28/12/2021
বাত রোগে হোমিওপ্যাথিক সমাধান
শীত আসলে যে সমস্থ রোগের বৃদ্ধি পায় এর মধ্যে বাত রোগ উল্লেখযোগ্য।
বাত হচ্ছে চালনক্রিয়া বা লোকেমোশন সম্বন্ধীয় রোগ। পুষ্টির অভাব জনিত কারণে রোগের সৃষ্টি। জ্বর বা দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ সন্ধি মধ্যস্থ শ্বেতবর্ণ তন্তময় ঝিল্লী আক্রমণকে বাত বলে।
বাত রোগের কারণ : পরিপেষণ ক্রিয়ায় বিকৃতি বশত: রক্ত দূষণ প্রভৃতি কারণ। ইহাতে সন্ধি ও গ্রন্থি আক্রান্ত হয়। তৎসহ উহাদের স্ফীতি, প্রদাহ, বেদনা, উত্তপ্ততা, রক্তিমতা, আরষ্টভাব, অবশতা এবং দৈহিক তাপবৃদ্ধি। ইহা নানা প্রকারে প্রকাশ পায় এবং আক্রান্ত স্থান ও লক্ষণ ভেদে বিভিন্ন নামে অভিহিত।বাতের প্রকার : বিভিন্ন নামে এই রোগটি পরিচিতি। শরীরের বৃহৎ সন্ধি আক্রমণ হলে ইহাকে বৃহৎ সন্ধিবাত (Articular Rheumatism) বলে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সন্ধি আক্রান্ত হলে ক্ষুদ্র সন্ধিবাত বা গেটেঁ বাত (Gout) বলে। সন্ধিস্থান আক্রান্ত হলে কেবল পেশী ও তার আবরণ আক্রান্ত হলে তাকে পেশী বাত (Muscular Rheumatism) বলে। এই সব পীড়া তরুন এবং পুরাতন উভয় আকারেই প্রকাশ পেতে পারে। সাধারণত রক্ত দূষণ, পারদ বা উপদংশ বা প্রমেহ দোষ, মূত্রে ইউরিক এসিড জমা, ঠান্ডা, আদ্র, স্যাঁত সেঁতে পরিবেশে বসবাস, ঘর্মবন্ধ, বংশগত দোষ, আবার অনেকে জীবাণু সংক্রামণ বলেও মনে করেন।
বাতের লক্ষণাবলী : রোগটি ধীরে ধীরে আসে তবে অনেক সময় প্রচন্ডভাব প্রকাশ করে। প্রাথমিক অবস্থায় ক্লান্তি, দূর্বল, রোগভাব, ওজন কমা হাতের এবং পায়ের তালু ঘামে, সকাল বেলা সন্ধি সমূহে বেদনা। দৈনিক উত্তাপ বৃদ্ধি স্কন্ধ^, জানু, হাতে পায়ের গাঁট অসহ্য ব্যাথা, সন্ধিস্থল নড়াতে চড়াতে পারে না। আক্রান্ত সন্ধিগুলো স্ফীত, লাল, বেদানময়। ঘাম খুব বেশী এবং তাতে অম্ল গন্ধ। মূত্র লালবর্ণ, পরিমানে কম, প্রবল পিপাসা, পরিপাক ক্রিয়ায় গোলযোগ এবং কিডনীর রোগ।
রক্ত হতে ইউরিক এসিড নির্গত হতে না পারায় হৃদযন্ত্র ও ধমনীর ক্রিয়ার ব্যাঘাত উপসর্গ হিসেবে হৃদযন্ত্রের পীড়া, ফুসফুসের পীড়া, ম্যানিনজাইটিস, চোখের প্রদাহ। রক্ত নেট্রাম ফসের অভাবহেতু শরীরে ল্যাকটিক এসিড বৃদ্ধি পায়।
শিশুদের বাত : শিশুদের সাধারনত দু’ধরণের বাত হয়। জুভেনাইল রিউম্যাটিয়েড আর্থ্রাইটিস এবং রিউম্যাটিক ফিভার। এ ছাড়া মেরুদন্ডে বিশেষ ধরণের বাত হতে পারে যাকে বলে রিউম্যাটিয়েড স্পন্ডিলাইটিস
দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতার হ্রাস অথবা গলার জ্বালা যন্ত্রণা, যেমন- টনসিলের রোগ বা দেহে অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি রি-অ্যাকশনের জন্য এই রোগ সৃষ্টি হয়।
