05/12/2025
V_1
আসসালামুয়ালাইকুম, আজকে আমরা আলোচনা করবো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন সহস্রাব্দের সূচনা/ Coming of the New Millennium.
সাম্প্রতিক সময়ে বছর গুলোতে, স্বাস্থ্য এবং রোগ সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনার বিষয় এক গভীর বিপ্লব সূচিত হয়েছে। চিন্তাশীল ব্যক্তি এবং যারা খুব ভালো খোঁজ খবর রাখেন তারা চির/ পুরাতন রোগের কার্যকর নিরাময়ের উপায় চাচ্ছেন, শুরু হয়েছে এদের থেকেই, এসবই প্রভাব ফেলেছে পে আছেশাজীবী চিকিৎসকদের উপর, সেই সাথে সরকারের নীতিনির্ধারকদের উপরও।
আধুনিক কালে এ ধারার চিন্তা ভাবনা ঠিক কোথায়, কবে শুরু হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে তা আমাদের নিয়ে যায় হিপোক্রেটিস এবং তারও আগের সময়ে, তবে পরবর্তীতে প্রযুক্তি এবং চরম বস্তবাদী বিশ্ব দৃষ্টি ভঙ্গির আগমনের কারণে তা কিছু দিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল।
মনোবিজ্ঞানের উন্নতি, সমগ্ৰ মানব সত্ত্বার ধারণা, আধ্যাত্মিক সচেতনতার পূর্নজাগরণ এমনকি পরিবেশ সচেতনতা এসবই ঐ হারিয়ে যাওয়া চিন্তা ধারাকে পুনরায় সামনে নিয়ে এসেছে। আধুনিক সময়ের উচ্চমানের শিক্ষার কল্যাণেই এ বৈপ্লবিক চেতনার বিকাশ ঘটেছে।
এ ধারা থেকেই উদ্ভব হয়েছে নানা ধরনের চিকিৎসা, ক্লিনিক,ক্লাস, সেমিনার, প্রকাশনা এবং ব্যবসাসমূহ, যাকে সাধারণ ভাবে বলা হয় ' সামগ্ৰিক স্বাস্থ্য ' (Holistic Health) আন্দোলন। মূল ধারণা হচ্ছে, আমরা প্রত্যেকেই এক অখণ্ড সমগ্ৰ । আমরা এমন কোন ভাবে বিভিন্ন অংশে টুকরো হতে পারি না যাতে একেক ভাগে একেক রোগ হতে পারে, বা পৃথক পৃথক রোগ নিরূপণ করা যেতে পারে। মহাবিশ্বের মৌলিক সূত্রকে অমান্য না করলে আমরা কোনভাবেই কোন বিশ্বাস, জীবনধারা, সম্পর্ক বা চিকিৎসা দ্বারা বিভক্ত হতে পারি না। আমরা প্রত্যেকেই একক ও অনন্য ব্যক্তি, পরিপূর্ণ ও সমগ্ৰ , আমাদের চারপাশের মহাবিশ্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে কাজ করছি সামগ্ৰিক সত্ত্বা হিসেবে। স্বাস্থ্য বা রোগের সব অবস্থানই এ প্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যত বেশি এ নীতি মেনে এর গন্ডির মধ্যেই যাপন করব ততই উপভোগ করব নিরিবিচ্ছিন্ন অবস্থান এবং ভারসাম্য পূর্ণ জীবনীশক্তি।
সামগ্ৰিক স্বাস্থ্য মতবাদের দ্বিতীয় মৌলিক নীতি হচ্ছে যে, সবচেয়ে কার্যকর, বস্তুতপক্ষে একমাত্র আরোগ্যের পথ হচ্ছে পীড়িত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ কৌশলের শক্তিকে বৃদ্ধি করা। সহজাত একটা স্বীকৃতি রয়েছে যে ,জীবন্ত ব্যক্তি একটি সহজাত শক্তি দ্বারা সচল থাকে। এটি যখন বিশৃঙখলিত হয় তখন রোগ নির্দেশিত হয়, যখন সঠিকভাবে ক্রিয়াশীল থাকে তখন তা স্বাস্থ্য নির্দেশ করে। এ শক্তির স্বরূপ এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে উদঘাটন, অবলকন বা পরিমাপ করা হয় নি। কিন্তু এ শক্তি যে আমাদের ভিতরে কাজ করছে সে বিষয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল রয়েছি।
আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি যে, আমাদের কিছু বন্ধু অন্যদের চেয়ে উচ্চ জীবনীশক্তির অধিকারী। জীবনীশক্তি উঠানামা করে ঘন্টায় ঘন্টায়, দিনে দিনে, এ অভিজ্ঞতা আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে; এ পরিবর্তনের জন্য আমরা বিভিন্ন রকম চাপ, খাদ্য, ঘুম ইত্যাদিকে দায়ী করি, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে কারণ যাই হোক না কেন, আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে জীবনীশক্তির হ্রাস -বৃদ্ধি আছে।
