20/11/2025
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল কথা পর্ব- ২
ডা. ছরওয়ার আলম
প্রাচীনপন্থীদের চিকিৎসা কৌশলসমূহ:
১. চিকিৎসাবিজ্ঞানের সকল শাখার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ত্রুটিগুলি নিয়ে কথা বলব।
২. অনুমান নির্ভর চিকিৎসার প্রচার আমার উদ্দেশ্য নয়।
৩. প্রাচীন ও প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েই আমি আলোচনা করবো।
৪. প্রাচীনপন্থীরা তাঁহাদের চিকিৎসাপদ্ধতিই একমাত্র যুক্তিসংগত বলিয়া মনে করেন।
৫. প্রাচীনপন্থীরা মনে করেন, রোগের কারণ নির্ণয় ও উহা দূরীকরণে শুধু তাঁহারাই নিয়োজিত।
৬. প্রাচীনপন্থীদের 'কারণ দূর কর' ঘোষণা অন্তঃসার শূন্য।
৭. রোগের কারণ আবিষ্কার প্রাচীনপন্থীদের পক্ষে অসম্ভব।
৮. অধিকাংশ রোগের উৎপত্তি উৎস, এবং চরিত্র অদৃশ্য প্রকৃতির।
৯. রোগের কারণ অস্পষ্ট হওয়ায় প্রাচীনপন্থীরা প্রথমত কল্পনার আশ্রয় নেন।
১০. প্রাচীনপন্থীরা মৃত মানুষের প্যাথলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যের সাথে জীবিত মানুষের প্যাথলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যের তুলনা করে রোগের কাল্পনিক প্রতিচ্ছবি তৈরী করেন।
১১. ধারণামূলক কারণকে প্রাচীনপন্থীরা রোগ বলিয়া মনে করেন।
১২. কোন বস্তু বা ঘটনার কারণ, সেই বস্তু বা ঘটনা হইতে পারে না।
১৩. কারণকে রোগ মনে করিয়া অজ্ঞাত মিশ্রণ ঔষধ প্রয়োগে চিকিৎসা দেয়া এক ধরণের প্রতারণা।
১৪. রোগের মূল-কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা করিলে প্রাচীনপন্থীদের সঠিক হইতো।
১৫. রোগের মূল কারণ চিহ্নিত করিয়া চিকিৎসা করিলে প্রাচীনপন্থীরা সফলতা পাইতেন।
১৬. স্থায়ী রোগসমূহের প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে চিকিৎসা করিতে পারিলে তা হইতো প্রাচীনপন্থীদের গৌরবের বিষয়।
১৭. স্থায়ী রোগের প্রকৃত কারণ জানা না থাকায় হাজার হাজার বছর ধরে লক্ষ লক্ষ রোগীর চিকিৎসায় প্রাচীনপন্থীরা অকৃতকার্য হন।
১৮. প্রাচীনপন্থীরা রোগের মূল কারণ চিহ্নিত করে সঠিক চিকিৎসা করেন বলিয়া মিথ্যা গর্ব করেন।
১৯. রোগের মূলকারণ, 'সোরা' সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবে তাঁহারা স্থায়ীরোগের চিকিৎসার নামে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন।
২০. রোগের ফলকে প্রাচীনপন্থীরা রোগের কারণ মনে করেন।
২১. প্রাচীনপন্থীরা প্যাথলজিক্যাল পরিবর্তণকে রোগের যৌক্তিক কারণ মনে করিলেও প্রকৃত রোগনির্ণয় ক্ষেত্রে তাহা কাজে আসে না।
২২. আরোগ্যকারী নির্দেশকের অনুসন্ধানের তুলনায় জাঁকজমক বেশি হওয়ায় প্রাচীনপন্থী চিকিৎসকেরা জ্ঞানী হইলেও প্রায়ই বিপদগামী হন।
বিস্তারিত:
১. চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক বিজ্ঞানসমূহ, প্রাকৃতিক, রসায়ন, বিভিন্ন শাখা সম্বলিত প্রাকৃতিক ইতিহাস, বিশেষত মানুষ সম্পর্কিত নরতত্ত্ব (এন্থ্রোপোলজী) , শারীরবৃত্তি (ফিজিওলজি) এবং শরীর সংস্থানবিদ্যা (এনাটমি) প্রভৃতি জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, যে সকল চিকিৎসকের অবদানে সমৃদ্ধ, উহার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন না করিয়া, আরোগ্যকলা ও রোগক্ষেত্রে, ত্রুটিযুক্ত চিকিৎসার ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে, আমি আমার বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখিব। ব্যবস্থাপনা পুস্তক দৃষ্টে, গৎবাঁধা নিয়মে রোগগ্রস্ত মূল্যবান মানবজীবনের চিকিৎসা, উহার অনর্গল প্রচার ও যদৃচ্ছা ব্যবহার, আমার লক্ষণীয় নয়। অশিক্ষিত (হাতুড়ে) চিকিৎসক সাধারণের জঘন্য পেশা হিসাবে, আমি তাহা এড়াইয়া যাইব। প্রাচীনতা ও বিজ্ঞান ভিত্তির দোহাই পাড়িয়া, আজ পর্যন্ত যে চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত, আমি শুধু উহারই আলোচনা করিব।
(সূত্র:অর্গানন অব মেডিসিন, সূচনা, প্যারা ৩ লেখক - স্যামুয়েল হানেমান, প্রকাশকাল - ১৮১০ খ্রি.)
২. প্রাচীনপন্থী চিকিৎসকগণ তাঁহাদের অনুসৃত চিকিৎসাপদ্ধতি, একমাত্র যুক্তিসম্মত বলিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়া থাকেন। কারণ তাঁহাদের মতে, - রোগের প্রকৃতি ও কারণ নির্ণয় করিয়া, উহা দূরীকরণে শুধুমাত্র তাঁহারাই নিয়োজিত। 'কারণ দূর কর', - তাঁহাদের এই শূন্যগর্ভ ঘোষণা, শুধু শূন্যেই নিপতিত হইল। তাঁহাদের সৌখিন কল্পনা, - তাঁহারা রোগের কারণ আবিষ্কারের সমর্থ। তবুও তাঁহারা পারেন নাই। কারণ, ইহা তাঁহাদের অবোধগম্য ও আবিষ্কার অসাধ্য। অধিকাংশ রোগের উৎপত্তি উৎস, এবং চরিত্র গতিশীল (অদৃশ্য) প্রকৃতির। অতএব, অবোধগম্যতাবশতঃ রোগের কারণ নির্ণয়ে, চিকিৎসকগণ প্রথমতঃ কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করেন। দ্বিতীয়ত স্বাভাবিক অচেতন মানবদেহের (এনাটমি) অংশবিশেষের নিরীক্ষার সহিত, রোগাক্রমণে মৃত ব্যক্তির ঐ সকল অংশে পরিলক্ষিত পরিবর্তনের (প্যাথলজিকাল এনাটমি), বিশেষত সুস্থ দেহযন্ত্র ও উহার ক্রিয়ার (ফিজিওলজি) সহিত, রুগ্নাবস্থার বিভিন্ন স্তরে (প্যাথলজি, সিমিওটিকস) অসংখ্য পরিবর্তনের তুলনা করিয়া, মানুষের দেহাভ্যন্তরে রোগাক্রমণ হেতু, অদৃশ্য নিয়মে সংঘটিত পরিবর্তনের আনুমানিক সিদ্ধান্তে উপনীত হন, - যাহা উক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি নির্দেশিত, রোগের প্রধান কারণ ১, কাল্পনিক অস্পষ্ট ছবিমাত্র। এইরূপে ইহাকে, চিকিৎসকেরা একাধারে রোগের নিকটতম কারণ, আন্তরপ্রকৃতি তথা খোদ রোগ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। অথচ, এযাবৎ স্বীকৃত সত্যানুসারে আমরা জানি যে, - কোন বস্তু বা ঘটনার কারণ, সেই বস্তু বা ঘটনা হইতে পারে না। সূতরাং সেই কাল্পনিক অভ্যন্তরীণ রোগ কারণকে, চিকিৎসার লক্ষ্য করিয়া, - অপরিজ্ঞাত আরোগ্য ক্ষমতাসম্পন্ন, এমনকি বিভিন্ন অজ্ঞাত ঔষধ মিশ্রণ প্রয়োগের ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসকদের পক্ষে আত্মপ্রতারণার নামান্তর নয় কি?
