25/10/2025
টাইফয়েড ভ্যাকসিন নিয়ে দুই একটি সত্য এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা।
যেহেতু দেশের ৫ কোটি শিশুকে (৯ মাস থেকে ১৫ বছর) টাইফয়েডের গণটিকা দেয়া হচ্ছে সেহেতু বাচ্চাদের বাবা-মায়েদের এই টিকাটি সমন্ধে সঠিক তথ্য জানার অধিকার রয়েছে।
(১) দেশে যে টিকাটি দেয়া হচ্ছে তার নাম TyphiBEV ভ্যাকসিন। এটা টাইফয়েডের নতুন ধরণের একটা ভ্যাকসিন যা তৈরি করেছে ভারতের বায়োলজিক্যাল বি নামের একটি কোম্পানি। ধরনগত দিক দিয়ে এই টিকাটি একটি Vi-polysaccharide conjugate ভ্যাকসিন। সাধারণভাবে এই ধরনের ভ্যাকসিনকে TCV ভ্যাকসিন বা টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন বলে।
(২) টাইফয়েডের এইরকম আরেকটি TCV ভ্যাকসিন হল Typbar-TCV যেটা তৈরী করেছে ভারতের আরেকটি কোম্পানি ভারত বায়োটেক। এই ভ্যাকসিনটির সকল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে বড় পরিসরে এবং খুবই কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে (৮০-৮৫% প্রতিরক্ষা)। বাংলাদেশেও এই টিকাটির ডাবল-ব্লাইন্ড ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে ৬০,০০০ শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের উপর যেটার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আইসিডিডিআরবির ড. ফেরদৌসী কাদরী।
(৩) তবে বাংলাদেশে কোন বিশেষ কারণে Typbar-TCV টিকাটি না দিয়ে দেয়া হচ্ছে TyphiBEV টিকা তা বোধগম্য নয়।
(৪) TyphiBEV ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা কেমন হবে তা পরীক্ষার জন্য কোন ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়নি। সুতরাং এই ভ্যাকসিনটি টাইফয়েড প্রতিরোধে কতটুকু কার্যকর হবে তা নিশ্চিত ভাবে জানা নেই। এটা WHO এর ওয়েবসাইটেও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা রয়েছে যে এই ভ্যাকসিনটির কোন ক্লিনিক্যাল এফিকেসি ডেটা নেই।
(৫) Typbar-TCV এবং TyphiBEV এই দুটো ভ্যাকসিনই WHO এর প্রিকোয়ালিফাইড ভ্যাকসিনের স্ট্যটাস পেয়েছে। অর্থাৎ এই দুটো টিকাই জনসাধারণে প্রয়োগ করা যাবে। এখন প্রশ্ন হলো, ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল (ক্লিনিক্যাল এফিকেসি ট্রায়াল) ছাড়াই TyphiBEV ভ্যাকসিনটি কিভাবে জনসাধারণে প্রয়োগের অনুমোদন পেল?
