14/03/2025
দাঁতের রোগ ও শরীরের অন্যান্য রোগের সম্পর্ক বিশদ ব্যাখ্যা:
মানবদেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত। মুখ ও দাঁত শরীরের প্রবেশদ্বার হওয়ায় এখানকার কোনো সংক্রমণ বা সমস্যা শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রভাব ফেলতে পারে। দাঁতের রোগ ও অন্যান্য রোগের মধ্যে সম্পর্ককে কয়েকটি ভাগে বিশ্লেষণ করা যায়—
১. হার্টের রোগ ও উচ্চ রক্তচাপের সাথে সম্পর্ক
কীভাবে সম্পর্কিত?
Periodontal Disease (জিন্জিভাইটিস, পেরিওডোন্টাইটিস) থাকলে মাড়ির ইনফেকশন থেকে ব্যাকটেরিয়া রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করতে পারে।
এই ব্যাকটেরিয়া Atherosclerosis (রক্তনালী সংকুচিত হওয়া) সৃষ্টি করে, যা উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।
Endocarditis (হার্টের অভ্যন্তরীণ পর্দার সংক্রমণ) হতে পারে, যা হার্টের ভাল্ভের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রমাণ:
~গবেষণায় দেখা গেছে, Periodontal Disease থাকলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ২-৩ গুণ বেশি।
~C-reactive Protein (CRP) বেড়ে যায়, যা রক্তনালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি বাড়ায়।
২. ডায়াবেটিস ও দাঁতের সমস্যার সম্পর্ক
কীভাবে সম্পর্কিত?
~ডায়াবেটিস রোগীদের মাড়িতে প্রদাহ বেশি হয়, ফলে Periodontal Disease দ্রুত হয়।
~মুখে রক্তের উচ্চ শর্করা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে, ফলে দাঁতের ক্ষয় (Cavities) ও মাড়ির সংক্রমণ (Gingivitis) হয়।
~আবার Periodontal Disease থাকলে ইনসুলিন প্রতিরোধ বাড়তে পারে, যার ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রমাণ:
~Periodontal Disease থাকলে ডায়াবেটিস রোগীদের HBA1C (গ্লুকোজ লেভেল) বেশি থাকে।
~ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য মাড়ির চিকিৎসা করলে ব্লাড সুগার কমে যেতে দেখা গেছে।
৩. স্ট্রোকের সাথে সম্পর্ক
কীভাবে সম্পর্কিত?
মাড়ির রোগ থাকলে রক্তে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে রক্তনালীতে জমাট বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে।
এর ফলে Ischemic Stroke (মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়া) হতে পারে।
প্রমাণ:
গবেষণায় দেখা গেছে, Periodontal Disease থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ২ গুণ বেশি।
Oral bacteria (Porphyromonas gingivalis) মস্তিষ্কে প্রদাহ বাড়িয়ে স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
৪. গর্ভকালীন জটিলতা
কীভাবে সম্পর্কিত?
Periodontal Disease থাকলে প্রি-ম্যাচিউর বেবি ও কম ওজনের নবজাতক জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
প্রদাহজনিত কেমিক্যাল (Prostaglandins, TNF-alpha) মায়ের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রসব ত্বরান্বিত করতে পারে।
প্রমাণ:
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী মায়েদের যদি Periodontal Disease থাকে, তবে তাদের প্রি-ম্যাচিউর ডেলিভারির ঝুঁকি ৭ গুণ বেশি।
৫. ফুসফুসের সংক্রমণ (Pneumonia, COPD)
কীভাবে সম্পর্কিত?
মুখের ব্যাকটেরিয়া শ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করে সংক্রমণ (Aspiration Pneumonia) ঘটাতে পারে।
Periodontal Disease থাকলে COPD (Chronic Obstructive Pulmonary Disease) বাড়তে পারে।
প্রমাণ:
গবেষণায় দেখা গেছে, বৃদ্ধদের মধ্যে দাঁতের সংক্রমণ থাকলে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বেশি।
Oral hygiene ভালো রাখলে ফুসফুসের সংক্রমণের হার কমে যায়।
৬. আর্থ্রাইটিস ও দাঁতের ব্যথার সম্পর্ক
কীভাবে সম্পর্কিত?
Rheumatoid Arthritis (RA) এবং Periodontal Disease উভয়েই প্রদাহজনিত রোগ।
Oral bacteria (P. gingivalis) আর্থ্রাইটিসের প্রদাহ বাড়িয়ে দিতে পারে।
প্রমাণ:
গবেষণায় দেখা গেছে, Periodontal Disease থাকলে RA রোগীদের জয়েন্ট ব্যথা বেশি হয়।
RA রোগীদের মাড়ির চিকিৎসা করলে তাদের আর্থ্রাইটিসের লক্ষণও কমে যেতে পারে।
৭. পাকস্থলীর রোগ ও দাঁতের সমস্যা
কীভাবে সম্পর্কিত?
Helicobacter pylori নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া দাঁতে থেকে পাকস্থলীতে গিয়ে গ্যাস্ট্রিক আলসার সৃষ্টি করতে পারে।
Acid reflux (GERD) থাকলে এটি মুখে এসিড এনে দাঁতের ক্ষয় ঘটাতে পারে।
প্রমাণ:
H. pylori সংক্রমণ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে দাঁতের সমস্যা বেশি দেখা যায়।
GERD থাকলে দাঁতের এনামেল ক্ষয় (Enamel Erosion) বেশি হয়।
৮. আলঝেইমার ও মস্তিষ্কের রোগ
কীভাবে সম্পর্কিত?
Periodontal Disease থেকে ব্যাকটেরিয়া রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
Beta-amyloid plaque তৈরি করে Alzheimer’s Disease (স্মৃতিভ্রংশ) হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রমাণ:
গবেষণায় দেখা গেছে, Alzheimer’s রোগীদের মস্তিষ্কে Porphyromonas gingivalis ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।
Periodontal Disease থাকলে স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি ৭০% বেশি।
প্রতিরোধ ও করণীয়
✅ প্রতিদিন ২ বার ফ্লুরাইড টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করুন।
✅ ফ্লস ব্যবহার করে দাঁতের ফাঁকের ময়লা দূর করুন।
✅ সুগার ও প্রসেসড ফুড কম খান, কারণ এগুলো ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বাড়ায়।
✅ বছরে অন্তত ২ বার ডেন্টিস্টের কাছে যান।
✅ ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
✅ ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো মাড়ির রোগ বাড়ায়।
শেষ কথা
দাঁতের স্বাস্থ্য শুধুমাত্র দাঁতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি সম্পূর্ণ শরীরের সুস্থতার সাথে জড়িত। মুখের স্বাস্থ্য ভালো রাখলে হার্ট ডিজিজ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, আর্থ্রাইটিস, নিউমোনিয়া এমনকি আলঝেইমারের মতো মারাত্মক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই মুখের যত্ন নেওয়া মানেই সম্পূর্ণ শরীরের যত্ন নেওয়।