টীকাঃ ১ : চিকিৎসকগণ রোগ আরোগ্য সফলতার জন্য, মূল কারণকে রোগের কারণ অনুমান করিয়া, উহা নির্ণয়ে সচেষ্ট হইলে, অধিকতর সঙ্গত ও বাস্তবসম্মত হইত। ইহাতে তাঁহারা পূর্ব অভিজ্ঞতা প্রসূত, সমউত্তেজক কারণ ও মূল কারণ বিশিষ্ট রোগের ক্ষেত্রে, কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি, সাফল্যের সাথে প্রয়োগ করিতে পারিতেন। যথা - পূর্ববর্তী শ্যাঙ্কারের ন্যায়, সেই পারদ দূষিত সহবাস জনিত লিঙ্গ ক্ষতে ফলপ্রদ। যদি তাঁহারা খোঁস চুলকনা বিষের একদা সংক্রমণকে, অন্যান্য স্থায়ী (ক্রনিক) রোগের (অযৌন) উত্তেজক কারণ হিসাবে নির্দেশ করতঃ, প্রত্যেক রোগীবৈশিষ্ট্য অবহিত হইয়া, উহার আরোগ্যকারী কোন বিশেষ চিকিৎসাপদ্ধতির প্রবর্তন করিতে পারিতেন, এবং স্থায়ীরোগের ক্ষেত্রে একসঙ্গে গোচরীভূত ও প্রয়োজনীয় কারণ নির্ণয় করতঃ, উক্ত রোগের চিকিৎসা করিলে, উত্তম ফল লাভ করিতেন। আমার মতে তাহাই হইত, তাঁহাদের পক্ষে একমাত্র গৌরবের বিষয়। স্থায়ী (ক্রনিক) রোগ সোরা মায়াজম হইতে উৎপন্ন, - (হোমিওপ্যাথি মতে প্রথম আবিষ্কৃত হয়, এবং পরে তদানুসারে চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়) এই তত্ত্ব তাঁহাদের অজানা ছিল বলিয়া, বহু শতাব্দীব্যাপী লক্ষ লক্ষ স্থায়ী (ক্রনিক) রোগী, আরোগ্যের ক্ষেত্রে অকৃতকার্য হন। তথাপি তাঁহারা গর্ব করিয়া থাকেন যে, চিকিৎসাক্ষেত্রে রোগের মূল কারণের দিকেই তাঁহাদের লক্ষ্য, এবং একমাত্র তাঁহারাই যুক্তিসংগত উপায়ে চিকিৎসা করিয়া থাকেন। 'সোরা' রোগের মূলকারণ, নিতান্ত প্রয়োজনীয় এই জ্ঞানের অভাবে, স্থায়ীরোগের চিকিৎসার নামে, তাঁহারা চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন।
( সূত্র:অর্গানন অব মেডিসিন, সূচনা, প্যারা ৪ লেখক - স্যামুয়েল হানেমান, প্রকাশকাল - ১৮১০ খ্রি.)
৩. এই মহা সমস্যা অর্থাৎ রোগের অভ্যন্তরীণ অদৃশ্য কারণ আবিষ্কার, - প্রাচীনপন্থী বিচক্ষণ চিকিৎসকগণ কর্তৃক, বস্তুত লক্ষণাবলী সহযোগে উৎপন্ন রোগের ২, সম্ভাব্য সাধারণ প্রকৃতি অনুসন্ধান কার্যে নিয়োজিত হইল। ইহা আক্ষেপ, দুর্বলতা, পক্ষাঘাত, জ্বর, প্রদাহ, কাঠিন্য, অংশ বিশেষের অবরোধ, রক্তাধিক্য। রসের মধ্যে অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন কিংবা নাইট্রোজেনের আধিক্য বা স্বল্পতা; ধমনি, শিরা ও কৈশিক শিরাসমূহের ক্রিয়ার হ্রাস-বৃদ্ধি; অনুভূতি, উত্তেজনা বা প্রজনন বিষয়ে উপাদানগত অনুপাতে পরিবর্তন কিনা? প্রাচীনপন্থীগণ ঐ সকল কারণ নামে অভিহিত অনুমানকে মর্যাদা দিয়াছেন, এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে উহাকেই একমাত্র সম্ভাব্য যৌক্তিকতা বলিয়া গণ্য করিয়াছেন। কিন্তু উহা আপাতত যুক্তিযুক্ত মনে হইলেও, আনুমানিক প্রতারণাপূর্ণ ও অনিশ্চিত হওয়াতে, বস্তুত রোগ নিরূপণক্ষেত্রে কোন কাজে আসে না। তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিগণের অহমিকা চরিতার্থ হইলেও, ইহার বাস্তব প্রয়োগ চিকিৎসকগণকে প্রায়শই বিপদগামী করে। কেননা আরোগ্যকারী নির্দেশকের অনুসন্ধানের চেয়ে, আড়ম্বরই উহাতে পরিস্ফুট।
টীকাঃ ২ : সাধারণ প্রকৃতি অনুসারে রোগের চিকিৎসাকারী, নিজেকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক বলিয়া দাবীর ভাণ করিলেও, বস্তুত তিনি সাধারণ শ্রেণীভুক্ত একজন অ্যালোপ্যাথ ছাড়া আর কিছু নহেন। কারণ সূক্ষ্মভাবে স্বাতন্ত্র্য নির্ধারণ ব্যতীত, হোমিওপ্যাথির কল্পনাই করা যায় না।
(সূত্র:অর্গানন অব মেডিসিন, সূচনা, প্যারা ৫ লেখক - স্যামুয়েল হানেমান, প্রকাশকাল - ১৮১০ খ্রি.)
সংকলনেঃ
ডা. ছরওয়ার আলম
বিএইচ.এম.এস (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন কনসালটেন্ট
মোবাইল: 01911-213072, 01868789804
চেম্বার:
সেবা হোমিও ক্লিনিক
সমবায় সুপার মার্কেট কমপ্লেক্স - ৩
শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়ক
ফেনী সদর, ফেনী।