25/06/2025
জীবনের খুব কঠিন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি সময়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি,
তারিখটা ছিলো ০২ জানুয়ারি ২০২৫ ইং রোজ বৃহস্পতিবার।
রাত আনুমানিক ৮-৯ টার দিকে আমরা মা- ছেলে একসঙ্গে খাইতে বসি। খাবার শুরু করতেই হঠাৎ মা মাথা ধরে চিৎকার করেন৷ কিছুক্ষণ পর প্রচুর বমি সহ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আজাদ ভাই ও ভাবির কিছুক্ষন সেবা-শুশ্রূষার পর মা কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
তারপর পুনরায় ৩০-৩৫ মিনিট পর মাথা গেলো মাথা গেলো বলে চিৎকার করে উঠে। সেটা এতো ভয়ংকরভাবে হচ্ছিল। জীবনের চেয়ে প্রিয় মানুষটার এমন পরিস্থিতি দেখে জীবনের সবচেয়ে নার্ভাসনেস কাজ করছিলো। হাত পা কাঁপতেছিলো, আমার মাথা কাজ করতেছিলো না। প্রচুর কান্না করতেছিলাম। এরপর শাফি ভাই, সেকেন্দার ভাই লাইজু ভাবি কে কল দিয়ে ডাকি, আশিকের মা চাচি, শফিকুল ভাই সহ অনেকেই উপস্থিত হন।
পরে Arfanur Azad (আজাদ) ভাই, Md Rafiqul Islam (রফিকুল) ভাই ও বন্ধু মাইদুল কে সাথে নিয়ে রাস্তার মধ্যে বোন ফাতেমা রুহানি বেবি আপুকে গাড়িতে তুলে নিয়ে মাকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে ভর্তি করাই। সেদিন রাতে প্রচুর কুয়াশা ও ঠান্ডা ছিলো তবুও সেসব কে উপেক্ষা করে সকলেই আমাকে অনেক সহযোগিতা করেন।
পরে বমি বন্ধ সহ ২ রাত হাসপাতালে থাকার পর বড় বোনের বাসায় মাকে নিয়ে ১ রাত থাকি। সেই রাতেই পুনরায় মা আবার অতিমাত্রায় হাইপ্রেশার সহ মাথাব্যথা প্রচন্ড রকমের হয়।
সকালে যে যার মতো কাজে গেলে, মা কে আমি মুরগির মাংস দিয়ে খাওয়াতে গিয়ে সর্বোচ্চ ধাক্কাটি খাই। গিয়ে দেখি মা আমাকেও চিনছে না, এলোমেলো কথাবার্তা, পানি মুখে নিয়ে আমার গায়েই তা দিচ্ছে। অজানা একগুলো শব্দ বলছে মুখ দিয়ে।
এসব দেখে ২ জন মামাতো ভাইয়ের বউ, কাবিল ভাইয়ের বউ ও Farjana Jahan ভাবি, বোন ইতি ও আজাদ ভাইয়ের সহায়তায় রংপুরে নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞের নিকট নিয়ে যাই।
জীবনের সবচেয়ে খারাপ লাগা মূহুর্ত টা শুরু এখানেই। আল্লাহর নিকট অনেক দোয়া করছি আর বলছি আল্লাহ কোনো বড় ধরনের যেনো কিছু না হয়। পরে ডাক্তার যা বললো তা শুনে থমকে যাই। জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ টা এখানেই শুনি
মূহুর্তের মধ্যে আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ার মতো। ডাক্তার বলেন তার (এনিউরিজম) এর কারনে বড় ধরনের স্ট্রোক করেছেন। দ্রুত ঢাকায় নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল অথবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ নিতে হবে।
