22/10/2025
বন্ধ্যাত্ব কোনো অভিশাপ নয়, এটি চিকিৎসাযোগ্য শারীরিক সমস্যা
বন্ধ্যাত্ব (Infertility) কোনো অভিশাপ নয়— এটি একটি চিকিৎসাযোগ্য শারীরিক সমস্যা। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্ধ্যাত্ব শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও গভীর প্রভাব ফেলে। এর কারণে দাম্পত্য সম্পর্ক ও পারিবারিক জীবনে চাপ সৃষ্টি হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বন্ধ্যাত্ব নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হতে পারে। কিন্তু সমাজে একে প্রায়ই কেবল নারীর সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, যা একটি ভুল ধারণা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পরিচালিত এক বহুজাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৭ শতাংশ দম্পতির ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের কারণ নারী, ৩৫ শতাংশ দম্পতির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়ের কারণ দায়ী, এবং ৮ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরুষজনিত বন্ধ্যাত্ব (Male factor infertility) পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, যদি কোনো নারী ৩৫ বছরের কম বয়সী হন এবং ১২ মাস ধরে নিয়মিত অসুরক্ষিত যৌনসম্পর্কের পরও গর্ভধারণ না হয়, তবে বন্ধ্যাত্ব সমস্যার চিকিৎসা শুরু করা উচিত। আর যদি নারীর বয়স ৩৫ বছরের বেশি হয়, তাহলে এই সময়সীমা হবে মাত্র ৬ মাস।
গবেষকরা বলছেন, আধুনিক জীবনযাপন, সংক্রমণ, ও হরমোনজনিত অসামঞ্জস্যের কারণে বিশ্বজুড়ে নারীর প্রজননক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু প্রধান কারণ হলো—
🔹হরমোনজনিত অসামঞ্জস্য
নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য হরমোনের সঠিক ভারসাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ভারসাম্য নষ্ট হলে ডিম্বাশয় থেকে নিয়মিতভাবে ডিম্বাণু নিঃসরণ (ovulation) ব্যাহত হয়, ফলে গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দেয়। এই অবস্থাকে সাধারণভাবে হরমোনজনিত অসামঞ্জস্য (Hormonal Imbalance) বলা হয়, যার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS)।
PCOS-এ ডিম্বাশয়ে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয় এবং পুরুষ হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে মাসিক অনিয়মিত হয়, ওজন বাড়ে, ত্বকে ব্রণ ও অতিরিক্ত লোম গজায়— পাশাপাশি গর্ভধারণের সম্ভাবনাও কমে যায়।
এ ছাড়া থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা,
হাইপারপ্রোল্যাকটিনেমিয়া (Prolactin হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ), ও মানসিক চাপজনিত হরমোন পরিবর্তনও নারীর ডিম্বস্ফোটন ব্যাহত করে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করতে পারে।
🔹 এন্ডোমেট্রিওসিস
বিশ্বজুড়ে প্রজননক্ষম বয়সী নারীদের ১০–১৫ শতাংশ এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত। এই অবস্থায় জরায়ুর আস্তরণের টিস্যু জরায়ুর বাইরে বেড়ে ওঠে, ফলে প্রদাহ, ব্যথা ও বন্ধ্যাত্বের সমস্যা দেখা দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত নারীদের প্রায় ৪০–৫০ শতাংশ গর্ভধারণে ব্যর্থ হন। American Society of Reproductive Medicine (ASRM) অনুযায়ী, রোগটি চারটি পর্যায়ে বিভক্ত— ন্যূনতম, হালকা, মাঝারি ও গুরুতর।
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রদাহ ও হরমোনের ভারসাম্যহীনতা প্রজননক্রিয়ায় বাধা দেয়, আর গুরুতর পর্যায়ে পেলভিক বিকৃতি ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর গতিকে ব্যাহত করে।
🔹 সংক্রমণ ও টিউবাল অ্যাডহিশন
পেলভিক বা টিউবাল অ্যাডহিশন নারীর বন্ধ্যাত্বের অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, Pelvic Inflammatory Disease (PID) এই সমস্যার বড় উৎস, যার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জীবাণু Chlamydia trachomatis (ক্ল্যামিডিয়া ট্র্যাকোমাটিস )। ক্ল্যামিডিয়া ট্র্যাকোমাটিস হলো একটি ছোট ব্যাকটেরিয়া যা যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, একবার PID হলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা ৮৯%, দুইবারে ৭৭% এবং তিনবারে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৪৬%-এ। অর্থাৎ সংক্রমণ যতবার বাড়ে, গর্ভধারণের সম্ভাবনা তত কমে যায়।
🔹 হাইড্রোসালপিংক্স
ফলোপিয়ান টিউবের প্রদাহজনিত ক্ষত থেকে তৈরি হয় Hydrosalpinx, যেখানে তরল জমে টিউবের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে টক্সিন জরায়ুতে ফিরে এসে ভ্রূণ স্থাপনের পরিবেশ নষ্ট করে।
গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেসব নারীর হাইড্রোসালপিংক্স রয়েছে, তাদের ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের (IVF) সফলতার হার প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
🔹 জরায়ুর গঠনগত সমস্যা
জরায়ুর ফাইব্রয়েড (fibroid) বা জন্মগত বিকৃতি (Congenital Uterine Abnormality - CUA) অনেক সময় গর্ভস্থাপন ব্যাহত করে। বিশেষ করে সাবমিউকোজাল বা ইন্ট্রাক্যাভিটারী ফাইব্রয়েড জরায়ুর আস্তরণে প্রভাব ফেলে, ফলে ভ্রূণ স্থাপন সম্ভব হয় না। সাবমিউকোজাল বা ইন্ট্রাক্যাভিটারী ফাইব্রয়েড হলো এমন ফাইব্রয়েড যা জরায়ুর ভেতরের অংশে থাকে এবং গর্ভধারণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
জন্মগত জরায়ুর সমস্যা (CUA) খুব বেশি দেখা যায় না, কিন্তু যেসব নারীর প্রথম বা দ্বিতীয় তিনমাসে গর্ভপাত হয়েছে, তাদের প্রায় ২৫%-এর ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা পাওয়া গেছে।
🔹সময়মতো পরীক্ষা ও চিকিৎসা জরুরি
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এক বছর ধরে নিয়মিত সহবাসের পরও গর্ভধারণ না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে ছয় মাস পরই পরীক্ষা করা উচিত। একই সঙ্গে পুরুষেরও বন্ধ্যাত্ব মূল্যায়ন জরুরি, কারণ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে সমস্যাটি পুরুষের দিকেই থাকে।
“রোগ যত দ্রুত শনাক্ত করা যায়, তত দ্রুত সঠিক চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব,” বলেন ডা. মোশতাক আহমেদ।
“যদি সময় নষ্ট করা হয়, তবে ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অনিয়মিত ঘুম, স্থূলতা এবং অপুষ্টি— এসব কারণ নারীর প্রজননক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে সিগারেট ধূমপান ডিম্বাণুর গুণগত মান ও সংখ্যা ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে আগাম মেনোপজের ঝুঁকিও বাড়ে
https://harvestinfertilitycare.com/
, , , ,