16/08/2024
বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা ২০২৪
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে চরম গণ-অসন্তোষে ৫ আগষ্ট ২০২৪ খ্রিঃ তারিখে স্বৈরাচার সরকারের পতনের ফলে জনমানুষের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্র সংস্কারের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা প্রণয়ন করা হলো। বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ রূপরেখার অধিকতর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও যৌক্তিকীকরণ করা যেতে পারে।
রাষ্ট্র সংস্কারের মূল লক্ষ্য
রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমূক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা—যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে (প্রস্তাবনা-বাংলাদেশের সংবিধান)।
রাষ্ট্র সংস্কারের ১২ দফা
(১) রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান অঙ্গ - নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা, বিচারবিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, যাতে একে অপরের উপর ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের প্রয়োগ থেকে বিরত থাকিবেন।
(২) রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের অধীনে বিচার বিভাগ সৃষ্টি এবং বিচারপতি নিয়োগের জন্য আলাদা কমিশন গঠন বা আইন প্রণয়ন করিতে হইবে (অনুচ্ছেদ ২২, সংবিধান)।
(৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না (অনুচ্ছেদ ২৮/১, সংবিধান)। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করিতে হইবে।
(৪) কোন ব্যক্তিতে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না (অনুচ্ছেদ ৩৫/৫, সংবিধান)। আয়নাঘর, টর্চার সেল, আদালতের কাঠগড়া/লোহার খাঁচার বিলুপ্তি বা অপসারণ। জেলখানায় নির্ধারিত স্থানে অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পদ্ধতি চালু করিতে হইবে।
(৫) প্রত্যেক নাগরিকের প্রবেশ, তল্লাশী ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তালাভের অধিকার থাকিবে; এবং চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ে গোপনতা রক্ষার অধিকার থাকিবে (অনুচ্ছেদ ৪৩, সংবিধান)। টেলিফোনে আড়িপাতা, মোবাইল চেক করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক, টিকটক, ইনস্ট্রাগ্রাম, টুইটার, ইমেইল ইত্যাদি) আড়িপাতা বা বাধা সৃষ্টি প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করিতে হইবে।
(৬) আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক এককাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে (অনু্চ্ছেদ ৫৯, সংবিধান)। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব-কতর্ব্য সুনির্দিষ্ঠ করিতে হইবে।
(৭) সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাজনৈতিক দল হইতে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোটদানের কারণে আসন শূন্য হওয়া বিলোপ এবং ৭৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে হইবে।
(৮) বাংলাদেশের প্র্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকদের মধ্যে পরবর্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন (অনুচ্ছেদ ৯৬, সংবিধান)। কাউন্সিলের অন্যতম মূল দায়িত্ব হইবে বিচারকগণের জন্য পালনীয় আচার আচরণ বিধি নির্ধারণ করা।
(৯) নির্বাচন কমিশনের প্রধান দায়িত্ব হইবে প্রাপ্ত বয়স্ক (আঠার বৎসর পূর্ণ) সকল নাগরিকের ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা প্রধানের যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা (অনুচ্ছেদ ১২২, সংবিধান)। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করিতে হইবে (অনুচ্ছেদ ১২৬, সংবিধান)।
(১০) রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে- এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা (অনুচ্ছেদ ১৪, সংবিধান)। নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবন যাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে……..রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন বিধানের যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করিতে হইবে ।
(১১) রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টি, এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন (অনুচ্ছেদ ১৭, সংবিধান)।
(12) সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্রপতি এবং ৫৫-৫৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ, কাজের পরিধি ও ক্ষমতা প্রয়োগের ভারসাম্য রক্ষার লক্ষ্যে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন আবশ্যক।
ড.আবুল হোসেন
অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা এবং নির্বাহী পরিচালক
সেন্টার ফর পলিসি এন্ড ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (সিপিডিআর)
বাংলাদেশ, ইমেইল: chossain2019@gmail.com