23/10/2025
... যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অনেক বন্দীই মুক্তির আশা ছেড়ে দিয়ে ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করে। কিন্তু সিনওয়ার ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। একেবারে শুরু থেকেই তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, একদিন না একদিন তিনি ঠিকই মুক্তি পাবেন। এবং সেই দিনের জন্য কারাগারের ভেতর থেকেই তিনি প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য কারাগার শুধুমাত্র শাস্তি ভোগ করার জায়গা না। এটা একইসাথে ই$ড়া/লি সমাজকে বোঝারও জায়গা।
ই$ড়া/লি সমাজকে ভালো করে বোঝার লক্ষ্যে কারাগারে বসেই ইয়াহইয়া সিনওয়ার হিব্রু ভাষা শিখতে শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি এত ভালোভাবে হিব্রু ভাষা আয়ত্ত করেন যে এরপর থেকে ই$ড়া/লি কারও সাথে কথা বলতে হলে তিনি হিব্রুতেই কথা বলতেন।
শত্রুর মনস্তত্ত্ব ভালোভাবে বোঝার জন্য কারাগারের লাইব্রেরি থেকে ধার নিয়ে তিনি জায়নিস্ট তাত্ত্বিক, ই$ড়া/লি রাজনীতিবিদ এবং নিরাপত্তা বিভাগের প্রধানদের লেখা প্রায় সবগুলো বই পড়ে শেষ করে ফেলেন।
কারাগারে বসে সিনওয়ার শুধু মুক্তি পরবর্তী দিনগুলোর জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন না; একইসাথে তিনি মুক্তি অর্জনের জন্যও সক্রিয়ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পিএলওর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন, কারাগার থেকে বন্দীদেরকে মুক্ত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে ই$ড়া/লি সৈন্যদেরকে অপহরণ করা এবং এরপর ই$ড়া/লি সাথে বন্দী বিনিময় চুক্তি করা। ফলে কারাগারে বসেই তিনি ই$ড়া/লি সৈন্যদেরকে অপহরণ করার পরিকল্পনা করতে শুরু করেন।
১৯৯৮ সালে এক সহবন্দীকে সাথে নিয়ে তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ঐ সহবন্দীর ভাইয়ের নেতৃত্বে ছোট একটা দল কয়েকজন ই$ড়া/লি সৈন্যকে অপহরণ করে মিসরে নিয়ে যাবে, এরপর তাদের মুক্তির বিনিময়ে ৪০০ ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তি দাবি করবে। কিন্তু অপারেশনের প্রস্তুতির জন্য মিসরে যাওয়ার পথে ঐ দলের এক সদস্য ই$ড়া/লি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে গেলে তাদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।
ঐ পরিকল্পনা সফল না হলেও ২০০৬ সালে ঠিকই হামাসের অন্য একটা পরিকল্পনা সফল হয়। সে বছর হামাসের কাসসাম ব্রিগেডসের সদস্যরা মাটির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ই$ড়া/লের ভেতরে প্রবেশ করে এবং দুই ই$ড়া/লি সৈন্যকে হত্যা করে গিলাদ শালিত নামে তৃতীয় এক সৈন্যকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। কাসসাম ব্রিগেডসের যে সৈন্যদল ঐ অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মোহাম্মদ সিনওয়ার; ইয়াহইয়া সিনওয়ারের আপন ছোট ভাই।
ই$ড়া/লি কারাগারগুলোতে আটক ফিলিস্তিনি বন্দীদেরকে হামাস খুবই গুরুত্বের সাথে দেখে। সাংগঠনিকভাবে হামাস তাদের সদস্যদেরকে চারটা এলাকায় ভাগ করে– গাযা, পশ্চিম তীর, ফিলিস্তিনের বাইরে থাকা শরণার্থী শিবিরগুলো, এবং কারাগার।
প্রতি চার বছর পরপর যখন হামাসের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ই$ড়া/লি কারাগারগুলোর ভেতরেও তাদের সদস্যরা গোপনে নির্বাচনের আয়োজন করে। যেকোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য তিনটা এলাকার পাশাপাশি এই কারাগারগুলোর ভেতর থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মতামতও হামাস অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে।
২০০৪ সালে এরকম একটা নির্বাচনে ইয়াহইয়া সিনওয়ার কারাগারে বন্দী হামাস সদস্যদের ভোটে তাদের আমির নির্বাচিত হন। কয়েক বছর পর গিলাদ শালিতের মুক্তির ব্যাপারে যখন দুই পক্ষের মধ্যে বন্দী বিনিময় আলোচনা শুরু হয়, তখন কারাগারের ভেতর থেকে তিনিই সেই আলোচনায় বন্দীদের পক্ষ থেকে শর্ত উপস্থাপন করতে থাকেন।
হামাসের অন্য অনেক নেতার পাশাপাশি কারাগারের ভেতরে থেকে ইয়াহইয়া সিনওয়ার, এবং কারাগারের বাইরে থেকে মোহাম্মদ সিনওয়ার হয়ে ওঠেন বন্দী বিনিময় আলোচনার অন্যতম প্রধান দুই অংশীজন।
২০১০ সালের শেষের দিকে ই$ড়া/ল গিলাদ শালিতের মুক্তির বিনিময়ে এক হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিতে রাজি হয়। ইয়াহইয়া সিনওয়ার যেহেতু সরাসরি কোনো ইসরায়েলিকে হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন না, তাই শুরু থেকেই এই এক হাজার বন্দীর তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। ততদিনে সিনওয়ার ২২ বছরের বন্দী জীবন অতিক্রম করে ফেলেছিলেন।
কিন্তু নীতির প্রশ্নে তিনি এতই অনড় ছিলেন যে তালিকার একেবারে শীর্ষে নিজের নাম থাকা সত্ত্বেও চূড়ান্ত সম্মতি দিতে তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। তার দাবি ছিল, সরাসরি ইসরায়েলিদেরকে হত্যা করা বিখ্যাত ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ কর্মীদের নামও এই তালিকায় থাকতে হবে।
এর আগেও ইয়াহইয়া সিনওয়ার একাধিকবার বন্দীদের সুযোগ-সুবিধার দাবিতে অনশন ধর্মঘট পালন করেছিলেন। এসবের শাস্তি হিসেবে তার ২৩ বছরের বন্দী জীবনের চার বছরই কেটেছিল কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। এখন বন্দী বিনিময় আলোচনা চলার সময় দুই সহবন্দীকে নির্জন প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্ত করার দাবিতে কারাগারের ১,৬০০ বন্দীকে নিয়ে তিনি আবারও অনশনের ডাক দেন।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে, তাকে সরানো না পর্যন্ত তারা নিজেদের পরিকল্পনা মতো কিছু করতে পারবে না। ফলে আবারও তারা তাকে নির্জন প্রকোষ্ঠে প্রেরণ করে, এবং তার অনুপস্থিতিতেই হামাসের অন্যান্য নেতাদের সাথে আলোচনা করে বন্দী বিনিময় চুক্তি চূড়ান্ত করে ফেলে। সিদ্ধান্ত হয়, গিলাদ শালিতের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েল ১,০২৭ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেবে।
কারাগারে থাকা অবস্থাতেই, ২০০৪ সালে সিনওয়ারের মস্তিষ্কে টিউমার ধরা পড়েছিল। সে সময় ই$ড়া/লি কর্তৃপক্ষ তাকে হাসপাতালে নিয়ে সেই টিউমার অপারেশন করানোর ব্যবস্থা করেছিল। কারাগারের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান, বেটি লাহাত ঘটনাটাকে ব্যবহার করে সিনওয়ারকে ইসরায়েলের এজেন্ট হিসেবে রিক্রুট করার চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু সিনওয়ার তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তার ইসরায়েলের হয়ে কাজ করার কোনো ইচ্ছা নেই। কারণ তিনি জানেন, একদিন তিনি ঠিকই মুক্তি পাবেন। তারিখটা তার জানা নেই, সেটা শুধু আল্লাহই জানেন; কিন্তু তিনি নিশ্চিত, এরকম একটা তারিখ অবশ্যই আছে।
বলাই বাহুল্য, বেটি লাহাত তখন সিনওয়ারের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এর প্রায় অর্ধযুগ পর তিনি বুঝতে পারেন, এরকম একটা তারিখ আসলেই ছিল। এবং সেটা ছিল ২০১১ সালের ১৮ই অক্টোবর। চুক্তি অনুযায়ী সেদিন ইসরায়েলি কারাগারগুলো থেকে বন্দীদেরকে এনে সারি বেঁধে দাঁড় করানো হয় মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
যেকোনো বন্দীকে মুক্তি দেওয়ার আগে ই$ড়া/লি কর্তৃপক্ষ সাধারণত তাদের কাছ থেকে একটা অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর আদায় করে নেয় যে ভবিষ্যতে তারা কখনও "স/ন্ত্রা/সী" কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হবে না। এক্ষেত্রেও তারা বন্দীদের সামনে এই অঙ্গীকারনামা এগিয়ে দেয়। এবং সারির প্রথমদিকে থাকা সাধারণ বন্দীরা তাতে স্বাক্ষরও করে।
এই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করার ব্যাপারটা ছিল নিছকই প্রতীকী। বাস্তবে এ ধরনের প্রতিশ্রুতির কোনো প্রায়োগিক তাৎপর্য থাকে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও নীতিগত অবস্থানের কারণে ইয়াহইয়া সিনওয়ার এবং রুহি মুশতাহা তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। তাদের দেখাদেখি বাকি বন্দীরাও যখন তাদের অবস্থান সমর্থন করে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তখন স্বাক্ষর আদায় করা ছাড়াই তাদেরকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৮৮ সালে সিনওয়ারকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তখনও হামাস পরিপূর্ণভাবে সংগঠিত হয়ে উঠতে পারেনি। তাদের অধিকাংশ কার্যক্রমই তখন সংঘটিত হতো চূড়ান্ত গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে। ২৩ বছর কারাগারের ভেতর কাটিয়ে ২০১১ সালে সিনওয়ার যখন গাযার মুক্ত বাতাসে পা রাখেন, ততদিনে হামাস পরিণত হয়েছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনগণের সরকারে।
রাফাহ বর্ডার দিয়ে সালাহউদ্দিন রোড হয়ে তিনি যখন গাযায় প্রবেশ করেন, তখন দুই পাশ থেকে কাসসাম ব্রিগেডসের সৈন্যরা তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে স্বাগত জানায়। তাকে দেখার জন্য ছুটে আসে গাযার হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু।
সেদিন রাতে ইসমাইল হানিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে এক বিশাল জনসভার সামনে ইয়াহইয়া সিনওয়ার যখন ভাষণ দেন, সেই ভাষণের মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে তার পরবর্তী দিনগুলোর পরিকল্পনা। হামাসের নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, "রেজিস্ট্যান্সকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন বাকি বন্দীদেরকে মুক্ত করার শপথ গ্রহণ করে।"
তিনি বলেন, সকল বন্দীকে মুক্ত করার জন্য রেজিস্ট্যান্সকে অবিলম্বে একটা কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং এই লক্ষ্যে তাদের সকল প্রচেষ্টা নিয়োগ করতে হবে। ...
বই: দ্য রোড টু অপারেশন আল আকসা ফ্লাড
লেখক: মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা