13/06/2025
চলুন, আজ স্ট্রোক সম্পর্কে কিছু জরুরি তথ্য জেনে নিই, যা আপনাকে এবং আপনার প্রিয়জনদের সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।
১. স্ট্রোক কী?
সহজ কথায়, স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহে আকস্মিক ব্যাঘাত। আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত রক্ত থেকে অক্সিজেন ও পুষ্টি গ্রহণ করে কাজ করে।যখন এই রক্ত প্রবাহে কোনো কারণে বাধা পড়ে,তখন মস্তিষ্কের কোষগুলো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাবে মরতে শুরু করে। এর ফলে মস্তিষ্কের যে অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই অংশের নিয়ন্ত্রণাধীন শরীরের কার্যক্ষমতা (যেমন – কথা বলা, নড়াচড়া করা, চিন্তা করা) হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়।
* ইস্কিমিক স্ট্রোক:-প্রায় ৮৭% স্ট্রোক এই ধরনের হয়। মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
* হেমোরেজিক স্ট্রোক:-রক্তনালী ফেটে গিয়ে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ হয়। এটি কম হলেও, বেশি মারাত্মক হতে পারে।
২. কেন হয় এই নীরব ঘাতক?🩸
স্ট্রোকের পেছনে কিছু নিয়ন্ত্রনযোগ্য এবং কিছু অনিয়ন্ত্রনযোগ্য কারণ থাকে। তবে বেশিরভাগই প্রতিরোধযোগ্য:
* উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure):- স্ট্রোকের এক নম্বর কারণ।
* ডায়াবেটিস (Diabetes):- রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
* উচ্চ কোলেস্টেরল (High Cholesterol):- রক্তনালীতে চর্বি জমিয়ে দেয়।
* ধূমপান ও মদ্যপান:- রক্তনালীকে সংকীর্ণ ও শক্ত করে তোলে।
* স্থূলতা (Obesity):-অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
* হৃদরোগ (Heart Disease):-বিশেষ করে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (Atrial Fibrillation) রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ায়।
* শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন:- অপর্যাপ্ত ব্যায়াম ও ফাস্ট ফুড।
* পারিবারিক ইতিহাস:- বংশগত প্রভাব থাকতে পারে।
৩. কীভাবে বুঝবেন স্ট্রোক হয়েছে? (F.A.S.T. পদ্ধতি) ⏰
এই পদ্ধতিটি স্ট্রোকের লক্ষণ দ্রুত চেনার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত:-
* F – Face Drooping (মুখ বাঁকা):- রোগীকে হাসতে বলুন। মুখের এক পাশ ঝুলে যাচ্ছে বা বাঁকা হয়ে যাচ্ছে কি না খেয়াল করুন।
* A – Arm Weakness (হাত দুর্বল):- রোগীকে একসাথে দু'হাত উপরে তুলতে বলুন। একটি হাত নিচে নেমে যাচ্ছে বা তুলতে পারছে না কি না দেখুন।
* S – Speech Difficulty (কথা জড়ানো):- রোগীকে সহজ কোনো বাক্য বলতে বলুন। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, অস্পষ্ট লাগছে বা বলতে পারছে না কি না শুনুন।
* T – Time to call emergency (সময় নষ্ট না করে জরুরি বিভাগে যোগাযোগ):- উপরের লক্ষণগুলোর যেকোনো একটি দেখা গেলে তাৎক্ষণিকভাবে দেরি না করে ৯৯৯ এ কল করুন বা রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রতিটা মিনিট এখানে মূল্যবান!