একজন ' সামগ্ৰিক স্বাস্থ্য ' চিকিৎসক তার রোগীকে তার নিজের জীবনের বিভিন্ন দিক গুলোকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করেন, কোনগুলো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে উজ্জীবিত করে, আর কোনগুলো তাদের প্রতিরোধ করে। এরপর নিজের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের প্রাথমিক দায়িত্ব রোগীর নিজের কাঁধেই বর্তায়। এ প্রেক্ষিতে, লক্ষণ গুলোকে দেহ কর্তৃক সংঘটিত রোগ নিরাময় প্রচেষ্টা বা পীড়ার সংকেত হিসেবে দেখা দেয় এবং চিকিৎসার জন্য তাকে সেভাবেই বিবেচনা করা হয়।এ ধারণাটি প্রচলিত চিকিৎসা শাস্ত্রের ধারণার সাথে বৈসাদৃশ্য পূর্ণ, এদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এ লক্ষণগুলোকে দাবিয়ে দিতে হবে।
আমি এখন কয়েকটি প্রধান সামগ্ৰিক চিকিৎসা প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই, পরিষ্কার করতে চাই এর অবস্থান, যার মধ্য থেকে আমরা হোমিওপ্যাথিকে অনুধাবন করতে পারব। এ ধরনের সামগ্ৰিক ধারণা ছিল পুষ্টি,যা তখন ব্যাপক জনস্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৫০ সালের দিকে এর প্রণেতা এডলি ডেভিস (Adelle Davis) প্রথম একে জনপ্রিয় করে তোলেন। সুস্বাস্থ্যের সারকথা হচ্ছে সঠিক পুষ্টি, এ ধারণা দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। সঠিক সুসামঞ্জস্যপূর্ণ পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা যখন বৃদ্ধি পায়, তখন জনগণ নিজেদের খাদ্য ও পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা নিয়ে তাদের চিকিৎসকদের সাথে আলোচনা করতে থাকে - এ কথা সামনে নিয়ে আসতে যে তারা এ বিষয়ে তাদের চিকিৎসকদের চেয়ে বেশি জানে। অতিন্দ্রিয় রহস্যে ঘেরা চিকিৎসা বিদ্যার ক্রম অবসান ঘটানোর
ক্ষেত্রে এটি ছিল প্রথম সর্বাপেক্ষা বিশাল পদক্ষেপ।
এডলি ডেভিস কর্তৃক শুরু হওয়া তার এ প্রিয় ধারণা একসময় তার নাগালের বাইরে চলে যায়। মানব গোষ্ঠীর বিকাশের পেছনে প্রকৃত পক্ষে যে ধরনের পুষ্টির ভূমিকা ছিল তাতে ফিরে যায়। তবে দুটি নীতি গুরুত্ব পায় - উপযুক্ত পুষ্টি দ্রব্যের সংস্থান ( প্রাথমিকভাবে শস্য,বীজ, বাদাম, শাকসবজি এবং ফলের মাধ্যমে) এবং নানাবিধ উপায়ে দেহ থেকে বিষাক্ত উপাদান অপসারণ প্রক্রিয়া। এভাবে, একই সাথে যথাযথ ভারসাম্যপূর্ণ পুষ্টদ্রব্যের যোগান এবং দেহকে বিষাক্ত উপাদানের ভারমুক্ত করার মাধ্যমে জীবনীশক্তিকে নিরিবিচ্ছিন্ন রাখা হয়।
পুষ্টি প্রদান ও বিষাক্ত উপাদান অপসারণ দেহের তৃতীয় আর একটি প্রয়োজনকে সংযুক্ত করে তা হচ্ছে ব্যায়াম। পুরো বিবর্তন প্রক্রিয়া জুড়ে প্রায় গত শতাব্দী পর্যন্ত ব্যায়াম ছিল দৈনন্দিন স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখার মূল দিক। গত কয়েক বছর ধরে ব্যায়ামের প্রতি যথার্থ আগ্ৰহের সৃষ্টি হয়েছে, শুধু চিকিৎসা হিসেবে নয়, আত্মোন্মোচনের এবং নির্ভেজাল আনন্দ লাভের জন্যও। অর্জিত স্বাস্থ্যকে সুরক্ষার জন্য যথার্থ পুষ্টি ও ব্যায়াম খুবই চমৎকার একটি সমন্বয়, কিন্তু এদের মধ্যে কোনটি চিকিৎসা শাস্ত্রের জন্য জরুরি?
