ্ছে ৷ কোলেস্টেরলও এক প্রকার ফ্যাট যা দুই প্রকার, LDL এবং HDL ৷ ডাক্তার এবং আমরাও বলি LDL হলো খারাপ কলেস্টেরল, আর HDL ভালো কোলেস্টেরল ৷ ফ্যাট এবং তেল একই জিনিস, পার্থক্য শুধু ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে তাপমাত্রাই ফ্যাট কঠিন আর তেল তরল অবস্থায় থাকে ৷ LDL এবং HDL এর পার্থক্য এক্সাক্টলি ফ্যাট এবং তেলের মতো ৷ LDL শরীরের তাপমাত্রায় জমে কঠিন হয়ে যায় আর HDL তরল অবস্থায় থাকে ৷ HDL ভালো এজন্যই যে, LDL কে জমতে দেয় না, বরং LDL কে HDL এর মধ্যে দ্রবীভূত করে লিভারে নিয়ে যায় যেখানে LDL ভেঙে শরীর থেকে বেরিয়ে যায় ৷
এখন ক্লিয়ার বুঝা যাচ্ছে যে, যদি রক্তে LDL বেশি হয়, তবে তা রক্ত নালীর ওয়ালে জমে যাবে ৷ এই অবস্থাকে আমরা বলি হাই কোলেস্টেরল ৷ এই সময় ট্রাই গ্লিসারাইডও কোলেস্টেরলের সাথে মিশে জমতে থাকে ৷ যেহেতু দুটাই তৈলাক্ত ফলে শরীরে তৈরি ইনঅর্গানিক বা অর্গানিক আরও অপদ্রব্য কলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের সাথে জমা হতে থাকে ৷ এই জমাকৃত বস্তুকে প্লাক বলে ৷ প্লাক জমার বিষয়টি ঠিক যেন মৌচাকের মতো, একটি রানী মৌমাছি কোথাও বসলে তাকে ঘিরে হাজারো মৌমাছি সেখানে বসে যায়, ফলে বিশালাকার মৌচাক তৈরি হয়ে যায় ৷ রক্ত নালিতে কোথাও একটু কোলেস্টেরল জমলেই তাকে ঘিরে অন্য সকল অপদ্রব্য জমে রক্তনালীকে সরু থেকে সরুতর এবং শেষে একেবারে বন্ধ করে দেয় ৷ এটাকেই বলা হয় হার্ট ব্লক |
এখন আর বুঝতে বাকি নেই যে রক্তের ওয়ালে কোনো এক জায়গায় মৌচাকের মতো কলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড, ইনঅর্গানিক সল্টস, অর্গানিক অপদ্রব্য জমে রক্তনালীর ব্যাসার্ধকে কমিয়ে দিতে পারে ৷ তখন রক্ত প্রবাহে বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে রক্তনালীর ওয়ালে রক্তের ধাক্কা বা প্রেসার বেড়ে যায় ৷ ব্যাসার্ধ খুব বেশি কমে গেলে, প্রেসার খুব বেশি বেড়ে যাবে ৷ এভাবে চলতে থাকলে এক সময় রক্তনালী পুরাটাই ব্লক হয়ে যাবে ৷ তখন রক্ত একেবারেই প্রবাহিত হতে পারে না। কিন্তু হার্টতো বসে নেয়, সে রক্ত পাম্প করেই যাচ্ছে ৷ ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রক্তনালী বেলুনের মতো সম্প্রসারিত হতে হতে ফেটে যাবে ৷ এটাকেই বলে স্ট্রোক। স্ট্রোক সাধারণত ব্রেইনে সংঘটিত হয় ৷
স্ট্রোক আর হার্ট এটাক এর মধ্যে পার্থক্য কী?
স্ট্রোক : এটা সাধারণত ব্রেইনে সংঘটিত হয় ৷ কারণ ব্রেইনের ধমনীর ওয়াল খুব পাতলা এবং সেখানে প্লাক জমলে রক্ত নালীর ওয়াল ফেটে গিয়ে ব্রেইনে রক্ত ক্ষরণ হয় ফলে ব্রেইনের সেল সঙ্গে সঙ্গে নিউট্রিয়েন্ট এবং অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় এবং ব্রেইন ফাংকশন বন্ধ হয়ে যায় ফলে মানুষ মারা যায় ৷
হার্ট এটাক : হার্টের নিজস্ব মাসলে রক্ত সরবরাহ করার জন্য কিছু ধমনী থাক ৷ যদি সেই ধমনীতে প্লাক জমে বন্ধ হয়ে যায় তবে হার্টের নিজস্ব মাসলে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় ফলে সেখানে নিউট্রিয়েন্ট অবং অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং হার্টের সেল মারা যায় ফলে হার্ট সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায় এবং মানুষ মারা যায় ৷ এই ঘটনাকেই হার্ট এটাক বলা হয় ৷
প্রতিকারের উপায় কী?
খুব সিম্পল ৷ যতটুকু খাবেন তার সমানুপাতিক হরে অক্সিজেন সাপ্লাই দিবেন ৷ সেটা একমাত্র সম্ভব উপযুক্ত পরিমাণ রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে, আর সেটা সম্ভব উপযুক্ত পরিমাণ ব্যায়াম, ইয়োগা, জগিং বা হাঁটার মাধ্যমে ৷ এগুলো করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, ফলে অক্সিজেন সাপ্লাই বাড়ে এবং সেলের মধ্যে combustion বিক্রিয়ার রেট বাড়ে, তাতে যেমন সমস্ত খাদ্য শেষ হয়ে যায় তেমনি বাড়তি শক্তিও উৎপন্ন হয় ৷ খাবার কম খেলে অক্সিজেন কম লাগবে, কম ব্যায়াম করলেও চলবে ৷ কিন্তু খাবার কম খেলে শক্তির অভাবে শরীর দুর্বল হতে পারে, ফলে নিউট্রিশনাল ফুড বা শক্তিশালী খাবার, বা সুপার ফুড খেতে হবে ৷
সাবান যেমন কাপড়ের বা শরীরের ময়লা দূর করে, সেইরকম প্লাক দূর করার জন্য হারবাল/ভেষজ জাতীয় সাপ্লিমেন্ট খেতে হবে |
আমার একটা নিজস্ব কোটেশন : ইকুয়েশন সিম্পল, প্রাকটিস করি না তাই সবই ভুল ৷
লেখক: প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