04/12/2025
অনন্যা (নাম পরিবর্তিত) এখন নিজের মোবাইল খুলতে পারে না। এমনকি ফোন থেকে সামান্য আওয়াজ এলেই সে শিউরে ওঠে। একটা অজানা আতঙ্কে তার বুক ধুকপুক করে।
কবে থেকে এমন হচ্ছে, সেটা অবশ্য অনন্যা নিজেও জানে না। তবে এটুকু বলা যা পারে, এই অবস্থা একদিনে হয়নি। তিলে তিলে তৈরি হয়েছে। এমনকি নোটিফিকশনের মামুলি শব্দও এখন তার কাছে আতঙ্কের।
অনন্যার বয়স এখন ৩০। বছর দুয়েক আগে ওর ব্রেকআপ হয়েছে। দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। প্রাক্তন কাজ করত পুলিশে। বেরিয়ে আসার সময় অনন্যা ভেবেছিল―দূরত্ব মুছে দেবে সম্পর্কের সব তিক্ততা। কিন্তু তা আর হল না।
কিছুদিন পরেই অচেনা অ্যাকাউন্ট, অজানা নম্বরের কল আর কিছু মেসেজ পেয়ে অনন্যা বুঝতে পেরেছিল―আবার যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছে প্রাক্তন। অন্য নামে, অন্য পরিচয় থেকে।
যে অতীত থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছিল অনন্যা, সেই অতীতই শিকারী বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিল তার জীবন।
হঠাৎ করেই অনন্যার ফোনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। ঘনঘন মেসেজ ঢুকতে আরম্ভ করল। নতুন নম্বর, নতুন আইডি। সবটাই অচেনা, অস্পষ্ট। দিন কয়েক পরে অনন্যা ধরতে পারল কারণটা। তার ফোন নম্বর প্রকাশ করে দিয়েছে প্রাক্তন প্রেমিক। ফলে এখন ব্যক্তিগত বলে আর কোনোকিছুই তার নেই।
এতকিছুর পরেও শক্ত ছিল অনন্যা। কারণ অনলাইনের একজন আলাপী তার কাছে হয়ে উঠেছিল একঝলক শান্তির বাতাস। দিনে ছেলেটির সঙ্গে অল্পক্ষণই কথা হত। সামান্য সময়ের জন্য হলেও এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বাঁচত অনন্যা।
কিন্তু বিধি বাম। জল কিছুদূর গড়াতেই সে আবিষ্কার করল―এই ছেলেটিও তার প্রাক্তনের সঙ্গে যুক্ত। ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর অনলাইন আলাপীর আপাত-সংবেদী মুখোশটা খসে পড়ল। বেরিয়ে পড়ল ঢেকে রাখা দাঁত-নখ।
নানা সুক্ষ ইঙ্গিত, কখনো হুমকি, কখনো হাল্কা অশ্লীল মন্তব্য―নানাভাবে অনন্যাকে উত্যক্ত করতে শুরু করল ছেলেটি। আর নদীতে বালির বাঁধের মতোই ভেঙে পড়ল নিরাপত্তার দেওয়াল।
শেষপর্যন্ত অনন্যা অভিযোগ দায়ের করে। নম্বরগুলো ব্লক করে দেয়। অচেনা নম্বর থেকে ফোন ধরা বন্ধ করে দেয়। নানা আনুষঙ্গিক পদক্ষেপও নিতে হয় তাকে। সে এখন প্রানপনে চেষ্টা করছে জীবনটাকে আবার গুছিয়ে নিতে।
অনন্যার গল্পটা ব্যতিক্রম নয়। অনলাইন হয়রানির একটা অতি সাধারণ উদাহরণ। মামুলি মেসেজ, মিসড কলও হতে পারে ডিজিটাল হিংসার প্রথম ধাপ। ইনবক্সে ছোট্ট পিং, কমেন্ট, অথবা অচেনা নম্বরের কল―এগুলোই মনের ভেতর জমতে জমতে পাহাড় হয়ে ওঠে। ফলে রাতের ঘুম কমতে থাকে অচিরেই। তৈরি হয় নিরাপত্তাহীনতা, ট্রমা, আতঙ্ক। মনের মধ্যে বাসা বাঁধে অ-সুখ, অবিশ্বাস। ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে থাকে মানসিক স্বাস্থ্য। ফোনের মতো ব্যক্তিগত কিছু তখন আর ব্যক্তিগত থাকে না।
অফলাইন হোক বা অনলাইন―নিরাপত্তার অধিকার সকলের। ‘না’ মানে ‘না’―এটা বুঝতে শিখুক সকলে। কোন কোন আচরণ থেকে ডিজিটাল হিংসার বাতাবরণ সৃষ্টি হতে পারে―এই নিয়ে সমাজের সব স্তরে সচেতনতা ছড়াক। সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত হোক।