18/10/2025
গুম........
কানাডায় বসে ব্যারিস্টার আরমানের দুর্বিষহ গুমজীবনের ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত 'আয়নাঘর ফাইলস এপিসোড ২' দেখছিলাম। জীবনে এরচেয়ে ভয়ংকর কিছু দেখেছি বলে মনে হয় না। আমার ছোট ছেলে অষ্টম গ্রেডে পড়ে। সে এখন কানাডা'র নাগরিক। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তার তেমন কোনো ধারনাই নেই। সে অনলাইনে খাবারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষায় ছিলো। রাত্রে সে প্রায়ই বাইর থেকে এনে খায় এবং এ খাওয়াটা সে বেশ এনজয় করে । বাংলাদেশের প্রোগ্রামগুলো তার তেমন দেখা হয় না। খাবার আস্ তে দেরী হচ্ছিল, এই ফাকে আমার পাশে বসে সে কিছুক্ষণ ডকুমেন্টারিটি দেখছিল। ব্যারিস্টার আরমান এর দিকে ইশারা করে ও জিজ্ঞেস করল, Who is he? Serial killer? আমি হ্যাঁ-না কিছু বলে স্তম্ভিত হয়ে ভিডিওটি দেখছিলাম। কিছুদিন আগে ও “গুম ও আয়নাঘর ‘নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি দেখেছিলাম। কী ভয়াবহ একটি ডকুমেন্টরি। আমার চোখ বার বার ভিজে উঠছিল, মাঝে মাঝেই শিউরে উঠছিলাম। বাংলাদেশ! এটাই তো আমার দেশ, আমার জন্মভূমি। এই পলিভূমিতে কিভাবে এত এত পিশাচের জন্ম হয়।
কিছুক্ষণ পর দরজায় ডোরবেলের শব্দে ছেলেটি নিচতলায় নেমে গেলো। চেয়ে দেখি, আমার ছেলেটি খাবারের প্যাকেটটি নিয়ে আবার লিভিং রুমে আসলো, তারপর টেবিলে প্যাকেটটি রেখে আমাকে বললো, আজ আমি খাবো না, আজ আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। সে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙ্গে বেড রুমে চলে গেলো।
আমি জীবনে অনেক দেশই সফর করেছি। জার্মানিতে গিয়ে নাৎসিদের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প খুব ভালোভাবে দেখেছি। কিন্তু আয়না ঘরেরর চেয়ে বিভৎস কিছু এ পৃথিবীতে দেখেছি বলে আমার মনে হয় না। সানফ্রান্সিসকোতে যতবার যাই, আল্কাট্রায আইল্যান্ড দেখতে যাই,সেই জেলখানা দেখে আসি, যেখানে ১৯ শতকের দুর্ধর্ষ কয়েদী আল কাপাণো বন্দি ছিলো। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক এ জেলখানা দেখতে আসে। আমাদের আয়নাঘরগুলো কিন্তু এ জেলখানা থেকে হাজারগুন ভয়ংকর । আয়নাঘরগুলোকে যাদুঘর বানানো হলে, দুটো কাজ হত– ১. এদেশে কেউ আর আয়নাঘর বানানোর সাহস করত না. ২. যাদুঘর দেখার জন্য দেশ বিদেশ ত্থেকে হাজারো পর্যটক আসত।
যাইহোক, আয়নাঘরের মত জীবন্ত কবরস্তান শুধু একজন ব্যক্তি মানুষের দ্বারা তৈরি হয়না। শুধু শেখ হাসিনাকে এর প্রাণভোমরা বলে এর দায় শুধু উনার উপর চাপিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলে হবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম এ নির্যাতনকেন্দ্রগুলো তৈরীর সাথে রাজনৈতিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে জড়িত রয়েছে এক বিশাল স্বার্থন্বেষী মহল। এদের মধ্যে ছিল হাজারো সরকারি চাকরিজীবি- যারা তিনটি ভুয়া ইলেকশন করে দেওয়ার পিছনের মূল চালিকাশক্তি ছিল, বিনিময়ে তাদের বেতন ভাতা ও উচ্চতর সরকারি পদপদবী অর্জিত হয়েছে। খুবই ওতপ্রতভাবে জড়িত ছিল একদল হিংস্র ও লোভী সামরিক ও বেসামারিক সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা – সরকারের জ্ঞাতসারেই তlরা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে ও এ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। এদেরকে সার্বিক সহায়তা দিয়েছে- ব্যংকে ও শেয়ারবাজার লুটেরা ব্যবসায়ী, বিশেষ সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী, বিচারপতি-আইনজীবী , বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক , দলীয় চিকিৎসক-প্রকৌশলী-কৃষিজীবীসহ পেশাজীবি এবং আরো আরো অনেকে। জেলা- উপজেলায় বিস্তৃত রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা তো সাথে ছিলই। গূম -খুন সম্বন্ধে সবাই কমবেশি জানতো। সবার সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিল ভূয়া গণতন্ত্রের আড়ালে এক জঘন্য স্বৈরাচার ও লটপাটতন্ত্র। আর এটাকে যুগ যুগ টিকিয়ে রাখার জন্যই তৈরি হয়েছিল বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ও ব্যয়বহুল নির্যাতন কেন্দ্রগুলো।
তথ্য -উপাত্ত বলছে, অপরাধ হয়েছে পাহাড় প্রমান। এতে জড়িতদের সংখ্যাও অনেক। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন কিন্তু অল্প কয়েকজন। বাকিরা মুক্ত বাতাসে আছেন। কারো কোনো অনুশোচনা নেই, বরং তাদের চিন্তাভাবনা জুড়ে আছে শুধু পুরনো নেতৃত্বকে ও পুরনো ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। যতদিন যাচ্ছে, প্রযুক্তির কল্যাণে ভয়ংকর সব কাজকামের নমুনা বের হয়ে আসছে। কিন্তু স্বৈরাচারের কর্মী- সমর্থকদের এতে তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই। এখন যদি নির্বাচন হয় ও দলটি অংশগ্রহণ করে, তবে তারা সর্বোচ্চ না হলেও ভোটের সংখ্যায় নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় স্থানে থাকবে। অবশ্য এটাই বাংলাদেশের সংস্কৃতি। ৯০ এর দশকে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পরেও দলটির সমর্থক ও কর্মীর সংখ্যা সে সময় খুব একটা কমেনি। এরশাদ সাহেবের নিজের জেলায় তো সমর্থন আরও বেড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ আসলে দুর্নীতি, লউটপাট, রাজনৈতিক অত্যাচার- হত্যা --এগুলোর এক ধরনের অনুমোদন দিয়েই রেখেছে। বড় রাজনৈতিক দল সবগুলোর ক্ষেত্রে এ কথাটা সত্যি।
যাই হোক, আবারও গুম বিষয়ে ফিরে আসি। খুনের শাস্তি কী এটা কম বেশী সবাই জানি।। কিন্তু গুমের শাস্তি কী হওয়া উচিত? সেটা আইন শাস্ত্রকে জিজ্ঞাসা না করে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসা করা উচিত । আমি আইনশাস্ত্র পড়িনি, কিন্তু মনে করি, গুমের শাস্তি খুনের চেয়ে অনেকগুন বেশী হওয়া উচিত।
গত ১৭ বছরের ঘুম খুন বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে রক্তাক্ত করছে। এর শাস্তি হোক, কঠিন থেকে কঠিনতম।
গুমের শাস্তির চেয়ে আর কোনো কঠিনতম শাস্তি মানবসমাজে থাকা উচিত নয়।
।।।।।।।।।মোহাম্মদ হাই।।।১৭।১০।২০২৫।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।