29/11/2025
আমরা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেন খাই? কেন আমরা পরিষ্কার থাকি? যেন শরীরে রোগ-জীবাণু প্রবেশ না করে। কিন্তু এটুকু নিশ্চয়তা কি কেউ দিবে যে, যতই আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করি না কেন এসব মেনে চলার তবুও আমাদের কস্মিনকালেও রোগ হবে না??
একবার এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে শুনেছিলাম তার স্ত্রীর নানান রোগ, ফ্যাটি লিভার ধরা পড়েছে। অথচ তারা যেই জায়তুন তেল খান সেটাও এক্সট্রা ভার্জিন, এবং ইম্পোর্টেড; এবং যেই তেল পিউরিটির মধ্যে শীর্ষে। প্রতিটা খাবার তারা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বিচার করে খান। তবুও আল্লাহ তাদের অসুস্থতার পরীক্ষা নিয়েছেন। গায়েবীভাবে শরীরে রোগ দিয়েছেন। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার পরেও সুস্বাস্থ্য বেশিদিন স্থায়ী হয় নি।
আমরা অনেকেই মনে করি নামাজ-রোজা আদায় করলেই জিন যা*দু থেকে বেচে থাকা যাবে, বা জিন যা*দুতে আক্রান্ত হলে শুধু নামাজ-ইবাদত ঠিকমত করলেই সুস্থ হয়ে যাব। এটা মোটাদাগে আংশিক ভুল ধারণা। বাস্তবিকভাবে ইবাদতের নিজের ক্ষমতা নেই যা দিয়ে কোনো ব্যক্তিকে জিন-যা*দু থেকে সুরক্ষা দিবে বা নিরাময় দিবে। আল্লাহ আজ্জাওয়াজালই বরং ইবাদত-সালাতের উছিলায় নিজ ইচ্ছায় যে কাউকে সুরক্ষিত রাখবেন বা সুস্থতা দিবেন।
وَأۡمُرۡ أَهۡلَكَ بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱصۡطَبِرۡ عَلَيۡهَاۖ لَا نَسۡــَٔلُكَ رِزۡقًاۖ نَّحۡنُ نَرۡزُقُكَۗ وَٱلۡعَٰقِبَةُ لِلتَّقۡوَىٰ
আর তোমার পবিরার-পরিজনকে নামাযের নির্দেশ দাও আর তাতে অবিচল থাক। তোমার কাছে আমি রিযক চাই না, আমিই তোমাকে রিযক দিয়ে থাকি, উত্তম পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য নির্দিষ্ট।(ত্বহা:১৩২)
(রিজিক মানে সুস্থতা থেকে শুরু করে সমস্ত নিয়ামত)
স্বালাত-ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর রহমত ও নিরাপত্তার মধ্যে থাকে, তবে স্পেসিফিকলি জিন-যা*দু থেকে বেচে থাকার জন্য তা-ই যথেষ্ট নয়। রাসূল ﷺ জিন-যা*দু-বদনজর বেচে থাকার জন্য সকাল সন্ধ্যা ফালাক্ব,নাস ও অন্যান্য মাসনূন আযকার যা আমরা জানি, তা তিনি করতেন না।
রাসূল ﷺ নবুয়্যতকালীন অবস্থাতেই যা*দুগ্রস্থ হন, অথচ তার চাইতে এই জমিনে কে বেশি ইবাদতকারী ছিলেন? যা*দুগ্রস্থ অবস্থাতেও তার ওপর ওয়াহী নাজিল হতো। এসবের ফলেও কি উনি ﷺ যা*দু থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন? বরঞ্চ রাসূল ﷺ দীর্ঘদিন আল্লাহর কাছে দু'আ করেছিলেন। যার পরবর্তীতে আল্লাহ আজ্জাওয়াজাল তাকে স্বপ্নে দেখিয়ে দেন তার যা*দুগ্রস্থ হবার বিষয়টি। রাসূল ﷺ তো এই বিস্তর সময়েও ইবাদত করেছিলেন, তাতে কি তিনি যা*দুগ্রস্থতা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন? আল্লাহ তাকে যা*দুর চিকিৎসা ওয়াহীর মাধ্যমে পৌছে দিয়েছেন, তার পরবর্তীতে কৃত যা*দু নষ্ট হয়, তিনি সুস্থ হন।
যদি স্বালাত- ইবাদত একজন ব্যক্তিকে যা*দু থেকে সুরক্ষা দিতে পারে তাহলে এই তালিকায় সর্বপ্রথম ব্যক্তি হতেন রাসূল ﷺ।
আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকটে জিবরীল (আঃ) এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনি কি অসুস্থ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন জিবরীল (আঃ) পাঠ করলেনঃ
بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ وَعَيْنِ حَاسِدٍ بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ وَاللَّهُ يَشْفِيكَ
“আমি আপনাকে আল্লাহ তা'আলার নামে ঝাড়ফুঁক করছি এমন সকল কিছু হতে যা আপনাকে কষ্ট দেয় এবং সকল প্রকার অনিষ্টকর প্রাণী ও সকল হিং*সুটে দৃষ্টি হতে। আল্লাহ তা'আলার নামে আমি আপনাকে ঝাড়ছি, আপনাকে আল্লাহ তা'আলা সুস্থতা দান করুন।"
তাহলে জিব্রীল আ. কখনোই আসতেন না রাসূল ﷺ কে ঝাড়ফুক করতে। যদি স্বালাত-ইবাদতই সব হতো তাহলে জিব্রীল আ. তার কাছে এসে বদনজরের জন্য এই রুক্বইয়াহটি করতেন না।
শুধু কি রাসূল ﷺ ?? তার সহধর্মিণী 'আয়েশা রা. কেও যা*দু করা হয়েছিলো।
عن عمرة قالت: اشتكت عائشة فطال شكواها، فقدم إنسان المدينة يتطبب، فذهب بنو أخيها يسألونه عن وجعها، فقال: والله إنكم تنعتون نعت امرأة مطبوبة، قال: هذه امرأة مسحورة سحرتها جارية لها، قالت: نعم، أردت أن تموتي فأعتق، قال: وكانت مدبرة، قالت: "بيعوها في أشد العرب ملكة، واجعلوا ثمنها في مثلها"
'আমরা রা. থেকে বর্ণিত, আয়েশা (রাঃ) তার এক বাঁদীকে তার মৃত্যুর পর মুক্তি প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। পরে আয়েশা (রাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ভ্রাতুষ্পুত্ৰগণ "জুথ" সম্প্রদায়ের এক চিকিৎসকের সাথে তার ব্যাপারে পরামর্শ করেন। সে বললো, আপনারা আমাকে এমন এক মহিলা সম্পর্কে অবিহত করেছেন যাকে তার দাসী যা*দু করেছে। আয়েশা (রাঃ)-কে তা অবহিত করা হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাকে যা*দু করেছো? সে বললো, হাঁ। তিনি বলেন, কেন? কখনও তুমি মুক্তি পাবে না। তিনি বলেন, তোমরা তাকে উগ্র মেজাজের অসদাচারী বেদুইনের কাছে বিক্রি করো (আবু দাউদ, হাকিম)।
তিনি রাসূল ﷺ এর স্ত্রী, তিনিও যা*দুগ্রস্থ হয়েছিলেন!!!
أَنَّ أَبَا بَكْرٍ الصِّدِّيقَ دَخَلَ عَلَى عَائِشَةَ وَهِيَ تَشْتَكِي وَيَهُودِيَّةٌ تَرْقِيهَا فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ ارْقِيهَا بِكِتَابِ اللهِ
আবূ বাকর সিদ্দীক (রা) আয়িশা (রা)-এর কাছে গেলেন। তখন তিনি (আয়িশা) অসুস্থ ছিলেন এবং জনৈক ই*হুদী মহিলা (কিছু) পাঠ করে তাঁর উপর দম(রুক্বইয়াহ) করছিলেন। আবূ বাকর (রা) বললেন, কালামুল্লাহ্ (তাওরাত বা কুরআন) পড়ে রুক্বইয়াহ কর।
যদি স্বালাত-আমলই যথেষ্ট হতো তাহলে ই*হুদী(!) নারীকে রুক্বইয়াহ করতেই বলা হতো না!
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَأْمُرُنِي أَنْ أَسْتَرْقِيَ مِنَ الْعَيْنِ
‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে কুদৃষ্টি(বদনজর) হতে (বাঁচার জন্য) ঝাড়ফুঁক করার আদেশ করতেন।
তাহলে বদনজর থেকে বেঁচে থাকতে পাঁচ ওয়াক্ত স্বালাত আর অন্যান্য আমলই যথেষ্ট না!!
সাহাবারা রা. ছিলেন এই জমিনের শ্রেষ্ঠ পথচারী। তাদের ইমানের কারণে আল্লাহই তাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। সাহাবাদের এত সুউচ্চ ইমান-আমলের পরেও কি তাদেরকে আল্লাহ জিন-বদনজরের পরীক্ষায় ফেলেন নি? নাকি তারা ভেবেছিলেন তাদের স্বালাত, তাদের আমলই যথেষ্ট জিন-যা*দুর প্রতিপক্ষে।
عَنْ عُثْمَانَ بْنِ أَبِي الْعَاصِ، قَالَ لَمَّا اسْتَعْمَلَنِي رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ عَلَى الطَّائِفِ جَعَلَ يَعْرِضُ لِي شَىْءٌ فِي صَلاَتِي حَتَّى مَا أَدْرِي مَا أُصَلِّي فَلَمَّا رَأَيْتُ ذَلِكَ رَحَلْتُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ فَقَالَ " ابْنُ أَبِي الْعَاصِ " . قُلْتُ نَعَمْ يَا رَسُولَ اللَّهِ . قَالَ " مَا جَاءَ بِكَ " . قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ عَرَضَ لِي شَىْءٌ فِي صَلاَتِي حَتَّى مَا أَدْرِي مَا أُصَلِّي . قَالَ " ذَاكَ الشَّيْطَانُ ادْنُهْ " . فَدَنَوْتُ مِنْهُ فَجَلَسْتُ عَلَى صُدُورِ قَدَمَىَّ . قَالَ فَضَرَبَ صَدْرِي بِيَدِهِ وَتَفَلَ فِي فَمِي وَقَالَ " اخْرُجْ عَدُوَّ اللَّهِ " . فَفَعَلَ ذَلِكَ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ ثُمَّ قَالَ " الْحَقْ بِعَمَلِكَ " . قَالَ فَقَالَ عُثْمَانُ فَلَعَمْرِي مَا أَحْسِبُهُ خَالَطَنِي بَعْدُ .
উসমান বিন আবুল আস (রাঃ), থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে তায়েফের প্রশাসক নিযুক্ত করলেন। (তথায়) সলাতের মধ্যে আমার সামনে কিছু বাধা আসতে লাগলো। ফলে আমার মনে থাকতো না যে, আমি কত রাক‘আত নামায পড়েছি। আমার এই অবস্থা লক্ষ্য করে আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সাক্ষাত করার জন্য রওয়ানা হলাম। তিনি (আমাকে দেখে) বলেনঃ আবুল আসের পুত্র নাকি? আমি বললাম, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ তুমি কেন এসেছ? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সলাতের মধ্যে আমার সামনে কিছু বাধা আসে। ফলে আমি বলতে পারি না যে আমি কত রাক‘আত পড়েছি। ত্তিনি বলেনঃ এটা শাইত্বান। আমার নিকট এসো। আমি তাঁর নিকটে হাঁটু গেড়ে বসলাম। রাবী বলেন, তিনি নিজ হাতে আমার বুকে মৃদু আঘাত করলেন এবং আমার মুখে লালা দিয়ে তিনবার বলেনঃ আল্লাহর শত্রু! ভে*গে যা। অতঃপর তিনি বলেনঃ যাও নিজের কাজে যোগ দাও। উসমান (রাঃ) বলেন, আমার জীবনের শপথ! এরপর থেকে শাইত্বান আমার অন্তরে আর তালগোল পাকাতে পারেনি।
