30/10/2025
📍The Evil Child📍
১০ বছর বয়েসী ছেলে শিশুকে নিয়ে মা আসলেন চেম্বারে৷ মার কম্পলেইন- ছেলে প্রচুর মিথ্যা কথা বলে, অহেতুক মিথ্যা, যেটা কেন সে বলে মা ভেবে পায়না। পড়াশুনায় একদমই অনাগ্রহী। স্কুল থেকে নিয়মিত কম্পলেইন আসে তার অমনোযোগীতা ও দুষ্টুমির জন্য। কারো সাথে তেমন বন্ধুত্বও করতে পারেনা৷
মার থেকে মূল কম্পলেইন্টসগুলো শোনার পর তাকে বাইরে বসতে বলে আমি বাচ্চাকে আলাদাভাবে ইন্টারভিউ করা শুরু করলাম।
- আকাশ (ছদ্মনাম), মা যা বলল সব ঠিক?
- - হ্যা ঠিক (মুখে হাসি)
- আচ্ছা তারমানে তুমি আসলেও মিথ্যা কথা বলো রাইট?
প্রবলবেগে হ্যা বোধক মাথা নাড়াল আকাশ। মুখে মুচকি মুচকি হাসি।
- কিন্তু কেন বলো?
এবার আকাশ নড়েচড়ে বসল। ' বলব, কিন্তু প্রমিস মাকে বলা যাবেনা! এটা তোমার আমার সিক্রেট!'
- মাকে বলব না বলেই তো বাইরে বসতে বললাম, তুমি বলো।
আকাশ কিছুটা আশ্বস্ত হল...
-- আসলে আমি যে অকাজগুলা করি, সেগুলো যদি সত্যিটা মাকে বলি তাহলে মা বলে, 'আজকে তাহলে তোমার মোবাইল দেখা বন্ধ', 'আজকে ওটা করতে পারবেনা, এটা করতে পারবেনা'। এজন্য আমি সত্যিটা বলিনা!
- আচ্ছা তাই?? কিন্তু এই 'অকাজ'গুলো কিরকম?
- - এই যেমন স্কুল থেকে দেরি করে আসি, ইচ্ছা করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি সাইকেল নিয়ে। তারপর আরো আছে.. (বলেই আবার সেই মুচকি হাসি)
এরপর একে একে আমি আকাশের অকাজের কিছু নমুনা শুনতে লাগলাম- স্কুলের বাচ্চাদের সাথে মারামারি করা (সম্প্রতি এক ছেলের হাতে এত জোরে মেরেছে যে হাত ফুলে গেছে, আজ সেটা নিয়ে কম্পলেইন করেছে টিচার), রাস্তাঘাটের কুকুরকে বিনা কারনেই ভয় দেখানো বা মারা, কোরবানীর গরুকে বিরক্ত করা, বড়রা কিছু নিষেধ করলে ইচ্ছা করেই সেটা বারবার করা, নিয়ম করে প্রতিনিয়ত বিল্ডিং এর সবার বাসায় বেল দিয়ে পালিয়ে যাওয়া আরো অনেক.. অনেককিছু। জিজ্ঞেস করলাম লেখাপড়া কেন করোনা?
- লেখাপড়া বোরিং!
- - হ্যা লেখাপড়া আসলে কঠিনই, এটা ঠিক। কিন্তু তারপরও লেখাপড়া তো করতে হয় তাইনা?
সাথে সাথে আকাশ আমাকে কারেক্ট করে দিল- 'কঠিন না, বোরিং! আমার বোরিং লাগে। ভাল্লাগেনা!'
- কিন্তু ভাল না লাগলেও না করে তো উপায় নাইআ তাইনা? অনেক কিছুই এমন আছে যেটা আমাদের আসলে ভাল্লাগেনা কিন্তু না করে উপায় নাই তাই করতে হয়।
- - কিন্তু আমি না করে থাকতে পারি। (আবার সেই মুখ টিপে হাসি)
- কিভাবে?
- - যেমন সন্ধ্যা থেকে পড়তে বসি বসি করে বসব না, তারপর মা বিরক্ত হয়ে বলবে, 'আকাশ তুমি এটলিস্ট আধাঘন্টা পড়ো। তারপর ঘুমিয়ে যাবে।' তখন আমি ওয়াশরুমে যাব। তারপর ওয়াশরুমে আধাঘন্টা থেকে চলে আসব! 😁
মনে মনে ভাবলাম, ছেলের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়!!
