01/11/2025
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান: বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের বাস্তববাদী রূপকার
সারসংক্ষেপ (Abstract)
এই প্রবন্ধে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দর্শন এবং রাষ্ট্রগঠনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সংস্কার, এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনে তাঁর অবদানকে নতুন বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধটি প্রমাণ করে যে, জিয়াউর রহমান কেবল একজন সামরিক নেতা নন—তিনি ছিলেন রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এক বাস্তববাদী স্থপতি, যার নেতৃত্ব বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ ও উন্নয়নের ধারাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
১. ভূমিকা
বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের ইতিহাসে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা একটি রূপান্তরকারী অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৮১ সালের তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এমন এক যুগের প্রতিনিধিত্ব করেন যেখানে রাষ্ট্রনির্মাণ, জাতীয়তাবাদ, এবং প্রশাসনিক বাস্তবতা একই সূত্রে গাঁথা ছিল। গবেষক আনিসুজ্জামান (2012) উল্লেখ করেছেন, “জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধুনিকতার ভাষা পুনঃপ্রবর্তন করেন, যেখানে উন্নয়ন ছিল জাতীয় পরিচয়ের অংশ।”
২. মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব ও ঐতিহাসিক ঘোষণা
১৯৭১ সালের মার্চে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণা—
> “আমি মেজর জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিচ্ছি”—
স্বাধীনতার প্রাথমিক সংগঠন পর্যায়ে রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টিতে গভীর মনস্তাত্ত্বিক ভূমিকা রাখে (Rahman, 1986)। তাঁর নেতৃত্বে ১১ নম্বর সেক্টর গঠন, গেরিলা কৌশল ও সংগঠন দক্ষতা মুক্তিযুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে (Islam, 2003)।
৩. যুদ্ধোত্তর প্রেক্ষাপট ও রাষ্ট্র পুনর্গঠন
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, ও প্রশাসনিক জটিলতা রাষ্ট্রের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৫–১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তন করেন (Chowdhury, 1999)।
তাঁর স্লোগান—“আমরা সবাই কাজ করি, দেশ গড়ি”—দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মনিষ্ঠার সামাজিক সংস্কৃতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪. বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ: একটি নতুন রাষ্ট্রদর্শন
জিয়াউর রহমানের “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” (Bangladeshi Nationalism) ছিল ভূখণ্ড, নাগরিকত্ব ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভিত্তিতে নির্মিত এক নতুন রাজনৈতিক দর্শন। এটি মূলত পূর্ববর্তী “বাঙালি জাতীয়তাবাদ”-এর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রিকতার বিপরীতে রাষ্ট্রিক বাস্তববাদে ভিত্তিক (Kabir, 2010)।
এই দর্শন বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার বহুধর্মী, বহুভাষিক সমাজ হিসেবে সংহত করে। ফলত, জাতীয় ঐক্যের ধারণা ধর্মনিরপেক্ষতার একরৈখিক ব্যাখ্যা থেকে মুক্ত হয়ে বহুত্ববাদী রাষ্ট্রচেতনা অর্জন করে।
৫. অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়ন কাঠামো
জিয়াউর রহমানের অর্থনৈতিক দর্শন ছিল “উৎপাদনমুখী উন্নয়ন।” তাঁর প্রশাসনে কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার, সেচব্যবস্থা, এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয় (Ahmed, 2015)।
বিআরডিবি (Bangladesh Rural Development Board) প্রতিষ্ঠা এবং “গ্রাম হবে শহর” নীতির মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়। তিনি আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতিকে জাতীয় মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত করেন—একটি ধারণা যা ১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ এশীয় উন্নয়ন নীতিতেও প্রভাব ফেলে।
৬. বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক বাস্তববাদ
জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি ছিল “Realist Diplomacy”—যেখানে আদর্শের চেয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ অগ্রাধিকার পায়। তিনি OIC, NAM (Non-Aligned Movement) এবং UN-এর মঞ্চে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় অবস্থান নেন (Hossain, 2004)।
তাঁর সময়েই SAARC-এর ধারণাগত ভিত্তি রচিত হয় (Rahman, 2002), যা পরবর্তীতে আঞ্চলিক সহযোগিতার কাঠামো তৈরি করে।
৭. বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন
১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করে একদলীয় রাজনৈতিক স্থবিরতা ভেঙে দেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দ্রুতই প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় (Riaz, 2016)।
যদিও তাঁর রাজনৈতিক ব্যবস্থা সামরিক পটভূমি দ্বারা প্রভাবিত ছিল, তবুও তিনি সাংবিধানিক কাঠামো ও নির্বাচনী রাজনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন
৮. মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভিযানে তাঁর মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। তবুও তাঁর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও রাজনৈতিক বহুত্ববাদ—বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে (Jahan, 2019)।
জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকার আজও দুইভাবে মূল্যায়িত—সমর্থকেরা তাঁকে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের স্থপতি হিসেবে দেখেন, আর সমালোচকেরা সামরিক রাজনীতির বৈধতা প্রদানের প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
৯. উপসংহার
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন এক বাস্তববাদী রূপকার, যিনি মুক্তিযোদ্ধার মানসিকতা নিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠন শুরু করেন। তাঁর দর্শন জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করে বাংলাদেশের উন্নয়নপথকে নতুন ভিত্তি দেয়।
এই প্রবন্ধের বিশ্লেষণ নির্দেশ করে—জিয়াউর রহমানের অবদান শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকেও বাংলাদেশের জাতীয় চেতনা পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছে।
লেখক: ডা রুবেল হোসেন সরকার
তারিখ: পহেলা নভেম্বর ২০২৫