আবু উমামা ইবনে হুনাইফ (রা.) বলেন, আমের ইবনে রবিআ (রা.) সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.)-এর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন গোসল করছিলেন। আমের (রা.) বলেন, আমি এমন সুন্দর সুপুরুষ দেখিনি, এমনকি পর্দানশিন নারীকেও এরূপ সুন্দর দেখিনি, যেমন আজ দেখলাম। অতঃপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সাহল (রা.) বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। তাঁকে নবী (সা.)-এর কাছে নেওয়া হলো এবং তাঁকে বলা হলো, ধরাশায়ী সাহলকে রক্ষা করুন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কাকে অভিযুক্ত করছ? তারা বলল, আমের ইবনে রবিআকে। তিনি বলেন, তোমাদের কেউ বদনজর লাগিয়ে তার ভাইকে কেন হ*ত্যা করতে চায়? তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের মনোমুগ্ধকর কিছু দেখলে যেন তার জন্য বরকতের দোয়া করে। অতঃপর তিনি পানি নিয়ে ডাকলেন, অতঃপর আমেরকে অজু করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি তাঁর মুখমণ্ডল, দুই হাত কনুই পর্যন্ত, দুই পা গোছা পর্যন্ত এবং লজ্জাস্থান ধৌত করলেন। তিনি আমেরকে পাত্রের (অবশিষ্ট) পানি সাহেলের ওপর ঢেলে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি সাহলের পেছন দিক থেকে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য আমেরকে নির্দেশ দেন।
অর্থাৎ সাহাবারাও বদনজর, যা*দু, জিনের আছরে আক্রান্ত হতেন। অথচ তারা ঘুমের সময়টুক বাদে এক মুহুর্তের জন্যও আল্লাহর নাফরমানি বা গাফেলতিতে থাকতেন না।
উপরন্তু আমাদের চিন্তা-ভাবনা বাস্তবিক হলে মাদ্রাসায়, ছাত্রদের এমনকি কোনক হাফেজ,আলেম, ইমামদের কখনোই জিন-যা*দুগ্রস্থ পেতাম না। অথচ আমরা দেখি সেখানেই প্রভাবগুলো বেশি প্রকাশ পায়। অথচ তাদের নিত্যনৈমিত্তিক আমল আর ইবাদত, স্বালাত, তাহাজ্জুতে কাটে।
শেষ একটা হাদীস দিয়ে এই যুক্তি পরিপূর্ণভাবে খন্ডন হয়ে যায়।
জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ
أكثر من يموت من أمتي بعد قضاء الله وقدره بالعين
অর্থঃ আমার উম্মতের মধ্যে তাকদীরের মৃত্যুর পর সর্বাধিক মৃত্যু বদ নজর লাগার দ্বারা হবে। (মুসনাদে বাযযার)
(হাদীসে এই বদনজরকে জিনের বদনজর বলা হয়েছে)
অর্থাৎ আমল-ইবাদত ঠিক থাকবার পরেও এই উম্মাহ বদনজর দ্বারা আক্রান্ত হবে।
বাস্তবতা এটাই যে, শুধু স্বালাত, শুধু আল্লাহর ইবাদতই যথেষ্ট না আল্লাহর সৃষ্টির খারাপ প্রভাব থেকে বেচে থাকার জন্য। আবার স্বালাত, ইবাদত ঠিক না রাখলেও আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এসব হচ্ছে ভবনের সেই ভিত্তি যা ভবনকে দাড় করিয়ে রাখে, আর মাসনুন আযকার, দু'আ, মু'উইয়াযাতান (ফালাক্ব, নাস), রুক্বইয়াহ হচ্ছে সেই ভবনের প্রধান ফটক ও দরজা, জানালা কিংবা প্রহরী, যা ভবনকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখে।