04/11/2025
কাউন্সিলিংয়ের কেস ষ্টাডি
বন্যা ২২ বছর বয়সি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। রাজধানী শহরে পরিবারের সাথেই তার বসবাস। নিজের সম্পর্কে বন্যার প্রথম কথা ছিল, "আমাকে আমার ভালো লাগে না। আমার কোনোকিছুই আমার ভালো লাগে না"।
বন্যা নিজেকে অপছন্দ করে কারণ তার ধারণা সে তার বোনের মতো সুন্দর, মেধাবী, বিনয়ী, ও পরিশ্রমী নয়। আর তার নিজের সম্পর্কে এই সব ধারণা বা সমালোচনা মূলত তার মায়ের মস্তিষ্ক থেকে তার মস্তিষ্কে স্থানান্তরিত হয়েছে।
চেহারা, মেধা, আচার-আচরণ সমস্ত বিষয়ে মা তাকে তার বড়ো বোনের সাথে তুলনা করে আসছে শুরু থেকেই। একবার অঙ্কে বন্যা ১০০-তে ৭৪ পেয়েছিল, এ প্লাস পায়নি বলে মা তাকে মারতে মারতে বাড়ির বাইরে বের করে দেয়। সেদিন অপরাধীর মতো সে দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
বন্যা খুব ভালো গান গায়, গান গাইতে তার ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু পরীক্ষায় মায়ের প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল করতে পারছিল না বলে মা তার সংগীতচর্চা বন্ধ করে দেয়। অবশ্য মা যে সবসময় মুখেই সবকিছু বলত তা নয়, আচার-আচরণের মাধ্যমেও বোঝা যেত যে পড়ালেখায় ভালো হলে এবং মায়ের মনের মতো আচরণ করলেই সে ভালোবাসার যোগ্য, তা না হলে নয়। আর এখন সে নিজেও তাই মনে করে। নিজেকে প্রতিনিয়তই তার অলস, অকর্মণ্য, অযোগ্য ও মূল্যহীন মনে হয়।
এদিকে তার ক্লাসের একটি ছেলেকে তার খুব ভালো লাগে। বিষয়টি জানার পর ছেলেটি কিছুদিন খুব আগ্রহ দেখায়, তারপর কেমন যেন বদলে যেতে থাকে এবং একসময় কথা বলা বন্ধ করে দেয়। নিজেকে বন্যার অপরাধী মনে হতে থাকে যে কেন সে তার পছন্দের ব্যাপারটি ছেলেটিকে জানালো। ছেলেটির আচরণে তার কখনো রাগ হয়, কখনও কষ্ট হয় আবার কখনো লজ্জা ও অনুতাপ হয়। পরীক্ষার রেজাল্টও ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করে বন্যার। সবকিছু মিলিয়ে নিজের সম্পর্কে তার ধারণা আরো খারাপ হতে থাকে। এখন মাঝে মাঝেই তার মরে যেতে ইচ্ছে করে।
উপরের কেসটিতে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে এবং গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে মূল অংশ ঠিক রেখে কিছু অংশ পরিবর্তন করা হয়েছে। কীভাবে কাউন্সেলর কাউন্সেলিং-প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করে বন্যাকে সহায়তা দিয়েছিল তা আলোচনা করা হলো।
বন্যার উত্থাপিত বিষয়গুলো ছিল (তার ভাষায়)-
★ মন খারাপ লাগা, সারাক্ষণ কান্না পাওয়া, অল্পতে রেগে যাওয়া, বিরক্ত হওয়া এবং অপরাধবোধে ভোগা।
★ নিজের কোনোকিছুই ভালো না লাগা, নিজের প্রতি ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা।
★ নিজেকে ছোটো মনে হওয়া, আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি।
★ কোনো কাজে মনোযোগ দিতে অসুবিধা।
★ পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল।
★ বন্ধুত্ব বা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি ও রক্ষা করতে অসুবিধা।
