22/10/2025
শোভা (ছদ্মনাম) চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। একসময় পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার ফলাফল খারাপ হতে শুরু করে। শিক্ষকরা লক্ষ্য করেন—শোভা ক্লাসে মনোযোগী থাকলেও হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে যায়। চোখ স্থির হয়ে থাকে, যেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। কিছুক্ষণ পর আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। আশ্চর্যের বিষয়, সেই সময়টায় ক্লাসে কী হচ্ছিল বা কী পড়ানো হচ্ছিল—সে কিছুই মনে রাখতে পারে না।
এ ঘটনা শুধু ক্লাসেই নয়; খেলতে খেলতে, মোবাইল গেম খেলতে কিংবা গল্প করার সময়ও শোভা হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের জন্য কোথাও হারিয়ে যায়। বিষয়টি সবার কাছেই রহস্যময় মনে হতে থাকে।
প্রথমে শোভার মা-বাবা এটিকে গুরুত্ব দেননি। ভেবেছিলেন, সাধারণ কোনো সমস্যা। তাই তাবিজ ও পানি পড়া দিয়েছেন, কিন্তু তাতে কোনো উপকার হয়নি। অবশেষে স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক শোভার বাবাকে পরামর্শ দেন—‘এটা কোনো ভৌতিক ব্যাপার নয়, ভানও নয়। একজন সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।’
সাইকিয়াট্রিস্ট শোভাকে পর্যবেক্ষণ করেন। চেম্বারের সিসি ক্যামেরায় দেখা যায়, মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে শোভা দশবার এমন অবস্থায় চলে গেছে। বাইরের চোখে এটি অদ্ভুত লাগলেও, আসলে এর পেছনে রয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা। শোভা এবসেন্স সিজার (Absence Seizure) নামের এক ধরনের মস্তিষ্কজনিত রোগে ভুগছে।
এই রোগে শিশুরা হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের জন্য পারিপার্শ্বিক জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়—তাই এর নাম এবসেন্স সিজার। এটি মৃগী বা এপিলেপ্সি রোগের একটি ধরন, তবে সাধারণ খিঁচুনির মতো হাত-পা কাঁপে না। সাধারণত ৪ থেকে ১৪ বছর বয়সে এই রোগ ধরা পড়ে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে শিশুরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
🧠 এবসেন্স সিজার কী?
এবসেন্স সিজার হলো এক ধরনের মৃগী রোগ (Epilepsy), যেখানে শিশু হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে যায় বা শূন্যে তাকিয়ে থাকে। এ সময় সে আশপাশের কোনো কিছুর প্রতি সাড়া দিতে পারে না। অনেক সময় এটি এত অল্প সময় স্থায়ী হয় যে বাবা-মা বা শিক্ষকরা প্রথমে বুঝতেই পারেন না।
📊 শিশুদের মধ্যে হার
গবেষণা অনুযায়ী, শিশুদের মধ্যে প্রায় ২-৮% ক্ষেত্রে এবসেন্স সিজার দেখা যায় (Wirrell, 2003, Epilepsia)। সাধারণত ৪ থেকে ১০ বছর বয়সে এটি বেশি শুরু হয়। মোট মৃগী রোগীদের প্রায় ১০-১৭%-এর মধ্যে এবসেন্স সিজার পাওয়া যায় (Panayiotopoulos, 2008, The Epilepsies)।
⚡ কারণ
এবসেন্স সিজারের সঠিক কারণ পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সংকেতের অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণে এটি ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে জিনগত প্রভাবও থাকতে পারে। এছাড়া ঘুমের অভাব, মানসিক চাপ বা ঝলমলে আলো কিছু শিশুর ক্ষেত্রে খিঁচুনির পরিমাণ বাড়াতে পারে।
🔍 লক্ষণ
শিশুদের এবসেন্স সিজারের সাধারণ ৫টি লক্ষণ হলো—
✅ কয়েক সেকেন্ড শূন্যে তাকিয়ে থাকা
✅ কথা বলা বা কাজ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া
✅ চোখ পিটপিট করা বা ঠোঁট নড়ানো
✅ দিনে বারবার এমন ঘটনা ঘটতে থাকা
✅ ঘটনার পর কিছুই মনে না থাকা
💊 চিকিৎসা
এবসেন্স সিজার সাধারণত ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সবচেয়ে ব্যবহৃত ওষুধ হলো Ethosuximide, Valproic acid ও Lamotrigine (Glauser et al., 2010, New England Journal of Medicine)। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই ওষুধ বন্ধ করা উচিত নয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে অধিকাংশ শিশুই পড়াশোনা ও দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।