- তোমার তাহলে কি করতে ভাল্লাগে আকাশ?
- - আমার 'অকাজ'ই করতে ভাল্লাগে!
- মানে?
- - মানে যেগুলো সবাই নিষেধ করে সেই কাজগুলোই মজা লাগে আমার!
- কিন্তু মজা লাগলেই কি আমরা সব করতে পারি বলো??
- - কেন পারব না?
- এই যেমন তুমি যে কুকুরকে মারো বা ভয় দেখাও, এতে তো ওরা কষ্ট পায় তাইনা?
- -হ্যা পায়!
- তো এভাবে কি কাউকে কষ্ট দেয়া ঠিক?
- - অন্যরা কষ্ট পেলে আমার কী! আমিতো পাইনা!!!
শেষ কথাটা শুনে ডায়াগনোসিস কোনদিকে যাচ্ছে ভেবে শংকিত হলাম। এরপর আরো অনেক কিছুই বলল আকাশ। সব কথার মূল কথা হল তার সেগুলাই ভাল্লাগে যেগুলো সবার চোখে খারাপ বা অকাজ, এই খারাপ কাজগুলোই তার কাছে ইন্টারেস্টিং তাই সে সেগুলো বারবার করবে, আর পড়াশুনা তার কাছে বোরিং আর বোরিং কাজের জন্য তাকে যেটাই দেয়া হোকনা কেন, সে কখনোই সেটা করবেনা!
আকাশের সাথে কথা বলা শেষে আমি আবারো আকাশের মার সাথে আলাদাভাবে কিছুক্ষন কথা বললাম। আরো নতুন কিছু তথ্য জানতে পারলাম। মা জানালেন আকাশের কিছু কিছু সমস্যা আরো ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়েছে। যেমন তার যখন ৫-৬ বছর বয়স তখন থেকেই সে প্রায়ই বাসা থেকে বের হয়ে যেত অর্থাৎ হারিয়ে যেত। কোথায় যেত কেউ জানেনা, আবার নিজে নিজেই কিভাবে যেন ফেরত আসত, মাঝেমধ্যে খুজে নিয়ে আসতে হত। ইদানীং সে স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই কোথাও চলে যায় যার জন্য তার বাসায় আসতে দেরি হয়, কিন্তু কোথায় যায় সেই সত্যিটা তার থেকে বের করা যায়না! আবার ইদানীং মা তার প্যান্টের পকেটে প্রায়ই টাকা পায়, যেগুলো মা বা বাবা তাকে দেয়না৷ সম্ভবত সে বাবা-মার ব্যাগ থেকে এগুলো চুরি করে৷ সবচেয়ে ভয়ংকর যে তথ্যটা দিলেন মা সেটা হল, আকাশতো প্রায়ই ওনার মোবাইল দেখে, একদিন উনি ওনার মোবাইলের সার্চ হিস্ট্রি ঘেটে দেখলেন সেখানে পর্ন সাইটের হিস্ট্রি! এটা দেখে ওনার পৃথিবী চুরমার হয়ে যায়। উনি কান্না করছিলেন আর বারবার বলছিলেন আমার ছেলেটা আরেকটু বড় হলেও আমি মেনে নিতাম, কিন্তু এত ছোট বয়সে ও এগুলো কেন করবে??!