৪. রোগ নির্ণয় (Diagnosis) 🔬
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ডাক্তাররা দ্রুত কিছু পরীক্ষা করেন:
* শারীরিক পরীক্ষা:- রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ।
* সিটি স্ক্যান (CT Scan) বা এমআরআই (MRI):- মস্তিষ্কের ভেতরের ছবি দেখে স্ট্রোকের ধরন (ইস্কিমিক নাকি হেমোরেজিক) এবং ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। এটি চিকিৎসার ধরন নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
* রক্ত পরীক্ষা ও অন্যান্য পরীক্ষা:- রক্তে সুগার, কোলেস্টেরল, রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা ইত্যাদি যাচাই করা হয়।
৫. মেডিকেল ম্যানেজমেন্ট ও চিকিৎসা পদ্ধতি 💊
হাসপাতালে স্ট্রোক নিশ্চিত হওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসা শুরু হয়। এর মধ্যে রয়েছে:-
* প্রাথমিক জরুরি চিকিৎসা:- রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস, অক্সিজেনের মাত্রা স্থিতিশীল রাখা।
* ঔষধ প্রয়োগ:- ইস্কিমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধা রোধকারী ঔষধ (যেমন টিপিএ - tPA) নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেওয়া হয়। হেমোরেজিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও রক্তক্ষরণ বন্ধের চেষ্টা করা হয়।
* প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার:- রক্ত জমাট অপসারণ বা রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য কিছু ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
৬. স্ট্রোক পরবর্তী ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা:-🚶♀️
একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, স্ট্রোকের পর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্কের ক্ষতি হলেও, এর কিছু অংশ পুনরায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। একে আমরা 'নিউরোপ্লাস্টিসিটি' বলি। ফিজিওথেরাপি এই প্রক্রিয়ায় সহায়ক হয়।
লক্ষ্য:- রোগীর হারানো ক্ষমতাগুলো ফিরিয়ে আনা, দৈনন্দিন কাজ করার স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।
চিকিৎসা পদ্ধতি:-
* পেশী শক্তি বৃদ্ধি ও টোন নিয়ন্ত্রণ:- স্ট্রোকের কারণে দুর্বল বা শক্ত হয়ে যাওয়া পেশীগুলোর জন্য বিশেষ ব্যায়াম।
* ভারসাম্য ও সমন্বয় ফিরিয়ে আনা:- হাঁটাচলা ও অন্যান্য কাজে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করা।
* হাঁটাচলার ক্ষমতা বৃদ্ধি:- রোগীর অবস্থা অনুযায়ী সাহায্য নিয়ে বা স্বাধীনভাবে হাঁটার প্রশিক্ষণ।
* দৈনন্দিন কাজের দক্ষতা অর্জন:- খাওয়া, পোশাক পরা, ব্যক্তিগত পরিচর্যার মতো সাধারণ কাজগুলো করতে সহায়তা।
* ব্যথা ব্যবস্থাপনা:- স্ট্রোক পরবর্তী ব্যথা কমাতে সাহায্য।
* স্পিচ থেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি:- কথার জড়তা কাটানো এবং দৈনন্দিন কাজের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী সরঞ্জাম ব্যবহারে সহায়তা (অন্যান্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে সমন্বয় করে)।
মনে রাখবেন:- স্ট্রোকের প্রথম দিন থেকেই (রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল হলে) ফিজিওথেরাপি শুরু করা গেলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়। এটি রোগীর মনোবল চাঙ্গা রাখতেও সহায়ক হয়।
৭. স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় (প্রতিরোধ) 🌱
প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা। আপনার জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন এনে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো সম্ভব:-
* নিয়মিত রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করুন।
* ধূমপান ও মদ্যপান চিরতরে পরিহার করুন।
* নিয়মিত ব্যায়াম করুন:- প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম।
* সুষম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন:- ফল, শাক-সবজি, ফাইবারযুক্ত খাবার বেশি খান। তেল, চর্বি ও অতিরিক্ত লবণ পরিহার করুন।
* স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন।
* মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন।
* নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান:- বিশেষ করে ৪০ বছর বয়সের পর বছরে অন্তত একবার ফুল বডি চেকআপ।
স্ট্রোক একটি মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও সঠিক তথ্য, দ্রুত পদক্ষেপ এবং নিবিড় পুনর্বাসন এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারে। সচেতন হোন, সতর্ক থাকুন এবং আপনার আশেপাশের মানুষগুলোকে সচেতন করুন। আপনার সুস্থতা আপনার হাতে।
কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানাতে পারেন। স্বাস্থ্যকর জীবন কামনা করছি!