12/10/2025
মহিলাদেরকে কেন জিন বেশি প্রভাবিত করে সেটা নিয়ে অনেকেই জানতে চান।
ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, জিন আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে জিনও মানুষের মতোই বুদ্ধিসম্পন্ন এক সৃষ্টি, যারা ভালো কাজও করতে পারে, আবার খারাপ পথেও যেতে পারে। কিন্তু কেন যেন অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মহিলাদের মধ্যে জিনের প্রভাব বা “possession” তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। এর পেছনে কিছু মনস্তাত্ত্বিক, শারীরিক ও আধ্যাত্মিক কারণ রয়েছে।
১. আবেগপ্রবণতা ও সংবেদনশীলতা:
মহিলারা স্বভাবতই আবেগে কোমল ও সংবেদনশীল। তারা দ্রুত ভয় পায়, কষ্ট পেলে সহজে ভেঙে পড়ে, আবার অনেক সময় নিজের মনের দুঃখ প্রকাশ না করে অন্তরে জমিয়ে রাখে। এই মানসিক দুর্বলতা বা আবেগপ্রবণ অবস্থা আধ্যাত্মিকভাবে তাদের দুর্বল করে তোলে, যা শয়তান বা অশরীরী জিনদের প্রভাব বিস্তারের জন্য সুযোগ তৈরি করে।
২. নির্জনতা ও মানসিক চাপ:
বাড়িতে একা থাকা, রাতে নির্জন স্থানে থাকা বা একাকিত্বে অতিরিক্ত চিন্তায় ডুবে থাকা অনেক সময় মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতেও জিনের প্রভাব সহজে পড়তে পারে, বিশেষত যদি মানুষ আল্লাহর স্মরণে অন্যমনস্ক থাকে।
৩. হিজাব ও শরিয়ত অনুসরণে অবহেলা:
ইসলামি দৃষ্টিতে হিজাব ও পর্দা শুধু সামাজিক রীতিই নয়, এটি একধরনের আত্মরক্ষা। কিছু হাদীসে উল্লেখ আছে, নারীরা যদি পোশাকে, আচরণে বা চলাফেরায় শালীনতা বজায় না রাখে, তবে তারা শয়তানের প্ররোচনার প্রতি বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। ফলে আত্মিক সুরক্ষা দুর্বল হলে জিনের প্রভাবও সহজে প্রবেশ করতে পারে।
৪. ঈমান ও জিকিরে দুর্বলতা:
যে নারী নিয়মিত নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ও জিকিরে অবিচল থাকেন, তিনি আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী থাকেন। কিন্তু যখন এসব থেকে দূরে সরে যান, তখন তার রুহানিয় শক্তি কমে যায়, এবং জিনের প্রভাবের সম্ভাবনা বাড়ে।
৫. শারীরিক পরিবর্তনের সময় (যেমন ঋতুকাল, গর্ভাবস্থা ইত্যাদি):
এই সময়ে নারীর শরীরে হরমোন পরিবর্তনের কারণে মানসিক ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা যায়। ইসলামি চিকিৎসাবিদরা বলেন, দুর্বল অবস্থায় জিনের প্রভাব দ্রুত হয়, কারণ তখন আত্মরক্ষার শক্তি কম থাকে।
আত্মরক্ষার কিছু উপায় যদি মেনে চলা যায় তবে আল্লাহ নিরাপত্তা অবশ্যই দিবেন।
১. নিয়মিত নামাজ ও কুরআন তিলাওয়াত করা।
২. প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যার মাসনূন দোয়া ও আয়াতুল কুরসি পাঠ করা।
৩. হিজাব ও পর্দা মেনে চলা।
৪. ঘুমানোর আগে সূরা আল-ইখলাস, আল-ফালাক ও আন-নাস পাঠ করা।
৫. অশুভ স্থানে একা থাকা থেকে বিরত থাকা।
জিনের প্রভাব কেবল নারীদের নয়, পুরুষদের উপরও হতে পারে। তবে নারীরা যেহেতু মানসিক ও আবেগিকভাবে বেশি সংবেদনশীল, তাই তাদের মধ্যে এই প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। আল্লাহর জিকির, নামাজ ও আত্মিক সংযমই হলো সর্বোত্তম প্রতিরক্ষা।
একটা ঘটনা শেয়ার করি।
একদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে আমার এক বান্ধবীর কল এল এবং আমি রিসিভ করি সাথে সাথে। আমি ড্রাইভ করছিলাম বলে, ফোনটা দ্রুতই রেখে দিতে চাইছিলাম কিন্তু কণ্ঠে ক্লান্তি, আর অস্থিরতা বুঝে, না রেখে কথা চালিয়ে গেলাম। হঠাৎ আমার বান্ধবী আমাকে বলল, “মুশাররাত, আমি বুঝতে পারি না রে… আমি নামাজ পড়ি, কুরআন তিলাওয়াত করি, দোয়াও করি, তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় কেউ আমাকে বিরক্ত করছে, অদৃশ্যভাবে টেনে নিচ্ছে, যেন জিন বা শয়তান আমাকে ঘিরে ফেলছে।”
আমি মন দিয়ে শুনলাম। বান্ধবী আবার বলল,
আর দেখো, যারা আমল করে না, নামাজ পড়ে না, পর্দাও মানে না, তারা তো দিব্যি মজা করছে! ওদের কোনো জিন-শয়তানের সমস্যা হয় না কেন?
আমি হেসে নরম গলায় বললাম; জানিস, এর উত্তরটা একেবারে সহজ কিন্তু গভীর। এটা সত্যি, অনেক সময় এমনও হয় যে যারা নিয়মিত নামাজ পড়ে, আমল করে, তারা-ই বেশি জ্বিন বা শয়তানের কুমন্ত্রণা, দুঃস্বপ্ন, অস্বস্তি বা নানা ধরণের মানসিক আক্রমণের শিকার হয়। এটা আসলে একধরনের পরীক্ষা (পরীক্ষা বা ইমতিহান)। শয়তানের যুদ্ধ তো তাদের সাথে নয়, যারা তারই দলে আছে! যারা ইতিমধ্যেই গাফিল, তাদের নিয়ে ওর চিন্তা কম; ওরা তো শয়তানের কথাতেই চলে, তাই শয়তানের আর বাড়তি কষ্ট করার দরকার হয় না। বরং, শয়তান লড়াই করে তাদের সঙ্গে, যারা আল্লাহর পথে আছে, ইবাদতে সচেতন, তারাই শয়তানের আসল টার্গেট। কারণ, সে চায় না যেন কোনো বান্দা আল্লাহর স্মরণে অটল থাকে।
একটু থেমে আমি আবার বললাম, তুই নামাজ পড়িস, আমল করিস, এইজন্যই তো তুই তার নজরে! এটা আসলে পরীক্ষা, ভয় না; এটা প্রমাণ যে আল্লাহ তোকে ভালোবাসেন, তাই তোর ঈমানকে আরও মজবুত করতে চান। তাই তো আল্লাহ বলেছেন:
‘নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু; তাকে শত্রুই গণ্য করো।’ (সূরা ফাতির, ৩৫:৬)”
অর্থাৎ, শয়তান কখনো চায় না যেন নামাজি বা আল্লাহভীরু মানুষ দৃঢ় থাকে। তাই আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর সে বেশি আক্রমণ করে, কখনো চিন্তা, দুঃস্বপ্ন, মানসিক ভয়, বা এমনকি জিনের মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে।
অন্যদিকে, যারা আল্লাহকে ভুলে আছে, পাপাচারে নিমগ্ন, তাদের দিকে শয়তান অনেক সময় “শান্ত” থাকে, কারণ তারা তো ইতিমধ্যেই তার পথে হাঁটছে।
তবে এটাও মনে রাখা দরকার, সবকিছু জিন বা শয়তানের প্রভাব নয়; কখনো কখনো মানসিক বা শারীরিক কারণে এমন অনুভূতিও হতে পারে। তাই নিজের আমল, দোয়া, জিকির বজায় রেখে, চিকিৎসার দিকটাও দেখা জরুরি।
বান্ধবী আমার চুপ করে শুনছিল। চোখের কোণে যেন একটু পানি জমল, কিন্তু মনে হচ্ছিল মুখে একটুখানি শান্তির হাসিও ফুটে উঠেছে। আর বলল, তুই ঠিকই বলেছিস মুশাররাত, আমি ভয় না পেয়ে, বরং আরও বেশি করে আল্লাহর দিকে ফিরব। আমি বললাম, ঠিক তাই। মনে রাখিস, যে আল্লাহর পথে চলে, তাকেই শয়তান বেশি বাধা দেয়। কারণ, শয়তান কখনো তার পুরনো বন্ধুরে বিরক্ত করে না, সে কষ্ট দেয় তাদেরকেই, যারা আল্লাহর দিকে ফিরে যাচ্ছে। তারপর কথা শেষ করে ফোন কেটে দিলাম।
আসলে, যদি কোনো মুমিন মানুষ কখনো অজানা ভয়, অস্থিরতা বা বিভ্রান্তিতে পড়ে, মনে রাখতে হবে, এটি হয়তো একধরনের পরীক্ষা। ভয় না পেয়ে আল্লাহর স্মরণে দৃঢ় হতে হবে। কারণ আল্লাহর জিকিরেই সব শান্তি।
“নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।” — (সূরা রা‘দ, ১৩:২৮)
Jabin