রক্তের রিউম্যাটয়েট ফ্যাক্টর, সি আর অ্যাষ্টিভ প্রোটিন ইত্যাদি বেড়ে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস দেখা দেয়।। এসব ছাড়াও শিশুদের গাঁটে ব্যাথার অন্যতম কারণ তীব্র রিউম্যাটিক ফিভার এবং এটি স্টেপটোকক্কাস নাম জীবানুর সংক্রমনের ফল এবং টনসিলে আক্রমন। সাধারণ (৪-১৬) বছর বয়েসি ছেলে মেয়েরাই এই রোগের আক্রান্ত হতে পারে। জ্বর, বুকে ব্যাথা, গাঁটে ফোলাভাব ও ব্যাথা দিয়ে এই রোগ শুরু হয়। হাঁটু, কনুই, কবজি, অ্যাংকেল জয়েট ইত্যাদি সন্ধিতে সমস্যা অর্থাৎ ব্যথা, ফোলা এবং সঞ্চালন ক্ষমতা কমতে থাকে। কারও কারও বুক ধড়ফড় এবং নিঃশ্বাসের কষ্ট হয়। ব্যাথা এক সন্ধি থেকে আর এক সন্ধিতে ছড়িয়ে পরে।
রোগের প্রথমাবস্থায় বাচ্চাদের (মেয়েদের সমস্যা ছেলেদের চেয়ে তিনগুন বেশী) হাত ও পায়ের আঙ্গুলের গাঁট শক্ত হয়ে থাকবে। গাঁটগুলো লালচে ভাব হয়, গরম হয় এবং জ্বালাভাব হতে পারে। শিশুদের গাঁটের বাত, বিশেষ করে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস হলে কাল বিলম্ব না করে চিকিৎসা করাতে হবে। তা না হলে রোগ বেড়ে গিয়ে রোগীকে পঙ্গু পর্যন্ত করে দিতে পারে।
রোগ নির্ণয় (Diagnosis Through investigation) : Blood Test: (ESR High, Hypehremic Anaemia, Fibrinogen Context-raised. Rose waller Test and Latex fixation Test-Positive. বাত রোগে অত্যাধুনিক বায়োকেমিক চিকিৎসা : পিত্ত প্রধান ধাতুর রোগীর পুরাতন গ্রন্থি বাতের উৎকৃষ্ট ঔষধ Natrum Sulp 200x প্রচন্ড বেদনাসহ বাত রোগ, গরম প্রয়োগে উপসম ক্ষেত্রে Mag phos-200x । অম্ল প্রধান ধাতুর রোগীর গ্রন্থিগুলো আক্রান্ত হলে Natrum phos-200x । শরীরের কোন অংশ ফুলে গেলে তরুন অথবা পুরাতন বাত রোগের ক্ষেত্রে Kalimur-200x । রোগের প্রথম অবস্থায় জ্বর লক্ষণে Ferrum phos-200x । রোগীর যন্ত্রনা স্থানটি শক্তভাব, ভীষণ দূর্বলতা লক্ষনে Kali phos-200x । বাতে যন্ত্রনা সঞ্চলনশীল বিশেষতঃ পৃষ্টে, ঘাড়ে, কাঁধে, বৈকালে ও গরমে রোগ বৃদ্ধি ক্ষেত্রে কেলি সালফ-২০০এক্স
মাত্রা ও শক্তি প্রয়োগ : উচ্চ শক্তি ১ গ্রেন ট্যাবলেট ৪টি দিনে ৩/৪ বার প্রথম অবস্থায় সেব্য। পরবর্তীতে দিনে দুইবার দীর্ঘদিন প্রয়োগ করতে হবে।
পথ্য ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা : পূর্ণ বিশ্রাম এবং রোগীকে শুইয়ে রাখতে হবে। আক্রান্ত স্থান গরম কাপড় দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। ঠান্ডা বাতাস লাগান, জলে ভেজা নিষেধ। ফলের রস উপকারী, তৃষ্ণা থাকলে অল্প অল্প জলপান করতে দিবে। রোগের প্রকোপ একটু কমলে রুটি, সুজি, তরকারী দেওয়া যায়। বাতের রোগীকে রাত্রে ভাত না দিয়ে দুধ রুটি, ডাল রুটি দেওয়া ভাল।
বাত রোগের হোমিওপ্যাথিক ব্যবস্থাপনা : হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা যেহেতু লক্ষণ ভিত্তিক সেহেতু লক্ষণ অনুযায়ী বাত রোগের চিকিৎসা করতে হবে।
