23/09/2025
📌বহুরূপী চিকুনগুনিয়া
===
১. তিথি: সজীব শরীরের নিঃশব্দ অভিশাপ
তিথি আগে খুব সক্রিয় ছিল। বুয়েটে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে আছে। সকালে হোস্টেলে চায়ের আড্ডা না হলে দিন শুরু হতো না।
তার হাত ছিল তাঁর অস্ত্র, লেকচার লিখে নেয়া, ক্লিনিক্যাল স্কেচ আঁকা, আর মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে হেসে হেসে গানের তালি দেয়া।
চিকুনগুনিয়া ধরা পড়লো হঠাৎ একদিন সকালে হালকা মাথাব্যথা, তারপর ১০৩ ডিগ্রি জ্বর।
পরের দিন থেকেই তিথি বুঝলো কিছু একটা ঠিক নেই। তার আঙুলগুলো ফুলে গেছে, কবজিতে ব্যথা, মনে হচ্ছিল কেউ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।
জ্বর নামলো তিন দিনে, কিন্তু হাতের ব্যথা নামলো না।
তিথি জানলো এটা চিকুনগুনিয়ার একদম ক্লাসিক acute inflammatory arthritis।
ডাক্তারের কণ্ঠে সহানুভূতি ছিল, কিন্তু একরকম নির্লিপ্ততাও-
"এমন হতেই পারে, সময় দাও।"
কিন্তু তিথির সময় থেমে গেল। সে আর খাতায় নোট নিতে পারলো না। হোস্টেলের বারান্দায় বসে, যখন সে অন্যদের দেখতে পেত হেঁটে যাচ্ছে, তখন সে ফিসফিস করে বলত, মানুষ কিভাবে এমন অনায়াসে হাঁটতে পারে, অথচ সে আগে দৌড়াতো”
২. সিঁথি: সুস্থতার ফাঁকি
সিঁথির জীবন বরাবরই গোছানো, নিয়মিত শরীরচর্চা, প্রতিদিন হাঁটাহাঁটি।
চিকুনগুনিয়া তার শরীরে এসেছিল, একদিন হালকা জ্বর, মোটামুটি তীব্র জয়েন্ট ব্যথা, দুদিন হালকা ক্লান্তি, তারপর একদম ঠিক।
"আমি তো কিছুই টের পেলাম না," সে তিথিকে বলেছিল গর্ব করে।
কিন্তু দুই সপ্তাহ পরে, যখন হাতের কবজিতে একদিন হঠাৎ আবার ব্যথা শুরু হলো, তখন সে ভেবেছিল মুভি দেখে ঘাড় বেঁকিয়ে ঘুমিয়েছিল বোধহয়।
পরদিন সেই ব্যথা হাঁটু পর্যন্ত নেমে এলো। তারপর কনুই।
সিঁথি চিন্তিত হয়ে ডাক্তার দেখালো। রিপোর্টে সবকিছুই মোটামুটি ঠিক, কিন্তু ব্যথা বাড়ছে।
ডাক্তার বললেন,
“এটা relapsing post-viral arthritis, অনেকসময় চিকুনগুনিয়ায় এমন হয়। ভাইরাস চলে গেছে, কিন্তু ইমিউন সিস্টেম এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।”
সিঁথি অবাক হলো।
নিজের শরীরই নিজের শত্রু?
৩. অথৈ: দেরিতে ভেসে ওঠা ব্যথা
অথৈয়ের জ্বর ছিল তিনদিন, হালকা ধরনের। সে নিজের মনের আনন্দে বলেছিল,
“চিকুনগুনিয়া আমায় ভয় পেল! কোন ব্যথাই টের পেলাম না”
বন্ধুরা যখন ব্যথায় কাতর, অথৈ তখন নুড়ি কুড়িয়ে ছবি তুলছে। কিন্তু সেই উৎসব টিকলো না।
জ্বর চলে যাওয়ার ছয়দিন পর, সে সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল পায়ের গোড়ালি ফুলে আছে, হাঁটা প্রায় অসম্ভব।
তার পা যেন লম্বা রডে বাঁধা, হাড়ের ভেতরে কেউ যেন চিবিয়ে যাচ্ছে।
বাবা ভেবেছিলেন গেঁটে বাত। কিন্তু চিকিৎসক বললেন,
“এটা delayed-onset post-viral arthritis, চিকুনগুনিয়ারই আরেক মুখ।”
অথৈ স্তব্ধ। সে বলল না কিছু, শুধু মনে মনে ভাবলো—
“এই ভাইরাস তো যেন কুয়াশার মতো, একবার দেখা যায়, অদৃশ্য হয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে!”
৪. মনি: সুর হারানো আঙুল
মনি ছিল গিটারিস্ট। বিকেলে বেহাল কণ্ঠে গান গাওয়ার সাথে সাথে চলতো নিখুঁত ফিঙ্গার পিকিং।
আগে থেকেই তার হালকা হালকা জয়েন্ট পেইন ছিল, যা সে পাত্তা দিত না।
চিকুনগুনিয়ায় জ্বর এসেছিল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু তিন মাস পেরিয়ে গেলেও, তার হাতের আঙুলগুলো শক্ত হয়ে রইল। সকালে উঠেই সে হাত খুলতে পারত না। আঙুল বাঁকা হয়ে গেছে—জীবনের সুর যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
ডাক্তার বললেন,
“তোমার এই Chronic chikungunya arthritis এখন অনেকটাই rheumatoid arthritis-এর মতো আচরণ করছে। ঠিকমতো চিকিৎসা না করলে joint স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে।”
মনি জানত, সে যে আঙুল দিয়ে সুর তোলে, সেই আঙুল এখন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
সে গিটারের তার ছুঁয়ে বলল,
আমি কি আর কখনও তোদের বাজাতে পারব, বন্ধুরা?”
৫. বিউটি: ঘোরের ভেতর ঝড়
বিউটির জ্বর এসেছিল হুট করে, তাতে তীব্র গিরায় ব্যথা। শরীরটা কেমন যেন গরম-গরম, চোখজোড়া ঝাপসা, মাথা ভার হয়ে আসছিল।
সে ভাবল, চিকুনগুনিয়া হবে বোধহয়, আশেপাশে তো অনেকেই আক্রান্ত।
কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর সে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল।
মাহবুব বারবার ডাকছিল—“বিউটি! চোখ খোল তো !”
কিন্তু বিউটির চোখ ছিল নিথর, হাত পা অবশ, মুখ থমথমে।
তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে।
“জ্বর তো ছিল, কিন্তু ও নড়াচড়া করছে না কেন?” স্বজনেরা কাঁপা কণ্ঠে বললেন।
চিকিৎসকরা প্রথমে ধরেই নিয়েছিলেন—ডিহাইড্রেশন, হাইপোগ্লাইসেমিয়া হবে।
কিন্তু পরে দেখা গেল বিউটির মস্তিষ্কে ভাইরাস হানা দিয়েছে।
এটা Chikungunya Encephalitis-একটি বিরল, কিন্তু বিপজ্জনক জটিলতা।
চিকিৎসকদের চোখে এটা একটা রহস্য, এমনকি ভয়ও।
চিকুনগুনিয়ায় অজ্ঞান হওয়া?
এটা কি কোনো নতুন স্ট্রেইনের কাজ?
নাকি বিউটির শরীর এমনভাবে প্রতিক্রিয়া করেছে যা বহু জনের মধ্যে দুই একজনের দেখা যায়?
বিউটি হাসপাতালে অজ্ঞান ছিল দুই রাত। তার নিঃশ্বাসের শব্দে স্বজনদের বুক কেঁপে উঠতো, একটু নড়াচড়া করলেই স্বজনদের বুক থেকে যেন পাথরটা নেমে যেত।
তৃতীয় দিনের দুপুরে, যখন বিউটি চোখ মেলল, নীতুর কি যে আনন্দ।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সবাই ভেবেছিল এবার বুঝি সব ঠিক হবে।
কিন্তু পরের দিনই সবাই দেখলো তার গায়ে rash উঠছে, তারও দুদিন পর সে বলল “আমার ankle এ ব্যথা খরছে, ফুলে যাচ্ছে। কনুইতে গরম গরম লাগছে।”
এইবার সে বুঝলো, ভাইরাস শুধু মস্তিষ্কেই থেমে থাকেনি
শরীরের হাড়গুলোতেও যেন বিষ ঢেলে দিচ্ছে।
বিউটি জানতো না-সে যখন ঘুমিয়ে ছিল, তার শরীরের ভেতর একটা যুদ্ধ চলছিল।
আর জেগে উঠে সে বুঝলো এই যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।
চিকুনগুনিয়া তাকে শুধু ক্লান্ত করেনি, তাকে এক নতুন মানুষের মতো গড়ে দিয়েছে।
যে মানুষ আর কেবল "জ্বর" বলে হালকা করে ভাবে না,
সে জানে একটা ভাইরাস কখনো মস্তিষ্কের গভীরে, কখনো হাড়ের ভেতরে এমন ঝড় তোলে, যা বাইরের কেউ বুঝতেই পারে না।”
ডাক্তার বললেন,
“এটা Chikungunya-associated encephalitis with subsequent post-viral arthritis”। চিকুনগুনিয়ার মতো ভাইরাসে মস্তিষ্ক ও জয়েন্ট, দুটোই আক্রান্ত হতে পারে। একসাথে হওয়া বিরল, কিন্তু অসম্ভব না।”
তিথি, সিঁথি, অথৈ, মনি আর বিউটি- পাঁচটি ভিন্ন গল্প।
তাদের শরীরে ঢুকে ছিল একটাই শত্রু- চিকুনগুনিয়া ভাইরাস।
কিন্তু প্রতিক্রিয়া? একেকজনের শরীর, একেক রকম যুদ্ধের ময়দান।
কেউ সঙ্গে সঙ্গে জর্জরিত হয়,
কেউ ব্যথাহীন থেকে হঠাৎ ভেঙে পড়ে,
কেউ সুস্থ হয়ে আবার ভাঙে,
আর কেউ পুরনো ব্যথাকে পাথরে রূপান্তর করে।
কেউ আবার জ্ঞান হারায়।
যুদ্ধ শেষে শেষমেষ এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের একদিন বিজয় হবে।
©Aminul Islam
(চিকুনগুনিয়া , ডেংগু হলে হোমিওপ্যাথিক ট্রিটমেন্ট নিতে পারেন। ইনশা আল্লাহ সুস্থ হবেন। তবে যাদের ধইর্য্য শক্তি কম তারা অন্য মেডিসিন খেতে পারেন এবং অনেক মাস পর্যন্ত ভুগতে পারেন! 🙂 )
Sanjida Homeo Health Clinic