06/11/2025
*হৃদরোগ প্রতিরোধ: কি ও কিভাবে করবেন*
হৃদরোগ হলো আজকের দিনে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তবে সুখবর হলো, অধিকাংশ হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিছু সহজ জীবনধারার পরিবর্তন এবং সচেতনতা আপনাকে হৃদরোগ থেকে রক্ষা করতে পারে এবং দীর্ঘ, সুস্থ জীবন উপহার দিতে পারে।
এই লেখায় আমরা খুব সহজ ভাষায় জানবো কীভাবে হৃদরোগ হয়, কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কিভাবে আপনি সহজ পদ্ধতিতে এটি প্রতিরোধ করতে পারেন —
*হৃদরোগ কী?*
সবচেয়ে সাধারণ ধরনের হৃদরোগ হলো করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ, যেখানে হৃদপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালীগুলো চর্বি বা কোলেস্টেরল জমে সরু বা বন্ধ হয়ে যায়।
এর ফলে হতে পারে:
*বুকে ব্যথা (অ্যাঞ্জাইনা)*
*হার্ট অ্যাটাক*
*হার্ট ফেইলিউর*
*আপনার জানার প্রয়োজন কেন?*
হৃদরোগ শুধু বৃদ্ধদের নয় — এটি যেকোনো বয়সের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। আপনার জীবনের প্রথম থেকেই যেসব খারাপ অভ্যাস (যেমন অনিয়ন্ত্রিত খাওয়া, ধূমপান, অনুশীলনের অভাব, স্ট্রেস) থাকে, তা একসময় বড় সমস্যায় রূপ নেয়।
হৃদরোগ শুধু আপনার শরীরকেই নয়, প্রভাব ফেলে আপনার পরিবার, মানসিক অবস্থা, আর্থিক অবস্থা এবং জীবনের আনন্দের ওপর।
*কারা হৃদরোগে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?*
• উচ্চ রক্তচাপ আছে এমন ব্যক্তি
• ডায়াবেটিস আছে যাঁদের
• উচ্চ কোলেস্টেরল
• ধূমপায়ী
• মোটা বা স্থূল ব্যক্তিরা
• যাঁদের পারিবারিক ইতিহাস আছে হৃদরোগের
• যাঁরা ব্যায়াম করেন না বা সেডেন্টারি লাইফস্টাইল অনুসরণ করেন
• যাঁরা অস্বাস্থ্যকর খাবার খান
• যাঁরা চাপ ও স্ট্রেসে থাকেন
তবে চিন্তার কিছু নেই—এই ঝুঁকিগুলোর অনেকগুলোই নিয়ন্ত্রণযোগ্য ও প্রতিরোধযোগ্য।
*হৃদরোগ প্রতিরোধের উপায়*
*১. হৃদয়বান্ধব খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন*
আপনার খাওয়া-দাওয়া আপনার হৃদয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
*✓ কী খাবেন:*
• প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল
• পূর্ণ শস্য (যেমন ব্রাউন রাইস, আটার রুটি)
• চর্বিহীন প্রোটিন (মাছ, মুরগি, ডাল)
• ভালো চর্বি (যেমন অলিভ অয়েল, বাদাম, তিল)
• লো-ফ্যাট দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
*X* এড়িয়ে চলুন:*
• ভাজা ও তেলচিটচিটে খাবার
• মিষ্টি পানীয় (সফট ড্রিংক, প্যাকেটের জুস)
• অতিরিক্ত লবণ
• চিপস, চানাচুর, প্যাকেটজাত খাবার
• প্রসেসড মাংস (সসেজ, বেকন)
ঘরে রান্না করা খাবার খান এবং প্যাকেটের গায়ে উপাদানের লেবেল ও উৎপাদনের তারিখ পড়ে কিনুন।
*২. নিয়মিত ব্যায়াম করুন*
শরীরচর্চা করতে হলে জিমে যেতে হবে এমন নয়। প্রতিদিন মাত্র ৩০ মিনিট হাঁটলেও আপনার হৃদয় উপকৃত হয়।
যেমন:
•দ্রুত হাঁটা
• সাইকেল চালানো
• সাঁতার কাটা
• নাচ
• যোগব্যায়াম
• লিফট এড়িয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
• বাড়িতে বসেও হাত-পা নড়াচড়া করুন।
*৩. ধূমপান বন্ধ করুন*
ধূমপান হৃদয়ের রক্তনালিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, রক্তচাপ বাড়ায়, এবং রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এমনকি অন্যের ধোঁয়া শ্বাসে নিলেও ক্ষতি হয়।
