25/11/2025
হোমিওপ্যাথি এবং আমার জীবনের স্বার্থকতা
আজ একটি বিশেষ দুঃখময় স্মৃতিকাতর দিন। গত বছরের এই দিনে আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষটি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান! আমি আমার জন্মলগ্ন থেকেই উনাকে অসুস্থ দেখে আসছি। ২০১৯ পর্যন্ত প্রচলিত চিকিৎসা চলতে চলতে আর কোনো অগ্রগতি হচ্ছিল না। হাঁটাচলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল, দিনদিন রোগ খারাপের দিকে যাচ্ছে, ডাক্তারও হাল ছেড়ে দিল। ডায়াবেটিস, এজমা, বাত, প্রেশার, নিদ্রাহীনতা—সব মিলিয়ে এক কঠিন অবস্থা।
আল্লাহর মেহেরবানী, পরিবারের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে খুলনায় ডা. ধীমান রায় স্যারের কাছে দেখাই। তখন Aconite 10M দিয়ে চিকিৎসা শুরু হয়। প্রথম দিন থেকেই এজমা–শ্বাসকষ্ট সম্পূর্ণ সেরে যায় (Ailments from panic fear)। হাঁটুর ব্যথাও অনেকটাই কমে যায়। সেই থেকে মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগ পর্যন্ত হোমিওপ্যাথিক ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ চলেনি। কখনো সম্পূর্ণ ভালো না হলেও আগের তুলনায় যথেষ্ট ভালোই ছিলেন।
সবশেষে পায়ের পাতা ফুলে গেল। পরীক্ষায় দেখা গেল হার্টের কিছু ত্রুটি আছে, যদিও তা মারাত্মক কোন প্যাথলজি ছিলো না।কিডনি লিভার সবকিছু স্বাভাবিক ছিলো। কয়েকদিন পারিবারিক সিদ্ধান্তে ইনসুলিন দেওয়া হলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে। কিন্তু এরপর আস্তে আস্তে খারাপ লাগা বাড়তে লাগলো। আবার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। ওষুধ বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করেও স্থায়ী ফল হচ্ছিল না (Level–D)। তারপর হাসপাতালে ভর্তি করলাম। CCU–তে উনি মানসিক রোগীর মতো হয়ে গেলেন। এরপর ইবনেসিনায় কেবিনে রাখা হলো।
যা দেখলাম—অক্সিজেন ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসায় তেমন পরিবর্তন নেই। লক্ষণে নিত্য পরিবর্তন হচ্ছিল। কাশি কমছিল না। দাদাকে বললাম—কাশিটা কমানো দরকার, এলোপ্যাথি দিয়ে কিছু হচ্ছে না। দাদা Conium দিলেন—এক ডোজেই কাশি কমে গেল। আমি মহাখুশি।
এর আগে উনি কিছুই খেতে পারছিলেন না। আমি Apocynum দিলাম—উনি আবার স্বাভাবিক খাওয়া শুরু করলেন। যা খেতে চাইতেন, কোনো অসুবিধা হতো না। এত রোগের মাঝেও উনি সবাইকে কথা বলে হাসাতেন। রোগ যতই মারাত্মক হোক, আমি কখনো বিশ্বাস করতাম না উনি মারা যাবেন। আজও মনে হয় না। আমি বিশ্বাস করি—পৃথিবীতে উনার অশান্তি ছিল, তাই শান্তির জন্য আল্লাহ তাঁকে অন্য জগতে নিয়ে গেছেন।
হাসপাতালে কোনো অবনতি না হলেও উন্নতিও হচ্ছিল না। বড় ভাই লক্ষ করল—এলোপ্যাথি খাওয়ার পর সমস্যা বাড়ছে, আর হোমিওপ্যাথিক দ্রুত কাজ দিচ্ছে (Level–D রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় এমন হয়, যদিও এমন রোগী সাধারণত লাস্টিং করেনা)। মৃত্যুর তিনদিন আগে থেকে উনি আমাকে বলতেন, “তুই আমাকে ওষুধ দে, আমাকে আর এলোপ্যাথি দিস না।” স্যালাইন দিলেই খুব বিরক্ত হতেন। মৃত্যুর দুইদিন আগে থেকে স্যালাইন শরীর নিচ্ছিল না।
ভাই সকালেই ইশারা পেলেন—সময় আর বেশি নেই। আমরা রিলিজ নিলাম, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ICU–তে রাখতে বলল। আমাদের মনে হলো—ICU–তে মৃত্যু হলে তা কষ্টের মধ্যে হবে। তাই আমরা উনাকে নিয়ে চললাম। তখনও আম্মা হাসিখুশি—মনে হচ্ছিল অনেকটাই সুস্থ।
গাড়িতে ওঠার কিছুক্ষণ পর শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। বুঝলাম—এটাই হয়তো শেষ সময়। Aconite দিলাম—পরিবর্তন হলো না। Arsenicum দিলাম—কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে গেলেন। কুমিল্লা পৌঁছে তাঁর জন্য পছন্দের মিষ্টি নিলাম। সেনবাগ এসে বাবা পান নিলেন—পান না দিলে উনি রাগ করতেন। সবাই অপেক্ষা করছিলেন দেখার জন্য।
আমার মনে হচ্ছিল—এবার হয়তো বাসায় অক্সিজেন রেখে উনাকে ভালোভাবে রাখবো। বাসায় পৌঁছানোর এক মিনিট আগেও উনি কথা বলছিলেন। কিন্তু বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই উনি সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। আমি ভাবলাম—ওষুধের জন্য ঘুম এসেছে। উনি যেন অনেক দিনের ঘুম পূরণ করছেন। গ্রামের সবাই দেখতে আসছিল, আর আমি সবাইকে থামাচ্ছিলাম—“ঘুম ভাঙাবে না।”
আমি নিজেও ডাকিনি। আগের মতো তাঁর গলা জড়িয়ে ধরিনি। তাঁর ঘ্রাণ নিইনি।
দুইটার দিকে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে উঠে শুনলাম—উনি এখনো জাগেননি। তারপর O***m দিলাম। ১০ মিনিট পর উনি উঠলেন। আমি ভীষণ খুশি—মনে হলো এইবার হয়তো আমার মা আরেকটু দিন বাঁচবেন। টয়লেট সারলেন , পরিষ্কার হয়ে আসলেন । আমি পা মালিশ করলাম।
কিছুক্ষণ পর প্রেশার মাপতে গিয়ে দেখি—কাঁটা আটকে আছে…
আমার সব স্বপ্ন নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
আমি নিঃশব্দে, কোনো কান্না না করে, গলার কাছে জমে থাকা সব অভিমান নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম—ভাইয়্যাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, কারণ উনি অপারেশনের রোগী,আমি কান্না করলে অন্যদের এই গতি আরও বেড়ে যাবে।
আজ, উনার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর এমন দিনে বাবা দোয়ার মধ্যে বলছিলেন—
“আমার একজন ডাক্তার আছে। আমার যতকিছুই হোক, আমার কোথাও যাওয়া লাগে না। আমি তার ওষুধেই ভালো হয়ে যাই।”
বাবার এই কথাটি—
আমার হাজারও অপূর্ণতার মাঝেও এক বিশাল সফলতা।
পৃথিবীর আর কেউ ভালো না হোক…
আমার মা–বাবাকে আমি চিকিৎসা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি—
এর চেয়ে বড় সুখ, এর চেয়ে বড় স্বার্থকতা আর কিছু আমার জীবনে নেই।
আর আমি প্রত্যক্ষ করলাম যে,অন্তিমকালে হোমিওপ্যাথি রোগীর কষ্টকে উপশম দিয়ে মৃত্যুকে সহজ করে।
লেখা :২৫/১১/২০২৫