12/08/2025
সোরিয়াসিস একটি দীর্ঘস্থায়ী ও পুনরাবৃত্তিমূলক ত্বকের রোগ, যা মূলত একটি অটোইমিউন ডিসঅর্ডার। এই রোগে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অস্বাভাবিকভাবে সক্রিয় হয়ে ত্বকের কোষ বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়। সাধারণ অবস্থায় ত্বকের নতুন কোষ তৈরি ও পুরনো কোষ ঝরে যেতে প্রায় ২৮ দিন সময় লাগে, কিন্তু সোরিয়াসিসে এই প্রক্রিয়া মাত্র ৩–৪ দিনে ঘটে যায়। ফলে পুরনো কোষ উঠে যাওয়ার আগেই নতুন কোষ তৈরি হয়ে ত্বকের উপরিভাগে জমে যায় এবং সিলভারি বা সাদা আঁশযুক্ত মোটা দাগ তৈরি করে। এই দাগ সাধারণত লালচে বেসের উপর হয় এবং চুলকানি, জ্বালা বা ব্যথা থাকতে পারে। সোরিয়াসিস সংক্রামক নয়, তবে এর প্রকোপ শীতকালে বা ঠান্ডা আবহাওয়ায় বেড়ে যেতে পারে।
রোগের প্রকোপে বংশগত প্রভাব একটি বড় ভূমিকা রাখে। পরিবারের কারো সোরিয়াসিস থাকলে অন্য সদস্যদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়া মানসিক চাপ, ঠান্ডা আবহাওয়া, ত্বকের আঘাত, কিছু ওষুধ যেমন বিটা ব্লকার, লিথিয়াম বা অ্যান্টিম্যালেরিয়াল, এবং গলা বা ত্বকের সংক্রমণ রোগের সূত্রপাত বা বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। সোরিয়াসিসের বিভিন্ন ধরন রয়েছে—সবচেয়ে সাধারণ হলো Plaque Psoriasis, যেখানে লালচে, মোটা প্ল্যাক ও সিলভারি স্কেল দেখা যায়। এছাড়া Guttate, Inverse, Pustular ও Erythrodermic ফর্মও রয়েছে, যেগুলো উপসর্গের তীব্রতা ও বিস্তৃতি অনুযায়ী ভিন্ন হয়।
হোমিওপ্যাথিতে সোরিয়াসিসের চিকিৎসা মূলত রোগীর সামগ্রিক অবস্থা, মানসিক-শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং জীবনযাত্রার ধরণ বিবেচনা করে করা হয়। এখানে কেবল ত্বকের বাহ্যিক দাগের চিকিৎসা নয়, বরং ভেতরের রোগ প্রবণতা (diathesis) দূর করার চেষ্টা করা হয়। সঠিকভাবে নির্বাচন করা ওষুধ রোগীর ইমিউন সিস্টেমকে স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদে রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং পুনরাবৃত্তি কমে যায়। প্রতিটি রোগীর ক্ষেত্রে উপসর্গ ভিন্ন হওয়ায় ওষুধও ভিন্ন হয়—কারও ক্ষেত্রে তীব্র চুলকানি ও জ্বালা রাতে বেশি হয়, কারও ক্ষেত্রে স্কেল ঘন ও ফাটলযুক্ত, আবার কারও ক্ষেত্রে ঠান্ডায় উপসর্গ বেড়ে যায়। এসব সূক্ষ্ম পার্থক্যই ওষুধ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু সহায়ক ব্যবস্থা খুবই প্রয়োজনীয়। রোগীকে পরামর্শ দেওয়া হয় যেন তিনি ঝাল-মশলাযুক্ত, ভাজা-তেলে ভাজা খাবার ও অ্যালকোহল পরিহার করেন, পর্যাপ্ত পানি পান করেন, এবং ত্বকে আর্দ্রতা বজায় রাখতে কেমিক্যাল-ফ্রি ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করেন। ধুলাবালি ও অতিরিক্ত রোদ এড়িয়ে চলা, এবং মানসিক চাপ কমানোর জন্য যোগব্যায়াম বা মেডিটেশন করাও উপকারী। চিকিৎসার সময়কাল রোগের পুরনো অবস্থা ও তীব্রতার উপর নির্ভর করে—তীব্র কেসে কয়েক মাসে উন্নতি দেখা যেতে পারে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী কেসে ছয় মাস থেকে এক বছর বা তার বেশি সময় লাগতে পারে।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় উন্নতির ধাপ সাধারণত প্রথমে চুলকানি কমা, এরপর স্কেল পাতলা হওয়া, তারপর লালভাব কমে গিয়ে স্বাভাবিক ত্বক ফিরে আসা। সঠিকভাবে এবং নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে গেলে সোরিয়াসিস দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, যা রোগীকে ওষুধের ওপর নির্ভরশীলতা ছাড়াই একটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সাহায্য করে।