রাতেই এম্বুলেন্স ভাড়া করে বোন ইতি ও আজাদ ভাইকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেই। গাড়ির মধ্যে ফজর পড়তে পড়তেই নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে পৌঁছি। পথের মধ্যে মামাতো বোন Farhana Mithun (মিথুন) আপুর পরামর্শ মোতাবেক প্রাথমিক চিকিৎসার চেষ্টা করি। ভগ্নিপতি Md Shah Jamil (জামিল) ভাই অনেকজনের নাম্বার দিয়ে সহযোগিতা করেন নিউরোসায়েন্সে একটা সিটের জন্য।
সকালে গিয়ে বড়বোন, মেঝোবোন বড়ভাগ্নে Zobayer Sarker (জোবায়ের), মামাতো ভাই, আরিফ ভাই সহ কয়েকজন উপস্থিত হন।
ভগ্নিপতি Md. Samsuzzaman Topon
ও বড়ভাই Rokonuzzaman Mondol ভাই নিউরো সায়েন্সে সিট পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।
বড়ভাই Md Shafiul ভাই বিভিন্ন জনের নিকট কল দিয়ে অনেক সহযোগিতা করেছেন।
মা প্রায় ১৩-১৪ দিন নিউরোসায়েন্সে ভর্তি ছিলেন। সারাদিন মা NICU তে থাকতেন। ভর্তির পর তার পুরোপুরি জ্ঞান ফেরে। প্রতিদিন আসরের নামাজের পর দিনে মাত্র ১ বার তাও ৩০ মিনিটের জন্য দেখা করতে পারতাম। তবে সর্বোচ্চ একজন দেখা করতে পারতাম।
প্রতিদিন মা বলতো আমি যেনো তার সাথে সাক্ষাৎ করি। তবে আমার বড়বোন কেও দেখতে চাইতেন। আর আমরা গেলেই বলতেন, বাবা আমি সুস্থ আমাকে তোমরা বাসায় নিয়ে যাও। প্রতিদিন কতো অভিমান করতেন, বলতেন তোমরা কেউ আমার সঙ্গে কথা বলবা না আমাকে এখানে একা রেখে গেছো। তাকে ছোটোবাচ্চার মতো অনেক কিছু বুঝিয়ে রেখে আসতে হতো, বলতাম মা NICU রুগির সাথে কাউকে থাকতে দেয়না। যখন রেখে আসতাম তখন বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যেতো, চোখ দিয়ে ঝড়ঝড় করে পানি পড়তো। তবুও নীরবে কেঁদে কেঁদে চলে আসতে হতো।
মাঝে মধ্যে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য বাহিরে নিয়ে আসতে হতো, তখন তার চোখে মুখে সেই কি উচ্ছ্বাস। মনে হতো তার বুকের ধনদেরকে কাছে পেয়েছে আমাদেরও সেই কি মনে আনন্দ পেতাম। মায়ের সুখ টা সর্বোচ্চ নেওয়ার চেষ্টা করতাম। মায়ের জন্য সর্বদা বুকটা হাহাকার করতো।
নীরবে প্রতিটা সময় কেঁদেছি, সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও মা ও বোনদের চোখ ফাঁকি দিতে পারতাম না।
দিনের সেই ৩০ মিনিটের মধ্যেই মা বুঝতে পারতো আমি সারাদিন প্রচন্ড কেঁদেছি। তখন মা বলতো বাবা সারাজীবন কি কেউ বেঁচে থাকে। আমিও একদিন মরবো সেজন্য এতো কাঁদার কি আছে। আর আমি তো সুস্থ।
সে সময় ২ দিন আমার প্রচন্ড জ্বর আসে, সে দুদিন মার সাথে দেখা করতে পারিনি। মা নিশ্চিত ভেবে নিয়েছে আমার জ্বর না হয় অন্য কোনো হইছে। সে দুই দিন বোন ও মামাতো ভাইকে প্রচুর জ্বালাইছে আর বলছে মুন্নার নিশ্চয়ই জ্বর না হয় কোনো সমস্যা হইছে। তা না হলে ও আমার সাথে দেখা না করে থাকতে পারেনা। সবাই বলতো না মুন্নার কিছু হয়নি। তখন মা পাল্টা প্রশ্ন করতো তাহলে মুন্না কেনো আজ দুদিন হলো আসেনা।
এর জবাব সন্তোষজনক না দিতে পারায় তার সেই কি কান্না। পরে সেই কান্না অসুস্থতা নিয়ে আমি যাওয়ার পর বন্ধ হইছে।