(৬) সেইফটি এবং ইমিউনোজেনিসিটি (ইমিউন রেসপন্স) পরীক্ষার জন্য TyphiBEV ভ্যাকসিনটির উপর দুটি ফেইজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়েছে। এতে দেখা যায় এই ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি (এন্টি-ভাই-পলিস্যাকারাইড এন্টিবডি) তৈরি করতে পারে। এই অ্যান্টিবডির পরিমান Typbar-TCV ভ্যাকসিনে তৈরি হওয়া এন্টিবডির সমান। যেহেতু এই দুটি ভ্যাকসিন একই ধরনের এবং এরা একই পরিমান এন্টিবডি তৈরী করে (৪২ দিনের ফলোআপ) তাই ধরে নেয়া যায় যে এদের ক্লিনিক্যাল এফিকেসি বা কার্যকারিতাও একই রকম হবে। এফিকেসি ট্রায়াল রিপোর্ট ছাড়া এই পদ্ধতিতে ভ্যাকসিনের এপ্রোভাল দেয়াকে বলা হয় নন-ইনফেরিওরিটি অ্যাসেসমেন্ট বা ইমিউনোব্রিজিং পদ্ধতি। TyphiBEV ভ্যাকসিনের এপ্রোভাল এভাবেই দেয়া হয়েছে।
(৭) WHO রিপোর্ট অনুযায়ী TyphiBEV ভ্যাকসিনটিকে নিরাপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোথাও বলা হয়নি টাইফয়েড প্রতিরোধে এটা কতটুকু কার্যকর। কারণ একটাই, এভিডেন্সের অভাব। ‘পটেনশিয়াল কার্যকারিতা’ এবং ‘পরিলক্ষিত কার্যকারিতার’ মধ্যে ব্যপাক পার্থক্য রয়েছে। এখন পর্যন্ত যেটুকু ডেটা আছে তাতে বলা যায় TyphiBEV ভ্যাকসিনটি খুব সম্ভবত কার্যকর হবে (potentially effective based on statistical prediction)। বর্তমানে এই ভ্যাকসিনটির কমপক্ষে দুই-তিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। WHO এর পাবলিক এসেসমেন্ট রিপোর্টে (updated 18 December 2024) অনুযায়ী এই ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানিটিকে TyphiBEV এর এফিকেসি স্টাডি চালাতে হবে এবং এর রিপোর্ট জমা দিতে হবে। “The company is committed to conduct an effectiveness study” - WHO ডকুমেন্টে এই কথাটাই লেখা আছে।
(৮) যে ৫ কোটি শিশুকে TyphiBEV টিকা দেয়া হচ্ছে তাদের বাবা-মায়েদের এই টিকা সমন্ধে সঠিক তথ্যটি জানার অধিকার রয়েছে। এটাই এথিক্স। এই এথিক্স গ্লোবাল সাউথ এবং গ্লোবাল নর্থে একই হতে হবে। আসলে গ্লোবাল সাউথ/গ্লোবাল নর্থ এই টার্মিনোলজি এবং আইডিয়াটাই পরিহার করতে হবে। যে কোন ক্লিনিক্যাল ইন্টার্ভেনশনের ক্ষেত্রে নিন্ম আয়ের এবং উচ্চ আয়ের দেশে একই এথিক্স এবং নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। যেসব শিশুকে টাইফয়েডের টিকা দেয়া হচ্ছে তাদের বাবা-মাকে অবহিত করতে হবে যে এই টিকাটি নিরাপদ তবে এর কার্যকারিতা এখনও সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। এই তথ্যটি বৈজ্ঞানিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ কারণ কোন ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শরীরে এন্টিবডি তৈরি হলেই যে তা রোগ প্রতিরোধে কার্যকর হবে এমন কোন নিশ্চিয়তা নেই। এই কারনেই প্রতিটি ভ্যাকসিনের ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রয়োজন রয়েছে।
(৯) দুঃখজনক হলেও সত্য যে মেইনস্ট্রিম এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু কিছু চিকিৎসক এবং সাইনটিস্ট Typbar-TCV ভ্যাক্সিনের ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের রিপোর্ট দিয়ে TyphiBEV ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন! কারন তারা বলছেন এই দুটো ভ্যাকসিন একই। আসলেই কী তাই?
