20/10/2025
আমরা অনেকেই এখন কাপিং থেরাপি বা হিজামা নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছি । অনেকেই আবার কৌতুহলি হচ্ছি কি এই কাপিং থেরাপি?
কোথায় থেকে এল ? এর ইতিহাসটাই বা কি ?
আমরা চেষ্টা করব কাপিং থেরাপির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরতে।
বর্তমানে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই কাপিং থেরাপি বেশ জনপ্রিয়। সৌদী, মিশর,মালয়শিয়া সিংগাপুর কিংবা চীনে যেমন চলছে ; তেমনি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নরওয়ে ডেনমার্কের মত দেশেও সগৌরবে চলছে এই চিকিৎসা।
ডেনমার্ক এবং নরওয়েতে ইতোমধ্যেই প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে কমবাইন্ড ট্রিটমেন্টও গুরুত্বের সাথেই নিয়েছে।
শুধু কাপিং থেরাপি নয়, জরিপ বলে অস্ট্রেলিয়াতে বর্তমানে প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীদের সব ধরনের ট্রেডিশনাল চিকিৎসা গ্রহণের হারও বেশ অবাক করার মতন এবং যা দিন দিন বাড়ছে!
কাপিং নিয়ে সাম্প্রতিক হুলস্থূলের সূত্রপাত হয় গত অলিম্পিকে মাইকেল ফিলিপ্সের কাপিং মার্কের ছবি ভাইরাল হবার পর থেকে। এছাড়াও সে বছর আরো অনেক এথলেটিকের গায়ে কাপিং মার্ক নিয়ে মঞ্চে উঠতে দেখা গেছে।
খোদ কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রোডু কাপিং থেরাপি নিতে দেখা যায় , ফুটবলার নেইমার, ক্রিকেটার ভিরাট কোহলি, অভিনেত্রী জেনিফার এনিস্টন, গায়ক জাস্টিন বিবার - মোটামুটি সব শাখার সেলিব্রেটিরাই কাপিং এর অবিশ্বাস্য ফলাফল দেখে নিজেকে কাপিংয়ে সঁপে দিতে পিছপা হননি !
এটা কতটা সায়েন্টেফিক এবং কতটা উপকারী তা জানার পর কেউই আর সময় নষ্ট করতে চাননি।
তাই বিভিন্ন রিসার্চে কাপিং একের পর এক আলোড়ন তুলে চলেছে। সম্প্রতি হারভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মারাত্মক ব্যাথা এবং বাচ্চাদের দীর্ঘমেয়াদী রোগের মত জটিল পরিস্তিতিতে কাপিং থেরাপি এবং আকুপাংচার অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর !
দেশে দেশে কাপিং থেরাপির আজ জয়জয়কার। এর শুরুটা কোথায়? অনেকেই মনে করেন মহানবী (সাঃ) এই চিকিৎসা পদ্ধতি প্রবর্তন করেছেন। ধারনাটা সঠিক নয়। রাসূল (সঃ) তৎকালীন সময়ে প্রচলিত এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে তাঁর উম্মাহর জন্যে 'অনুমোদন' দিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলে গিয়েছেন, এটা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি।
নবী করিম সাঃ বলেছেন তোমরা চিকিৎসার জন্য যত উপায় অবলম্বন কর তার মধ্যে হিজামা কাপিং থেরাপি সর্বওম চিকিৎসা পদ্ধতি।
মানব সভ্যতার এক অনন্য আবিষ্কার এই কাপিং থেরাপি। কিন্তু কারা কবে প্রথম এই পদ্ধতির অবতারণা করেছেন তা পরিষ্কারভাবে বলা মুশকিল। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর নিদর্শন ঘেটে আমরা বহু কাল আগে থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন জাতিতে এর প্রচলন দেখতে পাই।
'অসিরীয়' নামে এক জাতি বাস করত টাইগ্রিস নদীর তীরে। সে প্রায় হযরত ঈশা (আঃ) এর জন্মের ৩৫০০ বছর আগের কথ। মানে হচ্ছে এখন থেকে প্রায় ৫৫০০ বছর আগের কথা। আরব ঐতিহাসিকদের মতে, এরাই প্রথম আরবদের মধ্যে কাপিং এর প্রচলন করে।
