28/10/2025
গত শনিবার এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা, প্রতিমা দেবী (নাম পরিবর্তিত), চেম্বারে ঢুকলেন। বসেই বললেন,
“ডাক্তারবাবু, আমি কিন্তু পেশেন্ট নই, আমার মেয়েই পেশেন্ট।”
জিজ্ঞাসা করলাম, “তাহলে উনি আসেননি কেন? বয়স কত আপনার মেয়ের?”
তিনি বললেন, “বয়স চৌদ্দ। কিন্তু ও আসতে পারবে না।”
“কেন? কী হয়েছে?”
প্রতিমা দেবী একটু থেমে বললেন,
“ও ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত। গত এক বছর ধরে পিরিয়ড শুরু হয়েছে, কিন্তু প্রতি মাসে খুব বেশি ব্লিডিং হয়। আর যখন পিরিয়ড হয়, ও নিজের হাইজিন মেন্টেন করতে পারে না। জামাকাপড়, বিছানা সব নোংরা করে ফেলে। তাই ভাবছিলাম, পিরিয়ড বন্ধ রাখার কোনো উপায় আছে কি? যেমন ধরুন, ইউটেরাস বাদ দেওয়া বা অন্য কিছু?”
তাঁকে বোঝানো হল, “দেখুন, ইউটেরাস বাদ দেওয়া এই বয়সে খুবই কঠিন ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। একবার করলে সেটা আর ফেরানো যায় না। বরং আমরা কিছু ওষুধ দিতে পারি যাতে পিরিয়ড কমে যায় বা তিন-চার মাস পরপর হয়। এগুলো রিভার্স করা যায়, মানে চাইলে পরে বন্ধও করা যায়।”
তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, কী কী উপায় আছে বলুন।”
বিস্তারিত ভাবে সব বুঝিয়ে বলা হল।
কিন্তু কথার ফাঁকে হঠাৎ দেখলাম, তাঁর চোখে জল।
“ডাক্তারবাবু, এই মেয়েকে নিয়ে আমার খুব কষ্ট হয়,” তিনি বললেন। “ওর বাবা তিন বছর আগে মারা গেছেন।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তাহলে আপনি একাই সব সামলান? মেয়ে স্কুলে যায়?”
“হ্যাঁ, বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের একটা স্কুলে পড়ে। কিন্তু বুদ্ধিশুদ্ধি খুব একটা বাড়েনি, নামমাত্র পড়াশোনা করে।”
চেম্বারের বাইরে তখন রোগীরা অধৈর্য হয়ে উঠছেন—“একজন পেশেন্টের এতক্ষণ লাগে নাকি?”
কিন্তু প্রতিমা দেবী থামলেন না। বললেন,
“এখন তো শুনি প্রেগন্যান্সির সময়েই নাকি জানা যায় বাচ্চার ডাউন সিনড্রোম আছে কিনা। আমাদের সময় তো এসব ছিল না। তখন আমার বয়স ছিল পঁচিশ।”
“আসলে ২০১১ সালে আপনার মেয়ের জন্মের সময়ও এই টেস্টগুলো ছিল। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ভাবা হতো ৩৫ বছরের বেশি বয়সী মহিলাদেরই এই টেস্ট দরকার, কিন্তু এখন আমরা বলি—প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলারই এই স্ক্রিনিং করা উচিত। কারণ প্রতিটা বাচ্চাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই টেস্টে শুধু ডাউন সিনড্রোম নয়, আরও অনেক জন্মগত ত্রুটি—যেমন হার্ট, কিডনি, বা মস্তিষ্কের গুরুতর সমস্যা—ধরা যায়। যদি এমন কিছু ধরা পড়ে যা চিকিৎসায় সম্ভব নয়, তাহলে প্রয়োজনে গর্ভপাত করে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যায়। শুধু দরকার ঠিক জায়গা থেকে অত্যাধুনিক টেস্ট করা”
তিনি চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন, তারপর বললেন,
“জানেন, আমার ৩০ বছর বয়সে আরেকটা প্রেগন্যান্সি হয়েছিল। বাচ্চাটা জন্মেছিল, কিন্তু তিন মাসের মাথায় মারা যায়। হার্টে ফুটো ছিল, বুকেও ইনফেকশন হয়েছিল। পরে জানা যায়, সেও ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিল।”
তারপর যে কথাটা বললেন, সেটা শুনে সত্যিই মনটা ভারী হয়ে গেল।
তিনি বললেন,
“ডাক্তারবাবু, অনেক কষ্টের কথা বলছি, কিন্তু এখন ভাবি—বাচ্চাটা মারা গিয়েছিল, তাতেই হয়তো ভাল হয়েছে। না হলে আজ আমি কীভাবে দুটো ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত বাচ্চাকে একা মানুষ করতাম? একটাকে নিয়েই হিমশিম খাচ্ছি।”
তার কথায় একটা অসহায় বাস্তবতার ভার ছিল।
চেম্বারের বাইরে এখনও রোগীদের আওয়াজ, কিন্তু ভিতরে একটা গভীর নীরবতা নেমে এল।
মনে পড়ল—অক্টোবর মাস হচ্ছে Down Syndrome Awareness Month। অথচ এখনো আমাদের সমাজে ডাউন সিনড্রোম নিয়ে পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই।
ডাউন সিনড্রোমই হলো শিশুদের জন্মগতভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। অথচ সময়মতো সচেতনতা, স্ক্রিনিং, আর পরামর্শ থাকলে অনেক পরিবারকে এই অসহনীয় কষ্ট থেকে বাঁচানো যেত।
লেখা: ডাঃ সুজয় দাশগুপ্ত