★ সারাক্ষণ ক্লান্তি লাগা।
★ ঘুমের সমস্যা।
★ নিজেকে ব্যর্থ ও অথর্ব মনে করা।
★ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা ।
★ মায়ের প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃণা।
★ মরে গেলেই ভালো এমন চিন্তাধারা
বন্যার মধ্যে উপরের এই সমস্যা বা উপসর্গগুলো গত ছয় মাসে তীব্র আকার ধারণ করেছে। তবে প্রথম ১২ বছর বয়সে, যখন তার মা পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার জন্য মারতে মারতে তাকে ঘরের বাইরে বের করে দিয়েছিল, সেসময়েও এই একই ধরনের উপসর্গ নিজের ভেতরে খেয়াল করেছিল সে। সেসময় ক্লান্তি ও শারীরিক কিছু উপসর্গের কারণে তার বাবা তাকে চিকিৎসকের (জেনারেল ফিজিশিয়ান) কাছে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কোনো সচেতনতা বা চিকিৎসার পরিকল্পনা ছিল না। আজকাল এই উপসর্গগুলো অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বর্তমানে তার কিছু করতে ভালো লাগে না, কারো সাথে মিশতেও ভালো লাগে না। পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হচ্ছে এবং ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখায় এক বছরের বিরতি ও বিলম্ব হয়ে গেছে।
বন্যারা দুই বোন, বাবা একজন চাকরিজীবী এবং মা গৃহিণী। বন্যা বাবা-মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান। পরিবারের কারোর সাথেই তার বন্ধন নিরাপদ নয়, এবং কারোর প্রতি সে তেমন আবেগীয় টান অনুভব করে না। তবে সে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে মাকে। শৈশব-কৈশোরে বাবার সাথে তার খুব আনন্দ বা সুখের স্মৃতি না-থাকলেও ভয়াবহ কোনো স্মৃতিও নেই। বাবা বাবার মতো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তবে মায়ের সাথে তার অধিকাংশ স্মৃতিই ভয়াবহ কষ্টের। সামান্য ভুলেই মা তাকে শারীরিকভাবে শান্তি দিতেন, অনেক বকাঝকা করতেন এবং অনবরত অন্যদের সাথে তুলনা করতেন। বাবা এবং মায়ের মধ্যেও সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয়। বাবা নিজের মতো বাইরে বাইরে থাকতেন আর মা এসব নিয়ে প্রায়ই বাবার সাথে ঝগড়াঝাঁটি করতেন। বোনের পরীক্ষার ফলাফলে মা মোটামুটি সন্তুষ্ট থাকলেও এবং বোন বন্যার চেয়ে কম শাস্তি পেলেও বন্যার আজকাল মনে হয় তার বোনও শিশু হিসেবে সুখী ছিল না। এবং তার বোন সমাজে মেধাবী ও সফল হিসেবে নাম কুড়ালেও বোনের কিছু আচরণ দেখে বন্যার মনে হয় তার বোনেরও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো নয়।
বন্যা কাউন্সেলরের শরণাপন্ন হয়েছে একটা সুপ্ত আশা নিয়ে, যদি তার কষ্টগুলো থেকে মুক্তি মেলে, যদি সে কাউন্সেলিংসেবা গ্রহণের মাধ্যমে নিজের অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটাতে পারে।
গভীর অন্বেষণের এই ধাপে কাউন্সেলর সমানুভূতি দিয়ে বন্যাকে শুনেছিল এবং সেশন শেষে আবেগীয়ভাবে স্থির ও প্রশান্ত হতে রিল্যাক্সেশন চর্চা করিয়েছিল। সেশন শেষে বন্যা জানিয়েছিল নিজের কথাগুলো কাউন্সেলরকে মন খুলে বলতে পেরে সে অনেকখানি হালকা বোধ করছে এবং সেই সাথে কাউন্সেলিংয়ের ব্যাপারে সে আশাবাদী। গভীর অন্বেষণের এই ধাপে বন্যার জন্য দুটি কাউন্সেলিং সেশন প্রয়োজন হয়েছিল।
কাউন্সেলিং থেকে বন্যার প্রত্যাশা কী বা সে কী ধরনের পরিবর্তন চায় এমন প্রশ্নের উত্তরে বন্যা বলেছিল আমি তীব্র মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি চাই, আমি একটা স্বাভাবিক জীবনযাপন চাই যেখানে আমি আমার কাজগুলো স্বাভাবিকভাবে করতে পারবো এবং আনন্দের ঘটনায় আনন্দ করতে পারবো। এই বিষয়ে আরো খানিকক্ষণ আলোচনার পর কাউন্সেলর এবং বন্যা সম্মিলিতভাবে কাউন্সেলিংয়ের নিম্নলিখিত লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করে।
★ আবেগীয় নিরাময় বা অতীতের কষ্টগুলো থেকে মুক্তি
★ দৈনন্দিন কাজে মনোযোগ বৃদ্ধি
★ ঘুমের সমস্যা মোকাবিলা
★ রাগ ও অন্যান্য কঠিন আবেগ সামলাতে দক্ষতা অর্জন
★ যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি
★ সম্পর্ক তৈরি ও পরিচালনার দক্ষতা বৃদ্ধি
★ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি
★ মায়ের সাথে বিষাক্ত সম্পর্কের সমাপ্তি/ মায়ের সাথে দ্বন্দ্ব নিরসন
★সামাজিক দক্ষতা ও সীমারেখা নির্ধারণের দক্ষতা বৃদ্ধি
★ নিজেকে জানা, নিজের অনুভূতি, চাহিদা, ও আচরণের দায়িত্ব নিতে পারা।
কাউন্সেলিং ইন্টারভেনশন
🟢 আবেগীয় নিরাময় বা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে:
★ ক্লায়েন্ট-কাউন্সেলরের নিরাপদ বন্ধন, সাথে থাকা, সমানুভূতি ও আবেগীয় সহায়তা
★ রিল্যাকজেশন বা শিথিলায়ন চর্চা
★ মনোযোগিতার চর্চা (নিজের শরীর ও মনের ভেতরে কী ঘটছে সে ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি)
★ প্রাকৃতিকভাবে মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী কেমিকেলগুলোর ভারসাম্য আনতে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কিছু প্রশিক্ষণ ও সুপারিশ যেমন, রোদ পোহানো, শরীর চর্চা, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর ঘুমের নিয়মকানুন, সুষম খাদ্যাভ্যাস গঠন ইত্যাদি ব্যাপারে চর্চা এবং সুপারিশ।
★ আত্মমমতার চর্চা নিজের জগতে প্রবেশ, নিজের বিভিন্ন সত্তাগুলোকে চেনা, নিজের সাথে সংলাপ, নিজের অনুভূতি ও চাহিদাকে শনাক্ত করা (মূলত অতীতের কষ্টকর ও অমীমাংসিত বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে)
★ চেয়ার টেকনিক: নিজের এবং আরেকজনের (যার সাথে সংঘাত) সাথে কাল্পনিক সংলাপ ও আবেগ প্রকাশ
★ রাগ, লজ্জা, ও অপরাধবোধসহ কঠিন আবেগগুলোকে বোঝা ও মোকাবিলা করা
★ ক্ষমার চর্চা
★ কৃতজ্ঞতার চর্চা
★ আত্মত্মবিশ্লেষণ ও আত্মমতার জন্য ডায়েরি লেখা (বাড়ির কাজ)
🟢 আচরণগত ক্ষেত্রে:
★ আন্তরিক যোগাযোগের প্রশিক্ষণ (সমানুভূতির দক্ষতা, আত্মপ্রকাশের দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা)
🟢 চিন্তা-ভাবনা ও মানসিকতার ক্ষেত্রে:
★ নিজের সম্পর্কে সমালোচনা ও ক্ষতিকর ভাবনাগুলোকে শনাক্ত করা (বন্যার ক্ষেত্রে: আমি অযোগ্য, আমি পারদর্শী নই, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না, আমি একজন ব্যর্থ মানুষ, ভালো কিছু আমার প্রাপ্য নয়, আমি অনিরাপদ ইত্যাদি) এবং সেগুলোকে সহায়তামূলক ভাবনায় রূপান্তর
★ জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ক্ষতিকর ভাবনা ও বিশ্বাসগুলোকে শনাক্ত করা এবং সেগুলোকে সহায়তামূলক ভাবনায় রূপান্তর।
🟢 আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে:
★ যোগাযোগের দক্ষতা চর্চা, নিয়মিত মহরা এবং ফিডব্যাক
★ সম্পর্কে সীমারেখার চর্চা, নিয়মিত মহরা এবং ফিডব্যাক
★ সামাজিক দক্ষতার চর্চা, মহরা এবং ফিডব্যাক
★ পারিবারিক সহায়তা বৃদ্ধি ও পরিবারের সদস্যাদের মধ্যে সংঘাত নিরসনের লক্ষ্যে মেডিয়েশন সেশন।
এই ধাপে বন্যার মোট ১৪টি সেশন প্রয়োজন হয়েছিল।
কাউন্সেলিং ইন্টারভেনশন ধাপের শুরু থেকেই বন্যা আবেগীয়ভাবে পূর্বের তুলনায় আরাম বোধ করতে শুরু করে। তার বিষণ্ণতার উপসর্গগুলো, যেমন, প্রচণ্ড মন খারাপ ভাব, মনোযোগ দিতে সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, ক্লান্তি ও শক্তিহীনতা কমতে শুরু করে এবং দৈনন্দিন কাজগুলো নিজের প্রত্যাশা অনুযায়ী সে সম্পন্ন করতে শুরু করে। সে নিজের যত্ন নিতে শুরু করে এবং শেষের দিকে সে কাউন্সেলরকে জানায়, নিজের সম্পর্কে সে এখন ভালো বোধ করে। আগের চেয়ে তার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে সে জানায়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজের আবেগ সামলে নিয়ে সমস্যা সমাধানেও সে আগের চেয়ে দক্ষ হয়ে ওঠে এবং সম্পর্কগুলো পরিচালনায় অনেকটাই পারদর্শী হয়ে ওঠে। বেশ কিছু বিশ্বস্ত বন্ধু তৈরি হয়েছে তার। মাকে সে ক্ষমা করতে পেরেছে। পরিবারের সদস্যদের সাথে সে যথাযথ সীমারেখা নির্ধারণের মাধ্যমে আগের চেয়ে শান্তিতে আছে।
১৬তম সেশনে এসে কাউন্সেলর এবং বন্যা কাউন্সেলিং-প্রক্রিয়ার সমাপ্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তী কালে ১ মাসের ব্যবধানে সে আরো দুটি সেশন নেয় এবং নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কাউন্সেলরকে তথ্য ও ফিডব্যাক দেয়। ১৮ তম সেশনে এসে কাউন্সেলিংয়ের সমাপ্তি হয়। পরবর্তী কালে কোনো কারণে কাউন্সেলিং সেশন প্রয়োজন হলে কাউন্সেলরের সেবার দরজা তার জন্য উন্মুক্ত এমন অঙ্গীকার ব্যক্ত করে কাউন্সেলর তাকে বিদায় জানায়।
-
মো: ফাইজুল হক
সরকারি রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত হোমিওপ্যাথিক, ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ডাক্তার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে সাইকোথেরাপিউটিক কাউন্সিলিং এবং কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি ফর ডিপ্রেশনের উপরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ।
আমেরিকার ওয়েস্টার্ন স্টেট ইউনিভার্সিটি , ক্যালিফোর্নিয়া তে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন অ্যাপ্লাইড সাইকোলজিতে অধ্যায়নরত ।
⚠ সতর্কতা: কিছু প্রতারক আমার ছবি-ভিডিও ব্যবহার করে প্রতারণা করছে!
✅ আমাদের মোবাইল নাম্বার:
01972-859950,
01712-859950
এই নাম্বার ছাড়া আমাদের কোন নাম্বার নাই। সতর্ক থাকবেন, সাবধান থাকবেন।