আরবরা কাপিং থেরাপির নাম দিল আল হিজামা। যার অর্থ দাঁড়ায়, কোন কিছুকে তার প্রকৃত অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া। হিজামা হিজম শব্দ থেকে এসেছে যার বাংলা অর্থ দারায় রক্তক্ষোম তারা, উচ্চ রক্তচাপ, পলিসাইথেমিয়া, মাথা ব্যাথা, মাইগ্রেন বিভিন্ন প্রকার বিষক্রিয়ার চিকিৎসায় কাপিং থেরাপি ব্যাবহার করত। আমরা এখন জানি বর্তমানে হসপিটালগুলোতে ভেনিসেকশানের মাধ্যমে পলিসাইথেমিয়ার চিকিৎসা করা হয়।
বহু প্রাচীন সভ্যতার চারণভূমি ছিল মিশর। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৫০ সালেও সেখানে কাপিং থেরাপির প্রচলন ছিল বলে প্রমান পাওয়া যায়। প্যাপিরাস পাতায় এবং বিভিন্ন শিলালিপি থেকে প্রমান পাওয়া যায়, সে সময়ই মিশরীয়রা কাপিং থেরাপিতে বেশ উন্নত ছিল।
চাইনিজদের মধ্যে জি-হং(২৮১-৩৮১ খ্রিষ্টপূর্ব) হচ্ছেন এই কাপিং থেরাপির পথিকৃৎ। সেই থেকেই চাইনিজরা কাপিং থেরাপির চর্চা করে আসছে। সেই থেকে আজ প্রায় ২৫০০ বছর অব্দি এই কাপিং থেরাপি Traditional Chinese medicine এর অংশ হয়ে আছে। এবং ১৯৫০ সাল থেকে চীনের হাসপাতালগুলোতে এই কাপিং থেরাপি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই করা হচ্ছে।
প্রাচিন সভ্যতার আরেক লীলাভূমি গ্রিস সেখানে ও কাপিং থেরাপির প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ সালে, হেরডটাস- যিনি একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক, তার লেখা থেকে জানা যায়, তখনকার সময় সেখানে মিশরীয় ডাক্তাররা চিকিৎসার জন্য ড্রাই কাপিং এবং ওয়েট কাপিং ব্যাবহার করতেন। এর মাধ্যমে তারা মাথা ব্যাথা, ক্ষুধামন্দা, বদহজম, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, ফোঁড়া পরিষ্কার করা, দিনভর ঘুম ঘুম ভাব ইত্যাদি সমস্যার চিকিৎসা করতেন।
প্রাচীন মেসেডনিয়াতে খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০০ সালেও এর প্রচলন ছিল। এবং জানা যায়, তারা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই বিভিন্ন সমস্যার জন্য ব্যাবহার করে আসছিল।
মে'রাজের রাতে ফেরেশতারা যখন রাসূল (সাঃ) কে তার উম্মাতকে হিজামা করার জন্যে উপদেশ দিতে বললেন, তখন থেকে সুন্নাহ হিসেবে মুসলমানদের মাঝে এর প্রচলন শুরু হয় ব্যপক ভাবে !
ইবনে সিনা (৯৮০ - ১০৩৭ খ্রীস্টাব্দ) ছিলেন একাধারে প্রসিদ্ধ ইসলামিক দার্শনিক, স্কলার ও কবি, অন্যদিকে ছিলেন ইতিহাস বরেন্য চিকিৎসক। মনোরোগবিদ হিসেবে তার বিশেষ সুনাম ছিল।
তাঁর লেখা 'The Canon of Medicine' সারা বিশ্বে টেক্সটবুক হিসেবে ব্যবহৃত হত।
হিজামার উল্লেখ তিনি তার সেই বইয়ে উল্লেখ করেছেন। মজার ব্যাপার ইবনে সিনা হিজামা বা ওয়েট কাপিং এবং ড্রাই কাপিং দুটোর ব্যবহারকেই উদ্বুদ্ধ করেছেন। বিশেষ করে রোগ প্রতিরোধক, রক্ত পরিশুদ্ধিকারক এবং Deep Tissue Inflammation এর ক্ষেত্রে তিনি হিজামার উপকারিতার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন।
আরেক প্রসিদ্ধ চিকিৎসক আল রাজি( ৮৬৫ - ৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ) হিজামা এবং ড্রাই কাপিং কে ট্রেডিশনাল চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
মানব সভ্যতার গোড়ার দিকে যেমন কাপিং থেরাপি ছিল, মানব সভ্যতা যখন উন্নতির চরম শিখড়ে উঠে যাচ্ছে, তখনও কাপিং থেরাপি একইভাবে কার্যকর। মানব সভ্যতার মহান এই আবিষ্কারকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে কাপিং থেরাপি বা হিজামার আরো নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে এই প্রত্যাশা করছি।
প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন: ০১৯৮৮-৩৭০৬৫৩ ( ইমু)💬