25/08/2025
এলোপ্যাথি বনাম হোমিওপ্যাথি দ্বন্দ্ব
বর্তমান সময়ে আমরা একটা বড় সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, সেটা হলো চিকিৎসাবিদ্যার বিভিন্ন শাখাকে নিয়ে একে অপরের সমালোচনা। একজন হোমিওপ্যাথ হয়তো এলোপ্যাথিকে খারাপ বলবে, আবার একজন এলোপ্যাথ হোমিওপ্যাথিকে অস্বীকার করবে। আমার মতে, এই দৃষ্টিভঙ্গি মোটেও সঠিক নয়। কারণ, দুটি চিকিৎসা পদ্ধতিই আলাদা, স্বতন্ত্র এবং তাদের নিজস্ব জায়গায় কার্যকর।
এলোপ্যাথি মূলত দ্রুত ফলাফল, সার্জিক্যাল ইন্টারভেনশন, লাইফ–সেভিং ম্যানেজমেন্ট এবং সিম্পটোম্যাটিক রিলিফ দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী। উদাহরণস্বরূপ, কোনো রোগী হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করল সেখানে ইনজেকশন, ইমার্জেন্সি ওষুধ, আইসিইউ কেয়ার, সার্জারি এসব ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিই তখন প্রয়োজনীয় জীবন বাঁচাতে পারবে না। এই জায়গায় এলোপ্যাথির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
অন্যদিকে হোমিওপ্যাথি মানুষের সামগ্রিক দেহ–মনকে গুরুত্ব দেয়। দীর্ঘস্থায়ী রোগ, ক্রনিক ডিসঅর্ডার, অটোইমিউন প্রবলেম বা যেখানে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা বেশি, সেখানে হোমিওপ্যাথি নিরাপদ ও কার্যকর। হোমিওপ্যাথি রোগীকে শুধুমাত্র শরীর নয়, মানসিক ও আবেগিক দিক থেকেও বোঝার চেষ্টা করে। ফলে রোগী অনেক সময় ওষুধের পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তি ও সাহসও পায়, যা নিরাময়ের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আজ পৃথিবীতে এমন অনেক হাসপাতাল আছে যেখানে হোমিওপ্যাথি ও এলোপ্যাথি পাশাপাশি চলছে। যেমন ইংল্যান্ডের Royal London Hospital for Integrated Medicine (RLHIM) এখানে ক্যান্সার, অ্যালার্জি, রিউমাটোলজি, মানসিক চাপ সব কিছুর চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি এলোপ্যাথির পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়। আবার স্কটল্যান্ডের NHS Centre for Integrative Care, Glasgow এ (যা আগে Glasgow Homeopathic Hospital নামে পরিচিত ছিল) রোগীকে তাদের সমস্যার ধরন অনুযায়ী কখনও এলোপ্যাথি ডাক্তার, কখনও হোমিওপ্যাথি ডাক্তার রেফার করেন।
জার্মানির Kinderkrankenhaus St. Marien, Landshut শিশুদের হাসপাতালে হোমিওপ্যাথিক ও ন্যাচুরোপ্যাথিক চিকিৎসা কনভেনশনাল মেডিসিনের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। একইভাবে ইতালির Lucca Hospital বা Pitigliano Centre of Integrated Medicine এ ক্যান্সারের রোগীরা কেমোথেরাপি বা সার্জারির পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি পাচ্ছেন যাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমে যায় এবং মানসিক সাপোর্টও পাওয়া যায়।
আমার দৃষ্টিতে, দুই চিকিৎসা শাখাই মানুষের উপকারের জন্যই গড়ে উঠেছে। এলোপ্যাথি আর হোমিওপ্যাথি একটা আরেকটার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহযাত্রী। অনেক সময় দেখা যায়, একজন রোগীর ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এলোপ্যাথিক পদ্ধতিতে করতে হয়, কিন্তু পরবর্তীতে ক্রনিক কেয়ার বা পুনর্বাসনে হোমিওপ্যাথি দারুণ সাহায্য করে। আবার কোনো ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও, জটিল হলে সার্জারি বা এলোপ্যাথিক চিকিৎসা নিতে হয়।
এইসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায় একজন এলোপ্যাথ ডাক্তার যখন মনে করেন রোগীর জন্য হোমিওপ্যাথি ভালো হবে, তখন তিনি রোগীকে হোমিওপ্যাথের কাছে পাঠান। আবার একজন হোমিওপ্যাথ যখন বুঝতে পারেন রোগীর অবস্থা ইমার্জেন্সি, বা সার্জারির প্রয়োজন তখন তিনি দ্বিধা না করে এলোপ্যাথির হাতে তুলে দেন।
অতএব, আসল জায়গাটা হলো রোগীর সেবা। সেখানে চিকিৎসা পদ্ধতির লড়াই নয়, বরং সহমর্মিতা, সহযোগিতা আর ইন্টিগ্রেটিভ সিস্টেমই ভবিষ্যতের পথ। হোমিওপ্যাথি এবং এলোপ্যাথি দু’টোই মানুষের সুস্থতার জন্য তৈরি, তাই দু’টোকে পাশাপাশি চলতে দিলে রোগীরই আসল উপকার হবে।
যদি একজন হোমিওপ্যাথ শুধু এলোপ্যাথির খারাপ দিক নিয়েই কথা বলে, তাহলে সেটা সংকীর্ণতা। একইভাবে যদি একজন এলোপ্যাথ হোমিওপ্যাথির সাফল্য অস্বীকার করে, সেটাও বৈজ্ঞানিক মনোভাবের সাথে যায় না। বরং আমাদের উচিত খোলা মন নিয়ে দেখা কোথায় কোন শাখার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, আর কিভাবে দুটো একে অপরকে পরিপূর্ণ করতে পারে।
চিকিৎসা মানে মানুষের কষ্ট লাঘব। এলোপ্যাথি হোক বা হোমিওপ্যাথি যদি সেটা একজন রোগীকে সুস্থতা দেয়, তবে সেটাই আসল চিকিৎসা।
কপি-@ডা.জাকির হোসেন