(১০) ধরনগত দিক দিয়ে এই দুটোই কনজুগেট ভ্যাকসিন বা TCV ভ্যাকসিন এটা ঠিক আছে। তবে এই দুটো ভ্যাকসিনের কম্পোজিশন ভিন্ন। এদের এন্টিজেনের সোর্স ভিন্ন এবং ক্যারিয়ার প্রোটিনও ভিন্ন। দুটো ভ্যাকসিন তৈরি দুটো ভিন্ন কোম্পানির।
(১১) TCV ভ্যাকসিনে দুটি প্রধান উপাদান থাকে। একটি হলো সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার ক্যাপসুলের Vi-polysaccharide সুগার মলিকিউল এবং একটি ক্যারিয়ার প্রোটিন। আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভ্যাকসিনের Vi-polysaccharide অংশটির উস্থিতিতে টাইফয়েডের জীবাণু সালমোনেলা সনাক্ত করে। আর ক্যারিয়ার প্রোটিন এই জীবাণুর বিরুদ্ধে শক্তিশালী ইমিউন রেসপন্স করতে সহায়তা করে। দুইয়ে মিলে তৈরি হয় টাইফয়েডের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধী ইমিউনিটি। যে TCV ভ্যাকসিনটির (Typbar-TCV) ব্যাপক পরিসরে সকল ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে তার Vi-polysaccharide অংশটি নেয়া হয়েছে Salmonella typhi ব্যাকটেরিয়া থেকে। আর এই Vi-polysaccharide কে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে টিটেনাস টক্সয়েড (TT) ক্যারিয়ার প্রোটিনের সাথে। অন্যদিকে যে ভ্যাকসিনটি বাংলাদেশে দেয়া হচ্ছে (TyphiBEV) তার Vi-polysaccharide অংশটি নেয়া হয়েছে Citrobacter freundii ব্যাকটেরিয়া থেকে যার সাথে টাইফয়েডর কোন সম্পর্ক নেই তবে এই ব্যাকটেরিয়ার কিছু কিছু স্ট্রেইন Vi-polysaccharide তৈরী করে। আর এই ভ্যাকসিনে Vi-polysaccharide কে যুক্ত করা হয়েছে ডিপথেরিয়া টক্সোয়েড বা CRM197 ক্যারিয়ার প্রোটিনের সাথে। এই দুই ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রাপ্ত Vi-polysaccharide এর গঠনগত সাদৃশ্য থাকলেও এদের মলিকিউলের O-acetylation প্রোসেসর কিছুটা বিসাদৃশ্য রয়েছে। Vi-polysaccharide এর O-acetylated অংশটিই মূলত শরীরে ইমিউন রেসপন্সের জন্য দায়ী।
(১২) যেহেতু এই দুটি ভ্যাকসিনের Vi-polysaccharide সোর্স ভিন্ন এবং Citrobacter এর পলিস্যাকারাইডের O-acetylation কিছুটা ভিন্ন হতে পারে তাই ভ্যাকসিনের কার্যকারীতাও ভিন্ন হতে পারে। এছাড়াও TT এবং CRM197 এর ইমিউন রেসপন্স ডায়নামিক্সও ভিন্ন। সুতরাং এই গঠনগত ভিন্নতার কারণে TypBar-TCV এবং TyphiBEV ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাও ভিন্ন হতে পারে। যারা স্বল্প জ্ঞানকে পূঁজি করে বলে বেড়াচ্ছেন যে এই দুটি ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা একই হবে তাদের উচিত TyphiBEV ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করা।
(১৩) আমার এই লেখাটির উদ্দেশ্য জনসাধারণের কাছে TyphiBEV ভ্যাকসিনটির কিছু সঠিক তথ্য তুলে ধরা যাতে তারা সঠিক তথ্যটি জেনে তাদের বাচ্চাদের টিকা দিতে পার।
(১৪) তবে আমার একটাই প্রশ্ন, যে ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল বাংলাদেশে হলো ৬০,০০০ মানুষের উপর, যার সকল ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হলো এবং যার কার্যকারিতা প্রমানিত হল ৮৫ শতাংশ, সেই ভ্যাকসিনটি না দিয়ে ৫ কোটি শিশু-কিশোরকে কেন এমন একটি ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে যার সবগুলো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনও শেষ হয়নি এবং যার কার্যকারিতার হার অজানা? টাইফয়েড তো বাংলাদেশে মহামারি বা হেল্থ ইমারজেন্সিও না যে তরিঘরি করে সবাইকে টিকা দিতে হবে! টিকা দিয়েই কী সব অসুখ নির্মূল করা যাবে? দেশে প্রায় ৫ হাজার শিশু প্রতিবছর টাইফয়েডে মারা যায়- এটা অবশ্যই দুঃখজনক। কিন্তু দেশে তো প্রতিবছর ২৪,০০০ শিশু মারা যায় নিউমোনিয়াতে। প্রায় ১০ বছর হল ইপিআইতে নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আজও দেশে শিশু (under-5) মৃত্যুর প্রধান কারন এই নিউমোনিয়াই।
ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম,
(এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি)
মলিকুলার সাইনটিস্ট,
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য
SBMC-27th