কটি বাত (কোমর বেদনা- Lumbago) : কোমর ব্যথার জন্য সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না। মাংস-পেশিতে যেন টান পড়ে। মনে হয় ঐগুলো সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। এই রোগের অ্যামোন মিউর উত্তম ঔষধ (পরীক্ষিত)। বিশ্রামে উপশম। কোমরে আড়ষ্টভাব ও ব্যাথা। কনকনে ব্যাথার মহৌষধ রাস টক্স। ক্রমিক সঞ্চালনে, ঘর্ষনে ও গরম সেকে উপশম। ভারী জিনিস তুলতে গিয়ে কোমরে লাগল রাস টক্স চিন্তনীয়। আঘাত জনিত মেরুদন্ডের বেদনায় হাইপেরিকাম অব্যর্থ (পরীক্ষিত)। কোমরে বাত চিকিৎসায় মেক্রোটিন ৩০ ভাল ঔষধ।
ভ্রমনশীল বাত : সিমিসি, কেলিবাই (গরমে উপশম)। পালস্ (ঠান্ডায় উপশম)। নির্দিষ্ট ঔষধে কাজ না পেলে মেডোরিনাম ১০ম। বিকালে সিফিলিনাম ১ম ও তদোর্ধ।
হাঁটু বাত : রাসটক্স, লিডাম, গুয়েকাম, মেডো, সিলিলিলাম, ল্যাকেসিস।আঙুলের গিরার বাতঃ কলোফাইলাম, কর্ষ্টিকাম, এন্টিম ক্রুড, রাসটক্স ভাল ঔষধ।বুকের বাত : ইহাতে বুকে পিঠে আংটা দিয়ে ধরে, রোগী কথা বলতে পারে না লক্ষনে সিমিসিফিউগা, আর নড়াচড়া করতে নাপারলে ব্রায়োনিয়া ১ম ২ ঘন্টা অন্তর অন্তর প্রয়োগ।
ঘাড়ে বাত : ইহাতে ল্যাক-নানর্থিস, সিমিসি, স্টিকটা, ব্রায়ো, কষ্টিকাম, ব্যবহৃত হয়। ঘাড় ও পিঠ শক্ত হয়ে গেলে এবং ঘাড় বেঁকে গেলে স্টিকটা (২০০- ১ম)। ঘাড় শক্ত, নারতে পারে না। ঘাড় ডান- বাম দিকে বেঁকে যায় ল্যাক নানথিস(২০০- ১ম) ব্যবহার্য। ঘাড় নাড়াচাড়ায় ব্যথা হয়, যে কোন দিকে ঘাড় বেঁকে যেতে পারে কষ্টিকাম (১ম- ১০ম) ব্যবহার্য।
সন্ধি বাত : সন্ধিবাতে সন্ধিগুলো ফুলে গেলে ও নাড়াচাড়ায় অসুবিধা হয় আর্নিকা ৩০ বার ব্যবহার্য। এ অবস্থায় কলচিকাম ৩০ ঘন ঘন সেবন ও ইহার মুল ঔষধ বাহ্য প্রয়োগ বিধেয়।
ঝিনঝিনে বাত : হাত ও পায়ে আঙ্গুলে ঝিন ঝিন করলে আ্যামন মিউর- ৩০ দিনে ৩ বার সেব্য। পায়ের পাতা ঝিন ঝিন করলে কষ্টিকাম ২০০ প্রত্যেহ ১ বার সেব্য। পা-ঝিন ঝিন করলে রাসটক্স, ক্যালকেফস প্রদেয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : বাত রোগে কোন ফল না পেলে প্রথমে মেডোরিনাম এবং তারপর সিফিলিনাম ব্যবহার করবেন। বাত রোগ দিনে বৃদ্ধি পেলে মেডোরিনাম আর রাত্রে বৃদ্ধি পেলে সিফিলিলাম ব্যবহার্য। অত্যাধিক শারীরিক পরিশ্রমের পর বাত রোগ হলে আর্নিকা উচ্চশক্তি ব্যবহার্য।
উপসংহারে বলা যায় যে, জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় হোমিওপ্যাথির যে গুরুত্ব আছে, তা একক অনন্য বললেই শেষ হয় না। সবার জন্য স্বাস্থ্য এই স্লোগানটি যদি বাস্তবে রুপ দিতে হয়, যদি জনগনদের দোর গোড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌছে দেয়ার ইচ্ছা থাকে, যদি দরিদ্র এই দেশের অবহেলিত বঞ্চিত এই মানব সন্তানকে রুগ্নতার অভিশাপ থেকে কেউ বাচাতে চান, তবে হোমিওপ্যাথির গুরুত্বকে মেনে নিয়ে পূর্ন স্বীকৃতির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।(সংগ্রহ ও সংযোজন)