24/08/2021
সকল বিধিনিষেধ আরোপ সত্বেও দেশে দেশে করোনা সংক্রমণের এবং তৎজনিত কারণে মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। এই তান্ডবের পিছনে রয়েছে এই ভাইরাসের আর একটি পরিবর্তিত রূপ ডেলটা ভ্যারিয়্যান্ট। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ভারত থেকে উৎপত্তি হয়ে সমগ্র পৃথিবী ব্যাপি ত্রাস সৃষ্টি করে যাচ্ছে। ভারতে তান্ডবলীলা চালানোর পর সারা পৃথিবীতে তার অবাধ বিচরণ। বাংলাদেশে গত মার্চ মাস থেকে করোনার ২য় ঢেউ প্রবাহমান এবং ৮ ই মে প্রথম এই দেশে করোনার ডেল্টা ধরণের সংক্রমণ সনাক্ত হয়। বিএসএমএমইউ এর এক গবেষণায় উঠে এসেছে দেশে আক্রান্তদের প্রায় ৯৮ শতাংশই এখন নূতন ভ্যারিয়্যান্ট দ্বারা আক্রান্ত। পৃথিবীর প্রায় অনেক দেশেই এখন করোনা ভাইরাসের এই নূতন রপের রাজত্ব। অন্য একটি নামেও ভাইরাসটি পরিচিত, আর তা হলো বি.১.৬১৭.২।
এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট হলো অতিমাত্রার সংক্রমণশীলতা, যা মূল ভ্যারিয়্যান্টের প্রায় দ্বিগুণ। তার প্রমাণ হলো মার্চ ২০২০ থেকে গত ১৭ মাসে যতজন আক্রান্ত হয়েছে শুধুমাত্র গত জুলাই মাসেই তার এক চতুর্থাংশের বেশী সংক্রমিত হয়েছে। টেষ্ট পজিটিভের দিকে যদি লক্ষ্য করি গত মে মাসের শুরুতে যা ছিল ৫% এর নীচে, তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০% বা তার কাছাকাছি, যদিও গত এক সপ্তাহ ধরে এই ট্রেন্ডটি কিছুটা নিম্নমুখী।
এই ভ্যারিয়্যান্টটির আর একটি খারাপ দিক হলো যারা টীকা গ্রহণ করেনি এমন ব্যক্তির শ্বসন যন্ত্রে এর অনেক বেশি ভাইরাল লোড (শ্বসন যন্ত্রে ভাইরাসের সংখ্যা), যা অরিজিনাল স্ট্রেইন অপেক্ষা হাজার গুণ বেশি। চীনের একটি গবেষণায় তা উঠে এসেছে। ভ্যাক্সিন যে এই স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর এই গবেষণাটি তাই নির্দেশ করে।
এই স্ট্রেইনে আক্রান্তদের মাঝে রোগটির মারাত্মক রূপ ধারণ করার প্রবণতা, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তার প্রমাণ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বেশ কিছু দিন যাবৎ হাসপাতাল গুলো রোগীর জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে এবং মৃতের সংখ্যা অনেক দিন পর্যন্ত ২০০ এর উপরে ছিল। গত কয়েক দিন যাবত আক্রান্তের এবং মৃত্যুর হার ধীরে কমার দিকে হলেও এখনো উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি।
ভ্যারিয়্যান্টটি শিশুদের, অল্প বয়স্কব্যক্তিদের, মহিলাদের তার পূর্বসুরীর তুলনায় বেশি সংক্রমণ করে এবং তাদের পূর্বের তুলনায় মারাত্মক রোগ হওয়ার প্রবনতার, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। আর একটি দিক হচ্ছে যাদের কোন রিস্ক ফ্যাক্টর নাই এমন ব্যক্তিরাও পূর্বের তুলনায় বেশি গুরুতর অসুস্থ হচ্ছে, এমনকি অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু বরণ করছে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি এটি অধিকতর দ্রুততায় মানুষকে গুরুতর অসুস্থ করে ফেলে। বোধ করি এটাও মৃত্যুর হার বাড়ার একটি কারণ। তবে এর ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করা গেছে, কেউ কেউ লক্ষ্মণ শুরু হওয়ার ২ সপ্তাহ পরেও গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে আসে। আবার কেউ কেউ বাইপেজিক উপসর্গ নিয়ে আসে অর্থাৎ প্রথম কয়েকদিন জ্বরের পর কয়েক দিন ভালো থাকার পর আবার জ্বরের উপসর্গ নিয়ে আসে। এরা সাধারণত খুব খারাপ পর্যায়ে আসে। এই ভ্যারিয়্যান্টে জ্বরের সঙ্গে ঠান্ডা সর্দি লাগা, আংশিক নাক বন্ধ থাকা, মাথা ব্যাথার লক্ষ্মণগুলো বেশ দেখা যাচ্ছে। ফলে মানুষ এটাকে সাধারণ ঠান্ডা সর্দি জ্বর