18/08/2025
🩺 লিপিড প্রোফাইলঃ হৃদরোগের ঝুঁকির অন্যতম কারণ
রেগুলার চেক-আপে করা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোর একটি হলো লিপিড প্রোফাইল। অনেক সময় রোগীরা নিজেরাই লিপিড প্রোফাইল বা কোলেস্টেরল পরীক্ষা করে চিকিৎসকের চেম্বারে আসেন।
আজকের আলোচনায় জানব—এই রিপোর্টে আসলে কী বোঝানো হয়, কোন লিপিড ভালো, কোনটি খারাপ, কখন ওষুধ প্রয়োজন হয়, এবং কীভাবে লিপিড নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
লিপিড প্রোফাইলের মাধ্যমে শরীরে থাকা চর্বির (যেমন কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড) মাত্রা নির্ণয় করা হয়। এগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হলে ব্রেন, হার্টসহ শরীরের বিভিন্ন রক্তনালিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। লিপিডের এই ভারসাম্যহীনতাকে মেডিকেল সায়েন্সে বলা হয় লিপিড ডিসঅর্ডার।
⚠️ লিপিড ডিসঅর্ডার কেন ঝুঁকিপূর্ণ?
লিপিড মূলত শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। শরীরের প্রতিটি কোষেই লিপিড থাকে। এছাড়া সেক্স হরমোনসহ বিভিন্ন হরমোন তৈরিতেও এটি অপরিহার্য।
কিন্তু কিছু লিপিড অতিরিক্ত হলে তা রক্তনালীতে জমে প্ল্যাক বা ব্লক তৈরি করে। পরবর্তীতে এটি ধমনী ব্লক করে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে LDL এবং উচ্চমাত্রার ট্রাইগ্লিসারাইড এ ধরনের জটিলতার প্রধান কারণ।
🧪 লিপিড প্রোফাইল টেস্টে সাধারণত চার ধরনের ফলাফল পাওয়া যায়:
১️⃣ টোটাল কোলেস্টেরল
👉 রক্তে মোট কোলেস্টেরলের পরিমাণ বোঝায়।
👉 ২০০-এর উপরে গেলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
👉 সর্বদা ২০০-এর নিচে রাখা উচিত।
২️⃣ HDL (হাই-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন)
👉 “ভালো” কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত।
👉 এটি রক্তনালী থেকে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল সরিয়ে যকৃতে পৌঁছে দেয়, যেখানে তা ভেঙে যায়।
👉 ন্যূনতম ৪০ থাকতে হবে, আর ৬০-এর উপরে থাকলে হৃদরোগ প্রতিরোধে বাড়তি সুরক্ষা দেয়।
👉 ব্যায়াম, সামুদ্রিক মাছ, বাদাম ইত্যাদি খাবার এটি বাড়াতে সাহায্য করে।
৩️⃣ LDL (লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন)
👉 একে বলা হয় খারাপ কোলেস্টেরল।
👉 ধমনীর দেয়ালে জমে ব্লক তৈরি করে।
👉 সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে ১৩০-এর নিচে, ডায়াবেটিস থাকলে ১০০-এর নিচে, আর পূর্বে হার্ট অ্যাটাক/রিং/বাইপাস/স্ট্রোক থাকলে ৫৫-এর নিচে থাকতে হবে।
👉 মনে রাখতে হবে: LDL যত কম, তত ভালো।
👉 কোন রিস্ক ফ্যাক্টর ছাড়াও যদি LDL ১৬০-এর বেশি হয়, তাহলে ওষুধ প্রয়োজন। তবে লাইফস্টাইল পরিবর্তন, ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাবার LDL কমাতে বড় ভূমিকা রাখে।
৪️⃣ ট্রাইগ্লিসারাইড
👉 শরীরের ক্যালোরি উৎপাদনে সাহায্য করে।
👉 অতিরিক্ত থাকলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, স্থূলতা, টাইপ ২ ডায়াবেটিস এমনকি প্যানক্রিয়াটাইটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
👉 আমাদের অঞ্চলে কার্বোহাইড্রেট-নির্ভর খাদ্যের কারণে এটি বেশি থাকে।
👉 ৫০০-এর নিচে হলে চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না। অথচ অনেকেই ৩০০–৪০০ দেখেই অপ্রয়োজনীয়ভাবে ফেনোফাইব্রেট গ্রুপের ওষুধ খেয়ে থাকেন।
🧬 লিপিড ডিসঅর্ডারের কারণ
✅ জেনেটিক প্রবণতা
✅ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (অতিরিক্ত চিনি, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট)
✅ স্থূলতা ও পেটের চর্বি
✅ অলস জীবনযাপন ও ব্যায়ামের অভাব
✅ ডায়াবেটিস, হাইপোথাইরয়েডিজম, PCOS
✅ কিছু ওষুধের প্রভাব (যেমন স্টেরয়েড, ইস্ট্রোজেন, মানসিক রোগের ওষুধ)
✅ ফ্যামিলিয়াল হাইপারকোলেস্টেরোলেমিয়া নামক জেনেটিক রোগ, যা শিশু বয়স থেকেই অতিরিক্ত লিপিড বাড়িয়ে অকাল হৃদরোগের ঝুঁকি তৈরি করে।
🩻 লক্ষণ
প্রাথমিক অবস্থায় সাধারণত কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। রুটিন চেকআপেই বেশিরভাগ সময় ধরা পড়ে। তবে অত্যধিক কোলেস্টেরলের কারণে চোখের চারপাশে ব্যথাহীন সাদা গোটার মতো ফোলাভাব (জ্যান্থোমা) হতে পারে।
🧪 কোন পরীক্ষা দিয়ে জানা যাবে?
🔹 লিপিড প্রোফাইল (প্রাথমিক ধারণা দেয়)
🔹 লাইপোপ্রোটিন (LpA) টেস্ট (নিখুঁতভাবে ঝুঁকি নির্ধারণ)
🔹 করোনারি ক্যালসিয়াম স্কোর (CT স্ক্যান)
🔹 ক্যারোটিড ইনটিমা-মিডিয়া থিকনেস (CIMT) টেস্ট
🕒 কবে করবেন কোলেস্টেরল পরীক্ষা?
👦 ৯ বছর থেকে: প্রতি ৫ বছর অন্তর
👨 পুরুষ (৪৫+): প্রতি ১–২ বছর
👩 নারী (৫৫+): প্রতি ১–২ বছর
👴 ৬৫ বছরের পর: প্রতিবছর
🩺 লিপিড ডিসঅর্ডারের প্রতিকার ও প্রতিরোধ
✅ স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
✅ পরিশোধিত চিনি ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট এড়িয়ে চলা
✅ নিয়মিত ব্যায়াম
✅ ধূমপান পরিহার
✅ ওজন নিয়ন্ত্রণ
✅ প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণ
👉 লিপিড ডিসঅর্ডার অনেক সময় নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে, কারণ শুরুতে কোনো লক্ষণ থাকে না। তবে সচেতনতা, নিয়মিত পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার মাধ্যমে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
❤️ হার্ট সুস্থ রাখতে হলে নিয়মিত লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করা জরুরি।