14/09/2025
তিন বন্ধু
সন্ধে নামছে।
আকাশজোড়া মেঘ, ঝুপঝুপ করে নামছে বৃষ্টি। রাস্তার বাতি গলে পড়েছে জলের ধারায়, কোথাও জমে আছে ছোট্ট ছোট্ট পুকুর। আগরতলার পুরোনো রাস্তায় সেই চায়ের দোকানটা আজও টিকে আছে—টিনের ছাউনি, কড়াইতে শিঙাড়া ভাজার শব্দ, আর ভেতরে ভেজা কেরোসিনের গন্ধ।
বহু বছর পর তিনজন পুরোনো বন্ধু মুখোমুখি হলো—আবির, ভোম্বল আর প্রথম।স্কুলের বেঞ্চে একসাথে বসত তারা, আজ জীবন তাদের ছড়িয়ে দিয়েছে তিন আলাদা পথে।
প্রথম এখন ডাক্তার। বহু বছর রাজ্যের বাইরে কাটিয়েছে, কাজ আর পড়াশোনার চাপে পুরোনো বন্ধুদের থেকে দূরে চলে গেছে।
আবির রোগা, গায়ে হাড়গোড় স্পষ্ট। সেলাই মেশিন চালিয়ে সংসার টেনে নিয়ে যায়,প্রতিদিনের লড়াই যেন তার শরীরে লিখে রেখেছে দাগ।
আর ভোম্বল—গায়ে মোটা চেহারা, হেঁটে উঠলেই হাঁপ ধরে, অথচ মুখে হাসি লেগেই থাকে। বাবার জমিজমা আর ভাড়ার টাকায় তার জীবনে কোনো অভাব নেই।
বৃষ্টির ফোঁটা টিনের ছাউনি পিটিয়ে চলেছে। দোকানিরা কাপে কাপে চা তুলে দিচ্ছে।
অর্ডার এল। আবির বলল——“চিনিটা দিও না।”
ভোম্বল হো হো করে হেসে উঠল——“আমারটায় কিন্তু বাড়িয়ে দিও। আমাকে তো কিছু হয় না।”
আবির কপাল কুঁচকে চা নামিয়ে রাখল।—“ভাবো তো, আমি খেটে খাই, মিষ্টি ছুঁই না। তবুও ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। আর ভোম্বল, যে সারাদিন ভাজাভুজি, কোল্ড ড্রিঙ্কস, মিষ্টি খায়, তার আবার কিছুই হয় না!”
বৃষ্টির শব্দের ভেতরে প্রথম মৃদু গলায় বলল—
“সবটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। শরীরের ভেতরে থাকে অদৃশ্য লেখা—আমাদের জিন। কারো ভেতরে FTO নামের জিন থাকে, যা ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয়। কেউ খাওয়ার পরও পূর্ণতা পায় না। আবার MC4R-এর ত্রুটি থাকলে ছোট থেকেই মোটা হওয়ার ঝোঁক আসে। আর কেউ কেউ রোগা থেকেও জিনগত কারণে ডায়াবেটিসে ভুগে। আবির, তোমার দোষ নেই। এটা তোমার জন্মের সঙ্গে আসা লেখা।”
আবির চুপ করে শুনছিল। চোখে যেন হালকা ভেজা স্বস্তি নেমে এলো।
ভোম্বল চা নেড়ে হেসে বলল——“তাহলে আমি ভাগ্যবান?”
প্রথম এবার গলাটা একটু শক্ত করল—
“এখন হয়তো। কিন্তু মনে রেখো ভোম্বল, স্থূলতা নিজেই একটা রোগ। আজ তুমি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নও, কিন্তু তোমার ওজন যেভাবে বাড়ছে, তাতে বিপদ তোমাকেও ঘিরে ধরতে পারে। আমাদের জীবন বদলে গেছে—আগের দিনে খাওয়া হতো মাছ-ভাত, শাকপাতা, মাটির হেঁসেলে রান্না। এখনকার দিনে ফাস্টফুড, তেলেভাজা, সফটড্রিঙ্কস শরীরে জমাচ্ছে অতিরিক্ত ক্যালোরি। এগুলো একদিন না একদিন হিসেব মিটিয়েই ছাড়বে।”
ভোম্বল চুপ করে বসে রইল। বৃষ্টির ফোঁটা ছাউনির ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে নামছে, আর তার চোখে যেন প্রথমবার একটু ভয় নেমে এলো।
প্রথম আবার ধীরে বলল—
“তবে আশা আছে। চিকিৎসা এগোচ্ছে। সেমাগ্লুটাইড এসেছে—সপ্তাহে একবার নিলে ক্ষুধা কমে, ওজন গড়ে ১৫% পর্যন্ত ঝরে। সামনে আসছে তিরজেপাটাইড, আরও শক্তিশালী প্রমাণ নিয়ে। বিরল জেনেটিক স্থূলতার জন্য আছে সেটমেলানোটাইড। বিজ্ঞান চেষ্টা করছে জিনের লেখা পাল্টে দেওয়ার।”
বৃষ্টি তখনও থামেনি। দোকানের আলো কাঁচের ভেতরে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
আবির তাকিয়ে আছে বন্ধুর দিকে, চোখে একরাশ আশার আভা।
ভোম্বল নিঃশব্দে কাপ নেড়ে যাচ্ছে, যেন বুঝতে পারছে—হাসিখুশি শরীরের আড়ালে জমে আছে অজানা ঝড়।
আর প্রথম জানে—
স্থূলতা আর ডায়াবেটিস কোনো একদিনের খাওয়া নয়, এটা জিন, অভ্যাস আর সময়ের মিলে লেখা এক অদ্ভুত কাহিনি।
ডা পরম কর