৷৷ ৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷ ।।।।।।।।।।।।।
সোরিয়াসিসে ব্যবহৃত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের পূর্ণ বিবরণঃ
---
1. Arsenicum Album
এটি সোরিয়াসিসে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত একটি ওষুধ, বিশেষত যখন ত্বক শুকনো, আঁশযুক্ত ও লালচে বেসে থাকে এবং চুলকানি ও জ্বালা খুব বেশি হয়। উপসর্গ সাধারণত রাতের দিকে বেড়ে যায় এবং গরমে সামান্য আরাম হয়। রোগী সাধারণত অস্থির স্বভাবের হয়, উদ্বেগ বেশি থাকে এবং সবকিছু পরিপাটি রাখতে পছন্দ করে। ক্ষুধা কম, কিন্তু বারবার পানি খেতে চায়, অল্প অল্প করে। ত্বকের ক্ষত ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক সময় গরম কাপড় বা গরম বাতাসে কিছুটা আরাম মেলে।
2. Graphites
যেসব রোগীর ত্বকে মোটা, ফাটলযুক্ত দাগ হয় এবং ফাটল থেকে আঠালো হলুদ স্রাব বের হয়, তাদের ক্ষেত্রে এই ওষুধ উপকারী। রোগী সাধারণত স্থূলকায়, ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না, কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রবণতা থাকে এবং ত্বক শুষ্ক হয়। সোরিয়াসিসে যদি ত্বক রুক্ষ, মোটা স্কেলযুক্ত হয় এবং ভেতরে ভেতরে চুলকানি থাকে তবে Graphites ভালো ফল দেয়। অনেক সময় আক্রান্ত স্থানে ব্যথা ও প্রদাহ থাকে, যা রাতে বাড়তে পারে।
3. Sulphur
এটি “King of Skin Remedies” নামে পরিচিত। ত্বক লালচে, চুলকানি ও গরমে বেড়ে যাওয়া এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। রোগী সাধারণত গরম সহ্য করতে পারে না, বিশেষত বিছানায় ঢোকার পর চুলকানি বেড়ে যায়। খোঁচালে রক্ত পড়তে পারে। ত্বক খসখসে, সাদা আঁশযুক্ত এবং স্কেল পড়লে নিচে লাল গরম বেস দেখা যায়। রোগী অগোছালো ও অলস স্বভাবের হতে পারে, কিন্তু মানসিকভাবে চটপটে।
4. Psorinum
সোরিয়াসিসের ক্ষেত্রে যখন উপসর্গ ঠান্ডায় বেড়ে যায়, ত্বক তৈলাক্ত ও ময়লাযুক্ত থাকে এবং চুলকানি তীব্র হয়—তখন Psorinum কার্যকর। রোগী সাধারণত দুর্বল, হতাশাগ্রস্ত এবং ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। চুলকানি রাতে বেশি হয় এবং চুলকানোর ফলে ক্ষতস্থান সংক্রমিত হতে পারে। এই ওষুধে রোগীর ক্ষুধা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় বা সম্পূর্ণ কমে যেতে পারে।
5. Mezereum
এটি তখন ব্যবহার হয় যখন ত্বকে ঘন স্কেল থাকে, চুলকালে রক্ত বা পুঁজ বের হয় এবং আক্রান্ত স্থান অতিরিক্ত সংবেদনশীল থাকে। রোগীর শীত সহ্য করার ক্ষমতা কম এবং ঠান্ডা বাতাসে উপসর্গ বেড়ে যায়। অনেক সময় প্ল্যাকের নিচে কাঁচা মাংসের মতো লাল ভাব দেখা যায় এবং চুলকানির সঙ্গে জ্বালা থাকে।
6. Sepia
বিশেষত নারীদের সোরিয়াসিসে ভালো ফল দেয়, যখন হরমোনাল ইমব্যালেন্স (গর্ভধারণ, মেনোপজ বা মাসিকের অনিয়ম) এর সাথে রোগ শুরু হয় বা বেড়ে যায়। ত্বক শুষ্ক, খসখসে ও বাদামি দাগযুক্ত হতে পারে। রোগী মানসিকভাবে উদাসীন, গৃহকর্ম বা পরিবারের প্রতি অনাগ্রহী হয়, ঠান্ডা ও গরম দুই ধরনের আবহাওয়াতেই অস্বস্তি অনুভব করে।
7. Kali Arsenicosum
এটি পুরনো, দীর্ঘস্থায়ী সোরিয়াসিসে কার্যকর, বিশেষত যখন দাগের বেস গাঢ় লাল হয় এবং ধীরে ধীরে ছড়ায়। চুলকানি ও জ্বালা থাকে, যা সাধারণত রাতে বেড়ে যায়। রোগী দুর্বল ও শীর্ণকায় হতে পারে, এবং ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না।
8. Natrum Muriaticum
যখন মানসিক আঘাত, শোক বা হতাশার পর সোরিয়াসিস শুরু হয়, তখন এটি কার্যকর। ত্বক শুষ্ক, ফাটলযুক্ত এবং স্কেল পড়লে নিচে কাঁচা মাংসের মতো দেখা যায়। রোগী সাধারণত সংবেদনশীল, চুপচাপ ও একাকী থাকতে পছন্দ করে। উপসর্গ রোদে বেড়ে যেতে পারে।