মনে করে ভূল করে থাকে। কারো কারো বমি, বমি ভাবের লক্ষ্মণগুলো প্রবল। কাশি থাকলেও তা হালকা ধরনের। তবে যারা মারাত্মক অসুস্থতার দিকে তাদের মাঝে কাশিটা হঠাৎ করে বেড়ে যায়, সকল ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে। সাময়িকভাবে গন্ধের অনুভূতির কমে যাওয়া বা লোপ পাওয়া সকল ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জ্বর, খাবার রুচি কমে যাওয়া, মুখ তেতো হওয়া এবং শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া প্রায় সবার ক্ষেত্রেই কমন।
আগে আমাদের ধারণা ছিল কোভিড শহরবাসীর বেশি হয়, গ্রামে কম হয়, ধনীদের বেশী হয়, গরীব খেটে খাওয়া মানুষদের কম হয়। ডেল্টা আমাদের প্রচলিত ধারণায়ও আঘাত হেনেছে। এখন আক্রান্তদের একটি বিরাট অংশ গ্রামের । এখানে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার চিত্রটিও একই রকম। আগের ভ্যারিয়্যান্ট এর সময় বেশীরভাগ রুগী ছিল শহর অঞ্চলের, এখন বেশীর ভাগই গ্রামের নিম্ন বিত্তের মানুষরা। আমি যে পথ দিয়ে চলি, সে পথে আমার চিহ্ন রেখে যায়। কোভিডের ক্ষেত্রে অন্তত আমাদের দেশে এই কথাটি শতভাগ সত্য। ২০২০ এর মার্চে কোভিড এসেছিল বিমানে চড়ে, তাই সঙ্গত কারণেই শহরের মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়েছে এবং শহর থেকে গ্রামে কিছুটা ছড়িয়েছে। এবার কিন্তু সে এসেছে স্থলপথে, আপন জন্মস্থান ভারত থেকে গ্রামের পথ ধরে। তাই এবার গ্রামের মানুষ ভালো ভাবেই আক্রান্ত হয়েছে । বিভিন্ন কারণে যেহেতু গ্রামের মানুষ শহর মুখী হয় তাই দ্রুত শহরে ছড়িয়েছে।
সুখের খবর টীকা কেন্দ্র গুলোতে উপচে পড়া ভীড়। এটা ভালো লক্ষণ, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে টীকা শত ভাগ সুরক্ষা দেবে না। মনে রাখতে হবে এই পৃথিবীতে শতভাগ সফল কোন চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয় নি। তাই ২ ডোজ টীকা দেওয়ার পরও কেউ কেউ আক্রান্ত হয়েছে, তবে তাদের রোগের তীব্রতা অনেক কম, গুরুতর অসুস্থ এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হারও অনেক অনেক কম। তবে সিংহভাগ টীকা গ্রহণকারী যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন ভালো আছেন। তার বড় প্রমাণ আমাদের চিকিৎসকরা। টীকা যে অনেকটা সুরক্ষা প্রদান করে সেটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হলো।
আবার টীকা যে শতভাগ সুরক্ষা দেয় না এটাও আমরা ভালো ভাবেই বুঝতে পারলাম। অতএব যতদিন হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হয় নি ততদিন আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। তা অর্জন করতে গেলে একটি দেশের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। যেহেতু পৃথিবী এখন একটি গ্লোবাল ভিলেজ, বোধ করি সারা পৃথিবীর সকল দেশের এই পরিমান মানুষকে টীকার আওতায় আনতেই হবে। তাই উন্নত দেশগুলোর নিজেদের ভালো থাকার জন্যই গরীব দেশগুলোর কথা ভাবা ছাড়া আর কোন বিকল্পই থাকবে না। আশার কথা সরকারের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় এবং মানুষের মাঝে সদ্য জাগরিত হওয়া টীকা গ্রহণের তাগিদের জন্য আমরা অবশ্যই দ্রুত এগিয়ে যাব।
