05/07/2022
বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ,পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশগত মান উন্নয়নে জনসচেতনতা তৈরিতে সিআরপি’র সাপ্তাহিক প্রতিবেদনের আজ দ্বিতীয় পর্ব।
শব্দদূষণ বলতে আমরা কি বুঝি?
সাধারণত মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর শ্রুতিসীমা অতিক্রমকারী কোনো শব্দকে শব্দদূষণ বোঝায় যার কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।অর্থাৎ মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর উপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টিকারী শব্দই হলো শব্দদূষণ।বাংলাদেশ বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় শব্দদূষণ এক নিরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের পর এবার শব্দদূষণেও বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করছে ঢাকা। শব্দদূষণে ঢাকার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ।বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা তুলে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল এবং রাজশাহীতে এর মাত্রা ১০৩ ডেসিবল পাওয়া গেছে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের সবশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে আবাসিক এলাকায় এই মাত্রা সর্বোচ্চ ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত এই মাত্রা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ঢাকা ও রাজশাহীতে শব্দের তীব্রতা এই নির্ধারিত মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি।
শব্দদূষণের মূল কারণ কী?
• বিভিন্ন যানবাহনের অতিমাত্রায় সাধারণ ও হাইড্রোলিক হর্ণের ব্যবহার।
• বিভিন্ন প্রচারণার কাজে ব্যবহ্রত মাইকের শব্দ ও লাউড স্পিকারের অবাধ ব্যবহার।এছাড়াও ঢোলের শব্দ,বোমা,আতশবাজি বা পটকা ফোটানোর আওয়াজ।
• বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে,সভা-সমাবেশ,ধর্মীয় উৎসবে উচ্চ শব্দে মাইকের ও লাউড স্পিকারের ব্যবহার।
• শিল্প কারখানা থেকে উৎপন্ন শব্দ।
• উচ্চ শব্দে কথা বলা ও হেড ফোনের ব্যবহার।
• নির্মাণ কাজ ও বিস্ফোরণ কর্মসূচী।
• বিমান ও রেলের প্রচণ্ড শব্দ।
শব্দদূষণ কেন ক্ষতিকর?
সারা বিশ্বে ৩০টি কঠিন রোগের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে শব্দদূষণ একটি।
• শব্দদূষণের ফলে কানে কম শোনা ও আংশিক বা পুরোপুরি বধিরতা হতে পারে।
• হ্রদরোগ, ফুসফুসজনিত জটিলতা ও উচ্চ রক্তচাপসহ মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটতে পারে।
• অনিদ্রা,স্মরণশক্তি হ্রাস,দায়িত্ব পালনে অমনযোগিতা ও মানসিক চাপসহ নানারকম স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দেয়।
• বয়স্ক ব্যক্তি, গর্ভবতী মা, শিক্ষার্থী ও উচ্চ শব্দ হয় এমন স্থানে কর্মরত লোকজনদের যেমনঃকল-কারখানা/শিল্প প্রতিষ্ঠান/নির্মাণ কাজের শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দেয়।
• গর্ভবতী নারী দীর্ঘসময় শব্দদূষণ এলাকায় অবস্থান করলে বধির সন্তান জন্ম দেয়ার ঝুঁকি থাকে।
• শিশুদের মনযোগ নষ্টসহ মেধার বিকাশ ব্যাহত হয়।
• মাথাব্যাথা ও খিটখিটে মেজাজের সমস্যা ইত্যাদি।
• দীর্ঘমেয়াদী শব্দদূষণ উদ্ভিদের বৃদ্ধি হ্রাসসহ শস্যের উৎপাদন/মান হ্রাস করে।
• প্রচণ্ড শব্দ যেমনঃ আতশবাজির কারণে পাখি বা অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনে কি উল্লেখ আছে?
• ধারা ৭ এর বিধিমালা ৯ অনুসারে অনুমতি ছাড়া কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারবে না।
• ধারা ৮ অনুসারে কোন ব্যক্তি মোটর, নৌযান বা অন্য কোন যানে শব্দের অনুমোদিত মাত্রা অতিক্রমকারী হর্ণ ব্যবহার করতে পারবে না।
• নীরব এলাকায় চলাকালে যানবাহনে কোন প্রকার হর্ণ বাজানো যাবে না।
• খোলা বা আংশিক খোলা জায়গায় বিবাহ বা কোন সামাজিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,কনসার্ট,সভা-সমাবেশ,মেলা,হাট-বাজার ইত্যাদি আয়োজনের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারবে।
• ধারা ১১ অনুসারে আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে উক্ত এলাকায় নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে ইট বা পাথর ভাঙ্গার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না এবং সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭ টা পর্যন্ত মিক্সচার মেশিনসহ নির্মাণ কাজে ব্যবহ্রত অন্যান্য যন্ত্র চালানো ্যাবে না।
শব্দদূষণজনিত অপরাধের শাস্তি কি?
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা -২০০৬ অনুসারে শব্দদূষণ একটি দণ্ডনীয় অপরাধ।
• প্রথমবার অনধিক ০১ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।
• পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ০৬ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।
আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশ-পাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নিরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
শব্দ দূষণ প্রতিরোধে করণীয় কি?
শব্দ দূষণ সহ আরো যে কোন দূষণ প্রতিরোধে সরকার আগেই আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু সচেতনতার অভাবে আমরা প্রতিনিয়ত শব্দ দূষণ করে চলেছি। শব্দ দূষণকে প্রতিরোধ করতে যে সকল কারণের জন্য শব্দ দূষণ হচ্ছে, তাকে নির্মূল করতে হবে।বর্তমানে শব্দদূষণ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা খুবই আশঙ্কাজনক। কিন্তু এই সমস্যা মানুষেরই তৈরি। ফলে আমরা একটু সচেতন হলেই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করাটা অসম্ভব কিছুই নয়
(i) শব্দ বাজি/পটকা ইত্যাদি পোড়ানো বন্ধ করতে হবে।
(ii) যানবাহনে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। যানবাহন বেশি পুরনো হয়ে গেলে নতুন নিতে হবে।
(iii) কলকারখানা লোকালয় থেকে দূরবর্তী স্থানে প্রতিস্থাপন করতে হবে। কলকারখানায় সীমানা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে।
(iv) উচ্চ আওয়াজে মাইক বাজানো বন্ধ করতে হবে।
(v) স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাছাকাছি গাড়ির হর্ন বাজানো বন্ধ করতে হবে।
(v) বাড়িতে মোবাইল, রেডিও-টিভি বেশি জোরে চালানো যাবেনা।
আমাদের সচেতনতা ও সমন্বিত উদ্দ্যোগই পারে শব্দদূষণ রোধ করতে।
ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত।