02/11/2021
আমি:
পৃথিবীর বহুল ব্যবহৃত শব্দের মধ্যে আমি শব্দটি অন্যতম।
পৃথিবীর তাবৎ রূপ-রস-গন্ধ সৌন্দর্য এই আমিকে কেন্দ্র করেই। আমির অস্তিত্ব না থাকলে পৃথিবীর সবকিছুই তাঁর কাছে নিষ্ফল, অর্থহীন। কাজেই আমার চলন-বলন ভাষণ তোষণ গতি প্রকৃতি যা কিছুই প্রবাহমান তার সবকিছুর সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে আছে আমি শব্দটি।
ভালোবাসা শব্দটি যেমন প্রচুর উচ্চারিত শব্দ তদ্রূপ আমি'র ব্যবহারেও আমরা প্রতিদিন ধন্য হই।
আমিকে বাদ দিয়ে একজন ব্যক্তি শুধু শূন্যই হয় না বরং অস্তিত্বহীন হয়ে যায়।
আমিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হবে, এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সৃষ্টির জন্য - গড়ার জন্য, পৃথিবীকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আমিত্ব জরুরী।
প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ সবসময়ই আমিত্বকে গুরুত্ব দিয়ে চলতেন। তারা তাদের নিজস্ব শক্তি বা সম্ভাবনা কতটা টের পেতেন তা সব সময় মাপা যেত না। তবে তারা তাদের নিজস্ব দর্শন ও বক্তব্য প্রকাশ্যে ছিলেন অকুতোভয় ।
নিঃসন্দেহে এই সমস্ত কালজয়ী পুরুষ মহিলাদের নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে কিন্তু দিনশেষে তাদের গুণাবলী ও সৃষ্টিশীলতার কাছে মানুষ হার মানে। মানুষ তাদের আমিত্বের অন্তর্নিহিত শক্তিকে মেনে নেয়।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
সক্রেটিস প্লেটো উদাহরণ।
উদাহরণ নেলসন ম্যান্ডেলা।
প্রতিটা মানুষ এই আমি'র আবরণে আচ্ছাদিত।
তাদের সকলের প্রচুর শক্তি। এই শক্তি অনেকে টের পায়, অনেকে পায় না। আর সেই স্থিতি শক্তিটাকে গতিশীল করবে আমিত্ব। আমি পারি, আমাকে পারতে হবে-আর দশজন পারলে আমি কেন পারব না! এই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে তখন ব্যক্তি অপার সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যায়। সেখানেই আমিত্বের মূল খেলাটা।
আমি শব্দটি ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুভাবেই ব্যবহার করা চলে। যখন আমিত্ব অহংকারের প্রতিনিধিত্ব করে তখন তা অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসে, ধ্বংস সেখানে অনিবার্য। কোন সার্থকতা বা কৃতিত্বের বিপরীতে সন্তুষ্টি প্রকাশ, আত্মতুষ্টি ,গৌরব ও অহংকার পরিমিত আকারে থাকাটা দোষের কিছু নয়।
সক্রেটিসের ‘আমি’।
গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। তার বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে : ‘নো দাইসেলফ’। যার মানে করলে দাঁড়ায় ‘নিজেকে জানো’। এই কথাটির মূল নির্যাস হচ্ছে সবকিছ্রু আগে নিজের ‘আমিত্ব’-কে জানো। এই জানাটা এ জন্য জরুরি যে যদি নিজেকেই কেউ না জানে তাহলে সে কখনো ‘আমরা’-কেই জানতে পারবে না।
নিজেকে জানলে গর্ব অহংকার দম্ভের তীব্র ধ্বংসাত্মক গতি নিমিষেই ক্ষমাশীল বিনয়ী ও মানবিক গতিতে রূপ নেয়।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদসমূহে ‘আমি’।
আমিত্ব ফুটে উঠে রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিদের বিভিন্ন ভাষন বচনে। রাষ্ট্র স্বীকৃত এই আমিত্ব অনেকটাই গ্রহনযোগ্য।
আমাদের সংবিধানের তৃতীয় তফসিলের ১৪৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতি-মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, প্রধান বিচারপতি, সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারী কর্ম কমিশনের সদস্যদের শপথ ও ঘোষণার নির্দিষ্ট ধরন সন্নিবেশিত আছে। অর্থাৎ সংবিধানে উল্লেখিত উক্ত ফরম্যাট অনুসারে সর্বোচ্চ পদসমূহের দায়িত্ব নেবার প্রাক্কালে সকলকেই নিজের আমিত্ব’র ঘোষণা দিয়েই উপরোক্ত পদের শপথ নিতে হয়।
রবীন্দ্রনাথের আমিত্বের মধ্যে একটি বিনয়ী ভাব আছে। রবীন্দ্রনাথের আমিত্বের প্রকাশ তাঁর কবিতায় এবং গানে কেমনভাবে এসেছে এখানে দু’একটি উদাহরণ তুলে ধরছি।
ক. আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার/চরণধুলোর তলে।
খ. বিপদে মোরে রক্ষা করো/এ নহে মোর প্রার্থনা/বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
গ. আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি।
রবীন্দ্রনাথের আমিত্বের মধ্যেই বিরাজ করছে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্ব। নিজের চিন্তা-ভাবনা, নিজের আবেগ-অনুভূতিকে অত্যন্ত শৈল্পিক উপায়ে বিশ্বের সকল মানুষের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরেছেন বলেই তিনি বিশ্বকবি। আমিত্বকে যাঁরা নেতিবাচক দৃষ্টিতে বিচার করতে আগ্রহী, আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মূল্যায়নে তাঁরা কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হবেন। গানটির শুরুই হয়েছে আমিত্ব দিয়ে, যেমন- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’
কবি নজরুল ইসলামের কবিতায় আমিত্বের প্রকাশ যেভাবে ঘটেছে সে দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নজরুলের শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে স্বীকৃত। বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল ইসলাম গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে উল্লেখ করেছেন-
ক. আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস/আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।
খ. আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন/আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।
গ. আমি চির বিদ্রোহী বীর/বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা- চির উন্নত শির।
নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় আমিত্ব চেতনার যে প্রকাশ ঘটেছে, তাকে নেতিবাচক বলে অভিহিত করার কোন সুযোগ নেই। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের কবি, নজরুলকে আমরা বলে থাকি জাতীয় কবি। তাঁদের যে সমস্ত কবিতায় আমিত্বের প্রকাশ ঘটেছে, সে কবিতাগুলোই কালজয়ী হয়ে উঠেছে।
আমাদের প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে অপার সম্ভাবনা।
আমিত্বকে ইতিবাচকভাবে জাগিয়ে তুলতে পারলে সকল নাগরিককে দিয়ে জাতীয়ভাবে বিস্ময়কর কিছু করা সম্ভব। যে ব্যক্তি নিজের সম্ভাবনার খোঁজ পায় না তাকে দিয়ে তার যেমন কোনো লাভ হয়না তেমনিভাবে সমাজ বা রাষ্ট্রী তেমন উপকার পায় না।
নিজেকে চেনা জানা যেমন প্রয়োজন তেমনি আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে নিজস্ব দর্শন চিন্তা-চেতনাকে মানবকল্যাণে, নাগরিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে নিবেদিত করা অতীব জরুরী।
এ ছাড়া যে এই শিক্ষার এই জীবনের কোন মূল্যই অবশিষ্ট থাকে না।