এতক্ষন যা লিখলাম বোধ করি সকলই কম বেশি জানেন। তবে আজকের উদ্দেশ্য একটু ভিন্ন। আমি সাধারণ মানুষের কথাই বলছি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, মানুষ তার করোনা হয়েছে বা হতে পারে তা মনে করেন না। তিনি তার অসুস্থতাকে অন্য কোন কারণের সাথে সম্পর্কিত করতে চান। যেমন—" আমি গতকাল বৃষ্টিতে ভিজেছি", "আমি আজ একটু বেশি পরিশ্রম করেছি", "আমি গতকাল রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেছি " "তাই আমার একটু ঠান্ডা জ্বর হয়েছে"। এমনকি কেউ কেউ এমনও বলেছে—আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি, তার প্রতিক্রিয়ায় একটু ঠান্ডা সর্দি লেগেছে আর কি, তেমন কিছু না। " এমনকি মারাত্মক কোভিড নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত রোগীরাও রোগের ইতিহাস নেওয়ার মাঝখানে থামিয়ে বলেন — "না না আমার কোভিড টেষ্ট নেগেটিভ, করোনা হতে পারে না "। আসলে প্রকৃত করোনা রোগীর টেস্টও শতকরা ৪০ ভাগ সংগত কারণেই নেগেটিভ হতে পারে। আর ঠান্ডা জ্বরের কথাই ধরুন না, করোনা ভাইরাসের শুরুটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরকম হতে পারে। যদি বর্তমানে দাড়িয়ে পিছনে ফিরে দেখি, বর্তমানের এই ভাইরাসটি তার সপ্তম জেনারেশন। প্রথম ৪ টি জেনারেশন ১৯৬০ সাল থেকেই সাধারণ সর্দি কাশ জ্বর করে আসছিল, সাধারণত অন্য কোন জটিলতা করতো না। ৫ম এবং ৬ষ্টটি যথাক্রমে সার্চ এবং মার্চ রোগের জন্য দায়ী। তাদের সনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ছিল এখন থেকে অনেক বেশি, যথাক্রমে ৩℅ এবং ৩৫℅ । কিন্তু সীমিত পর্যায়ের এপিডেমিক হওয়ায় আমাদের খুব একটা ক্ষতি করতে পারে নি, যা করে যাচ্ছে বর্তমান ভাইরাসটি সার্স-কভ-২ যার নাম। যা বলছিলাম তার প্রথম চার পূর্ব পুরুষের মতই সাধারণ ঠান্ডা জ্বর দিয়ে যাত্রা শুরু করে। ব্যতিক্রম হলো কারো কারো ক্ষেত্রে এটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। কার ক্ষেত্রে এটা ঘটবে এটা পূর্ব থেকেই অনুমান করা যায় না।সূতরাং এই সময়ে জ্বর হলেই কোভিডের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধু জ্বরের উপসর্গই নিয়েই আমাদের কাছে খারাপ অবস্থায় এসেছে। অন্য উপসর্গও ছিল। তা তারা বুঝতেই পারেন নি।
হঠাৎ করে কাশ বেড়ে যাওয়া, তার সঙ্গে শ্বাস কষ্ট হওয়া একটি খারাপ লক্ষ্মণ। কিন্তু আশ্বর্যের ব্যাপারটি তো ঐ জায়গায়ই, অক্সিজেন লেভেল কমেও গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীর শ্বাস কষ্টের অনুভূতিটা থাকে না। যখন বুঝতে পারেন তখন অনেক দেরী হয়ে যায়।
যাই হোক অন্য উপসর্গের পাশাপাশি ৩ টি লক্ষ্মণ/ উপসর্গকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এর যে কোন একটি হলেই হাসপাতালের শরনাপন্ন হতে হবে। ১ম টি হচ্ছে শ্বাসকষ্ট, আগেই বলেছি অনেক ক্ষেত্রেই রোগী তা বুঝতেই পারে না। ২য় টি হলো পাল্স অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন লেভেল মনিটর করা। এর স্বাভাবিক মাত্রা হলো ৯৫% থেকে ১০০%। এর নীচে গেলেই ডাক্তারের বা হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হবে। ৩য়টি হলো শ্বাস নেওয়ার গতি। একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির তা সাধারণত ১৪ থেকে ২০ বার। করোনার ক্ষেত্রে ২১ থেকে ৩০ বার হলে মাঝা মাঝি খারাপ এবং ৩০ এর তার বেশি হলে খুব খারাপ। আার পাশাপাশি এটাও দেখতে হবে একজন শ্বাস কষ্টের রোগীর শ্বাস নেওয়ার সময় পেট বেশি উঠানামা করবে এবং বিউটি বোন ও বুকের মাঝখানের বড় হাড়ের (Sternum) উপরের গলার অংশ বেশি বেশি ডেবে যাবে। আপনাদের বুঝার জন্য নীচে ভিডিও সংযোজন করা হলো।
পরিশেষে এটাই বলতে চাই, আমাদেরকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে, টীকাও নিতে হবে এবং করোনা হলে ভয়ও পাওয়া যাবে না। ৯৮ % এর বেশি মানুষ ভালো হয়ে যায়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সময়মত এবং সঠিক ভাবে মনিটর করলে বিপদের সম্ভাবনা খুবই কম। শুধু খারাপ হওয়ার লক্ষ্মণগুলো বুঝে সময়মত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে অনেক বিপদ এড়ানো যাবে।