আকাশের ফ্যামিলি হিস্ট্রি হল তার মা একজন স্কুলটিচার, বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করেন। বাসায় বাবা মা ছাড়াও দাদী আছেন আর আকাশের একটা ছোট ভাই আছে।
আকাশের ডায়াগনোসিস- 'Conduct Disorder'
এবার আসি Conduct Disorder কী সেই বিষয়ে। সোজা বাংলায় কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার হল সেই অসুখ যেখানে ব্যক্তি এমন কিছু কাজ বারবার করে যেই কাজগুলো সামাজিক নীতিবিরুদ্ধ এবং অন্যের মৌলিক অধিকার নষ্ট করে৷ The Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders (DSM-5) অনুযায়ী, কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডারের ব্যক্তির মধ্যে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায়-
📌১. মানুষ এবং অন্যান্য প্রানীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরন (যেমন: কাউকে bully করা থেকে শুরু করে খালি হাতে বা অস্ত্র নিয়ে মারামারি করা, অহেতুক কোনো প্রানীকে বিরক্ত করা বা কষ্ট দেয়া, ছিনতাই, কাউকে যৌনকর্মে বাধ্য করা ইত্যাদি)
📌২. ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের সম্পদ নষ্ট করা (যেমন: ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিবেশীর বাগান নষ্ট করা, আগুন ধরিয়ে দেয়া ইত্যাদি)
📌৩. প্রতারনা বা চুরি করা (ধোকা দিয়ে অন্যের কাছ থেকে কিছু আদায় করে নেয়া, কারো বাসা বা দোকানে গিয়ে কিছু চুরি করে আনা বা আরো গুরুতর অবস্থায় কারো ঘর বা দোকান ভেংগে লুটপাট করা ইত্যাদি)
📌৪. গুরুতরভাবে নিয়ম লংঘন করা (যেমন: নিয়মিত স্কুল পালানো, বাবা মায়ের নিষেধ স্বত্ত্বেও বাসার বাইরে রাত কাটানো বা কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে চলে যাওয়া এবং লম্বা সময় ধরে ফিরে না আসা যেগুলো মোটামুটি ১৩ বছরের আগেই শুরু হয়।)
এইসকল কাজ যদি কেউ একবার বা দুবার করে তবেই কী তার কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার আছে বলা যাবে? না। অন্তত ১ বছর যদি কারো মধ্যে কন্ডাক্ট ডিজর্ডারের সিম্পটমগুলো থাকে তবেই তাকে আমরা কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার বলতে পারব।
DSM-5 অনুযায়ী এটি একটি চাইল্ড সাইকিয়াট্রিক ডিজঅর্ডার যেটি শুরু হতে পারে জীবনের দুই সময়ে- ১০ বছর বয়সের আগে (অন্তত একটি লক্ষনের শুরু ১০ বছর বয়সের আগে) যেটিকে আমরা চাইল্ডহুড অনসেট কন্ডাক্ট বলছি আরেকটি হতে পারে ১০ বছরের পরে। এবং গবেষনামতে চাইল্ডহুড অনসেট কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডারের পরিনতি খুব বেশি ভাল না কেননা এটি পরিনত বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ সারাজীবনই থেকে যেতে পারে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ ও মাদকাসক্তির দিকে এদের ঝোকার সম্ভাবনা থাকে এবং ধীরে ধীরে বিভিন্নরকম অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে যায়।
আপনাদের মনে হতে পারে এরকম লক্ষনের অনেক মানুষ/ অনেক অপরাধী তো আমরা আমাদের আশেপাশেই দেখি। হ্যা তা দেখি, কিন্তু ভাবুন তো আমরা যেখানে বলে থাকি শিশুরা হয় কোমলমতি, সেখানে একটি ১০ বছরের বাচ্চা যার কারো প্রতিই কোনো রকম সহমর্মিতা নেই উপরন্তু বিনা কারনে অন্যকে নির্যাতন করছে, পশুপাখিকে অত্যাচার করছে, নিজের প্রয়োজনে অন্যকে ঠকাচ্ছে, এবং এই নিয়ে তার মধ্যে কোনো অপরাধবোধও নেই৷ তখন আপনাদের মনে প্রথম কথাটি কি আসবে?
"Is this child really ill or evil??"
না, আমাদের কাছে কোনো শিশুই Evil না। তার আপাত কর্মকান্ড হয়ত Evil, কিন্তু এটিকে সাইকিয়াট্রির অন্য আর দশটা ডিজঅর্ডারের মতই ডিজঅর্ডার হিসেবে ট্রিট করাটা একজন চাইল্ড সাইকিয়াট্রিস্টের কর্তব্য। কেননা এমনিতেই এধরনের শিশুদের তাদের আচরনের জন্য সমাজের সবাই নিন্দা করে, উপরন্তু তাদের বাবা-মায়েরাও সবসময় একধরনের লজ্জা এবং অপরাধবোধের মধ্যে থাকে যেটার জন্য এরা বেশিরভাগ সময়েই কোনো প্রফেশনালের কাছে সাহায্য নিতে যায়না কিংবা গেলেও ট্রিটমেন্ট কন্টিনিউ করেনা।
যদিও আকাশের ক্ষেত্রে ট্রিটমেন্টের প্রগনোসিস খুব ভাল হবে এমনটা বলা কঠিন কারন একে তো তার এটা চাইল্ডহুড অনসেট, তার উপর তার মধ্যে 'CU' trait বিদ্যমান। CU trait মানে Callous, Unemotional trait- অর্থাৎ যাদের মধ্যে মানবীয় আবেগ অনুভুতির মাত্রা খুবই কম, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা বা এম্প্যাথি জিনিসটা থাকেনা বললেই চলে এবং নিজের কৃতকর্ম নিয়ে তাদের কোনোরকম অনুশোচনা হয়না। এই CU trait হল traits of Psychopathy। কাজেই এদের ক্ষেত্রে হায়েস্ট পসিবিলিটি থাকে বড় হয়ে অর্থাৎ ১৮ বছরের পর Antisocial Personality Disorder (সাধারন মানুষের কাছে/নাটক সিনেমায় যেটা সাইকোপ্যাথ নামে পরিচিত) ডেভেলপ করার।
এবারে জানা যাক সমস্যার কারন সম্পর্কে। এই সমস্যার অসংখ্য কারন থাকতে পারে যার মধ্যে জেনেটিক প্রিভ্যালেন্স অর্থাৎ বংশগতি থেকে শুরু করে শিশুর নিজস্ব টেম্পারামেন্ট, পারিবারিক সহিংসতা, বাবা-মায়ের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও প্যারেন্টিং এর যেকোনো অসংগতি (অতিরিক্ত শৃঙ্খলা কিংবা শৃঙ্খলাবিহীন প্যারেন্টিং) যেকোনটাই হতে পারে। আকাশের ক্ষেত্রে ঠিক কোন কারনটি বা কারনগুলো বিদ্যমান সে ব্যাপারে প্রথম দিনই জানার সুযোগ আমার হয়নি, আশা করি পরবর্তী ভিজিটে এই বিষয়টা সম্পর্কে জানতে পারব।
আকাশের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হল লং টার্ম সাইকোথেরাপি। পরিবারের ইনভলভমেন্ট এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্যারেন্টিং এবং বিহেভিয়ার মডিফিকেশন ট্রেনিংয়ে পরিবারের এক্টিভ রোল প্লে করতে হবে৷ সেই সাথে আকাশের স্কিল ডেভেলপমেন্ট, প্রবলেম সলভিং স্কিলস এগুলো বাড়াতে হবে। আকাশের কিছু ভাল দিক আছে, যারমধ্যে সবচেয়ে ভাল দিক হল তার ইন্টেলিজেন্স৷ সে লেখাপড়া বাদে আরো অনেক কিছুতেই ভাল যেমন ক্রিকেট খেলা, সাইকেল চালানো, ড্রইং ইত্যাদি। তার এই স্ট্রেন্থগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে, তাকে এসবে বেশি বেশি এংগেজ করতে হবে যাতে এসবের রিপ্লেসমেন্টে তার 'অকাজ'গুলোকে কিছুটা কমিয়ে আনা যায়।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা প্রয়োজন এখানে সেটি হল ধৈর্য্য। কারন থেরাপিগুলো শুনতে যত সহজ মনে হচ্ছে বাস্তবে এদের প্রয়োগ তত সহজ না এবং যে দীর্ঘ সময় এর পিছনে দিতে হবে সেটা দেয়ার মত সময়, অর্থ, ধৈর্য্য অনেকেরই থাকেনা। অনেক বাবা মা সন্তানের একটা দুটা সেশন নিয়েই রাতারাতি পরিবর্তন আশা করেন। তাদেরকে বুঝাতে হবে যে একটি কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডারের শিশু থেরাপি নিলে ভাল হবার সম্ভাবনা যেমন ফিফটি -ফিফটি, তেমনি থেরাপি না নিলে ভাল হওয়ার সম্ভাবনা অলমোস্ট শুন্যের কাছাকাছি।
সবশেষে মহানগরের ডিসি হারুনের মত আমাদের মনে রাখতে হবে দুইটা কথা- ✌️
1. No child is born evil, and
2. Change is possible. 🌸🌸🌸🤞
🍀ডা. মাহাবুবা রহমান
এমবিবিএস, এমডি (চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি)
এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অব সাইকিয়াট্রি
মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন এন্ড হসপিটাল, উত্তরা।
সেশনঃ ০৯-১০