প্রথমে রিং পড়ানোর চেষ্টা করে ডাক্তাররা কিন্তু স্ট্রোকের পরিস্থিতি টা এমন হইছিলো রিং পড়ানো সম্ভব হয়নি। পরে NICU থেকে পোষ্ট অপারেটিভ এ নেওয়া হয় সার্জারীর মাধ্যমে অপারেশনের জন্য। পরবর্তীতে স্বাস্থ্য ও বয়স বিবেচনায় ডাক্তাররা আর অপারেশন করেনি। ঔষধ লিখে ছাড়পত্র দেন।
ডাক্তার ও নার্সরা কেনো জানি মাকে খুব আদর করতেন ও সর্বোচ্চ সেবা শুশ্রূষা করতেন। মা ও কেনো জানি সহজেই তাদেরকে আপন করে নিতেন।
আমার এই অসহায় মূহুর্তে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন যার কথা জীবনেও কোনোদিন ভোলার মতো না সেই ব্যক্তি টা হলেন মামাতো ভাই Arif Arman Shohid (আরিফ) ভাই। সে প্রায় প্রতিদিন সব সময় হাসপাতালেই থাকতো। নিজের সন্তানকে মানুষ যেমন আদর করে, সেও ঠিক সেভাবেই তার ফুফু কে আদর করতো। নিয়মিত তার ফুফুর সে সেবাযত্ন করতো।
বন্ধু Appel Mahamud Prodhan প্রতিদিন অফিস শেষে আসতো, মনে সাহস যোগাতো যতোটা সম্ভব সময় পাশে থাকতো । বন্ধু ফাইন ইসলাম বন্ধু Nazibur Noion বন্ধু Md Mamun Mondol বন্ধু Forhad Mondol এর প্রতি কৃতজ্ঞতা।
ভাতিজা Nahid Khondokar নিয়মিত থাকতো। সে সর্বোচ্চ সময় দিয়ে সহযোগিতা করেছে। মামাতো ভাই আব্দুল হাই ভাই নিয়মিত আসতেন।
মামাতো ভাই Md Rasheduzzaman (সাদ্দাম) ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
ফুফাতো ভাই Arif Sumon ভাই ডাক্তার দেখাতে সহযোগিতা ও টাকা হাওলাদ দিয়ে সহযোগিতা।
কৃতজ্ঞতা ভাতিজা জাফর আস সাদিক (জনি) চাচার প্রতি। শাফি ভাই, সেকেন্দার ভাই, সহ আমার রক্তের সম্পর্ক, সকল আত্মীয়, পরিচিত ও প্রতিবেশী সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
সবচেয়ে বড় সহযোগিতা টা পেয়েছিলাম, জেঠাতো ভাই আব্দুল কাফি ভাই। সে সময় প্রায় আড়াই লাখ টাকা হাওলাদ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন।
বিশেষ করে কৃতজ্ঞতা নিউরো সায়েন্সের স্টাফ আতিক মামা সহ গাইবান্ধার যারা সেখানে চাকুরী করেন তারা সবাই আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন।
এছাড়াও চাচাতো বোন সুমনা সহ আরও অনেকে বিভিন্নভাবে কল দিয়ে, অসংখ্য দোয়া, খোঁজ খবর ও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিলেন।
আপনাদের সকলের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞতা। প্রতিটা মূহুর্ত ছিলো উৎকণ্ঠা ও প্রচন্ড ভয় মিশ্রিত সময়। সে সময় আপনাদের যোগাযোগ টা আমাকে প্রচুর সাহস যোগাতো।
অনেক দৌড়াদৌড়ির কারনে অনেকের কল ধরতে পারিনি, এজন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আল্লাহর রহমতে আপনাদের দোয়া ও ভালোবাসায় মা আজও সুস্থ আছেন। নিয়মিত ফলোআপ করতে হয়।
আল্লাহ যে বান্দার ডাকে সাড়া দেন তার উজ্জ্বল একটি প্রমান এটি। আল্লাহ সকলের দোয়া কবুলের মাধ্যমে তার অপার মহিমায় আজও এই কঠিন পরিস্থিতিতে থেকেও মাকে সুস্থ রেখেছেন। এজন্য আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া।
মায়ের হায়াতে বরকতের জন্য আপনাদের নিকট দৃুয়া চাই।