ধূমপান ছেড়ে আপনি নিজের ও পরিবারের সুস্থতা নিশ্চিত করুন।
*৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন*
অতিরিক্ত ওজন হৃদয়ের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে এবং ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল বাড়ায়।
মাত্র ৫-১০% ওজন কমালেই ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়।
*৫. রক্তচাপ, রক্তে শর্করা ও কোলেস্টেরল পরীক্ষা করুন*
এই তিনটি বিষয় — রক্তচাপ, সুগার ও কোলেস্টেরল — প্রায়ই লুকিয়ে থাকে। উপসর্গ না থাকলেও ক্ষতি করে। *নিঃশব্দ ঘাতককারী*।
সুতরাং বয়স ৩৫ পেরোলেই বছরে ১–২ বার এই পরীক্ষাগুলো করুন।
*৬. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন*
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ হৃদপিণ্ডের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
*চাপ কমাতে পারেন:*
• মেডিটেশন বা ধ্যানের মাধ্যমে
• যোগব্যায়াম ও হালকা ব্যায়ামের মাধ্যমে
• প্রিয়জনের সাথে কথা বলে
• সময়মতো ঘুমিয়ে (প্রতিদিন ৭–৮ ঘণ্টা)
৭. *অ্যালকোহল সীমিত করুন*
• অতিরিক্ত মদ্যপান রক্তচাপ বাড়ায় ও হৃদয় দুর্বল করে।
• মদ্যপান না করায় ভাল তবে করলে সীমায় রাখুন:
• পুরুষ: দিনে সর্বোচ্চ ২ পেগ
• নারী: দিনে সর্বোচ্চ ১ পেগ (৩০ মিলি লিটার)
**না খেলেও চলবে — মদ্যপানের কোন দরকার নেই।*
*
*পরিবার ও সমাজের ভূমিকা*
✓ হৃদরোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
✓ ঘরে স্বাস্থ্যকর খাবার রান্না করুন
✓ একসাথে হাঁটতে বা ব্যায়াম করতে বের হোন
✓ সমাজে যোগব্যায়াম বা হাঁটার গ্রুপ গঠন করুন
✓ অতিথিদের তেলে ভাজা, মিষ্টি খাবারের বদলে ফল দিন।
✓ পরিবারের সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে উৎসাহ দিন
*সাধারণ কিছু ভুল ধারণা/মিথ*
❌ মিথ ১: কেবল বয়স্কদেরই হৃদরোগ হয়
✅ সত্য: হৃদরোগ যেকোনো বয়সেই হতে পারে
❌ মিথ ২: আমি সুস্থ বোধ করছি, তাই আমার হৃদয়ও ভালো
✅ সত্য: উচ্চ রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলের কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে
❌ মিথ ৩: পরিবারে হৃদরোগ আছে, কিছু করার নেই
✅ সত্য: জীবনযাপনের পরিবর্তনে আপনি ঝুঁকি অনেকটা কমাতে পারেন
❌ মিথ ৪: আমি ব্যায়াম করি, তাই যা খুশি খেতে পারি
✅ সত্য: খারাপ খাদ্যাভ্যাস সবকিছু নষ্ট করে দিতে পারে
*কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?*
এই লক্ষণগুলো দেখলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখান:
• বুকে ব্যথা বা চাপ
• হাঁটলে বা উঠলে শ্বাসকষ্ট
• অতিরিক্ত ক্লান্তি
• পা বা পায়ের গোঁড়ালি ফুলে যাওয়া
• বুক ধড়পড় বা অস্বাভাবিক বা দ্রুত হার্টবিট
*উপসংহার*
হৃদরোগ একেবারে প্রতিরোধযোগ্য নয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য ও প্রতিরোধযোগ্য। আপনি যদি প্রতিদিন একটু সচেতন থাকেন, হৃদয়কে ভালো রাখতে পারবেন সহজেই।
ছোট ছোট পরিবর্তন — বড় উপকার। আপনার হৃদয় প্রতিনিয়ত আপনার জন্য কাজ করছে, এবার আপনার পালা তাকে ভালো রাখার।
*হৃদয় সুস্থ রাখার কিছু সহজ টিপস*
✅ প্রতিদিন ফলমূল ও সবজি খান
✅ লবণ, চিনি ও ভাজা খাবার কম খান
✅ প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন
✅ ধূমপান বন্ধ করুন।
*ডাঃ উদাস চন্দ্র ঘোষ
৯৪৩৩০৪৪২৩৭*