অনেকগুলো প্রয়োগ কৌশল পুনঃআবিষকৃত হয়েছে বা জনপ্রিয়তা পেয়েছে - আকুপাংচার, পোলারিটি ম্যাসেস, লোমি ম্যাসেস, রিফ্লেক্সলজী, নানা ধরনের আঙ্গিক উপাচার, কাইরোপ্রাকটিস, অস্টিওপ্যাথি ইত্যাদি। এ ধরনের অনেক গুলো প্রয়োগ কৌশল হাতে পেয়ে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, ক্রনিক রোগের চিকিৎসার জন্য দেহের নিজস্ব আরোগ্য প্রক্রিয়াকে পরিপুষ্ট করতে দিয়ে, তাকে বাঁধাহীন ভাবে কাজ করতে দিয়ে, তাকে পুনঃভারসাম্যে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তা করতে হবে ঔষধের বিষক্রিয়া, বিকিরণ বা সার্জারির সাহায্য ছাড়াই।
দুর্ভাগ্যক্রমে, চিররোগ আক্রান্ত ব্যক্তির অতি আশা অবশেষে নিরাশায় পরিণত হল, যদিও নতুন পদ্ধতি গুলো কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পেরেছিল, তবু প্রচলিত পদ্ধতিতে আরোগ্য যেমন দূরে ছিল এখানেও তার চেয়ে বেশি কাছে আসতে পারল না। দেখা গেল সুফল ধরে রাখতে হলে রোগীকে চিকিৎসা চালিয়েই যেতে হবে, ফলাফল ক্ষণস্থায়ী বা ক্রম অবনতির দিকে হলেও। চিররোগের উৎপত্তি সম্পর্কে মৌলিক অন্তর্দৃষ্টি এবং চিকিৎসা পদ্ধতির যথার্থ নীতিমালা না থাকায় নতুন পদ্ধতি গুলো শুধু প্রয়োগ কৌশল রয়ে গেল।
এরকম প্রেক্ষাপটে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ হোমিওপ্যাথির অতি পরিশীলিত বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আমার চল্লিশ বছরের চিকিৎসা অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, এটি হচ্ছে বর্তমান সময়ের সকল তরুণ ও চিররোগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি। অবশেষে সামগ্ৰিক চিকিৎসা পদ্ধতির সারবস্ত আমাদের নাগালে এল এবং স্বপ্নচারিত প্রকৃত আরোগ্য পরিনত হলো বাস্তবে।
লেখক ডাঃ মোঃ সাইফুল ইসলাম ডি এইচ এম এস ঢাকা।
চেম্বার ঃ সিফাত হোমিও হল, শালবন মিস্ত্রীপাড়া, হারাগাছ রোড, রংপুর।০১৫৭৫৩৬০৬৮৮.
মূল লেখক প্রফেসর জজ ভিথোলকাস
অনুবাদ ডাঃ এস. হাসান